ল্যান্ডস্কেপ
পানিতে, মেঘের অবয়ব দেখলেই
বুঝতে পারি, বৃষ্টিরা মেঘের গুমটিঘরে
পানির ঘূর্ণিতে নামবে জলমগ্ন বর্ষা
দূরের আকাশে পাশাপাশি ছায়া পাহাড়ের
ছায়া নয়, হেমন্তের বিরতিকালীন অপেক্ষা
ট্রেন ছাড়লে দৃশ্য লুকাবে সূর্যাস্তের স্তুপে
বনবাদাড়—প্রকৃতির ঘন ঘোর অন্ধকারে
অন্ধকার নয়, লম্পট চাঁদ বিঁধে গেছে গাছে
বাবুইয়ের বাসা খুলবে এবার সমস্যা জট
গ্রামশূন্য, যাওয়া-আসা নেই মানুষের
মানুষ কোথায়, কাকতাড়ুয়া ধানক্ষেতে
পশু-পাখিরা মানুষের মতো জোট পাকাবে!
বুকের উজানে
আমার কর্ণফুলী, রাত্রিবেলা তার ভাঙা পাড়ে কে যেন সাজায় মিউজিক্যাল ঢেউ
নদীর পাথরে সেই উপশম ফোটে, যদি না চঞ্চল রূপালি মাছগুলো জ্বরতপ্ত শরীরে
ছড়িয়ে যায় বর্ণচোরা স্রোত নিঃসঙ্গ বুদবুদে। নিমজ্জিত অর্কেস্ট্রা জল গাঙচিলের
বয়ানে অকপট সত্যস্বীকার করে—‘এপাড়-ওপাড় ভেঙেও কী সাবলীল নদীকূল!’
কখনো কখনো নদীও গোপনে যেন ডানা মেলা ইকারুস, তখন অবিরাম পাতা
ঝরে মুমূর্ষু অশ্বত্থের। পাখির পালক গায়ে জলমগ্ন নদী গাছে গাছে দেখে মৃত
নদীদের কষ্টের বিজ্ঞাপন। ক্রমশ স্রোত ও কল্লোলে জেনে যায়—লোকালয়ে মৃত
নদীদের স্বপক্ষে শুধু মনোটোনাস গাছই কথা বলে এবং প্রকৃতি গাছেরও অধিক—
মুক্তিতে বিশ্বাসী। ফলে স্বপ্নগ্রস্ত ঢেউ অযথাই নিরব হুলস্থুল ক্ষরণের ব্যঞ্জনায়
মুক্তি ও সমতা খোঁজে…নিহিত পাতাল ছুঁয়ে বয়ে যায় আবেগতাড়িত প্লাবন ভূমিতে!
আমিও কীভাবে কীভাবে রাত্রি খুঁড়ে, অলি গলি ঘুরে—বেদনাক্লিষ্ট নদীটিকে
খুঁজে আনি। দ্যাখি, নক্ষত্রের অনুতপ্ত বলয়ে যে নদীটি দিনরাত বয়ে চলে— তার
আশ্রমে শুধু দখলদারিত্ব, রেষারেষি, ভাগাভাগি…আমিও তাকে অনিবার্য ধ্বংস
থেকে দূরে ডেকে আনি বাতাসের সমাবেশে। বলে যাই শুধু—সহজ মৃত্যু রেখে
জ্বলে ওঠো এইবার, নষ্ট করো না সময় অযথা হা-হুতাশে, এ মাটি তোমার, এ
গতিপথ শুধু একান্ত তোমারি—সব ছেড়ে ছুঁড়ে চলো সাহসী উদ্যমে! তোমার
রুদ্রনাচ অনেক দিন দেখি না! হে নৃত্যপটিয়সী নদী, পায়ে পরে নাও দ্যোতনা সৃষ্ট
ঘুঙুর—ভয়ঙ্করী প্রলয় নৃত্যে গিলে নাও, গিলে নাও যতো অবৈধ স্থাপন, ঢেউয়ে
ঢেউয়ে বিভ্রমে দূরে রাখো সমস্ত হট্টগোল! এরপর সীমাহীন সমুদ্রে শুদ্ধ হয়ে চলে
এসো এই ধূপখোলা মাঠে, রঙের উৎসবে—পানপাত্র হাতে পাতা পোড়াবো দুজনে…
ভেসে বেড়ানোর আনন্দে
লিপ অব ফেইথ, তোমার সবুজ জমিন থেকে একটু একটু করে দেখো—
পা রাখছি মেঘের ওই উঁচুতে
সরে যাচ্ছি দ্রুত
পা কাঁপছে আমার
হাত দুটোও সমানে-সমান
যেন আমি লেজ ফোলানো অসহায় কাঠবেড়ালি!
দূর্বাদলের ভেতর থেকে ডানা দুটো বের করে অসীম সাহসে লাগিয়েছি পিঠে।
আহা, একটা ছোট্ট দৌড়ে না হয় আমি হয়ে গেছি মুক্ত পাখি
ততক্ষণে কেটে গেছে আমার বুক ঢিপ ঢিপ মোশন সিকনেস!
ভো-চক্করে, বাতাসের তীব্রতায় সমস্ত পর্বতচূড়া যেন নিজেদের ভ্যালিতে টানছে
ওই উঁচু থেকে মায়াবী গহীন বনগুলোকে মনে হচ্ছে—বিস্তীর্ণ চাদরে ছাওয়া সবুজ
যেন আমি মহাজাগতিক ময়ুরাক্ষী ফুল, বিবর্ণ হতে হতে উঠে গেছি পাহাড়শীর্ষে
মগজে তখনো নীলের রোমাঞ্চ ত্রিশূল! স্বচ্ছ মেঘে ভেসে বেড়াচ্ছে হালকা চাপে
ইকারুসের আকাশে ছেড়ে আসছি স্তুপাকার সমস্ত অভিমান, জমানো কষ্টগুলো
যেন জন্মানোর অনেক, অনেক আগে থেকেই মেঘগুলোর সাথে আমার বন্ধুত্ব ছিল
বাতাসে ঝুঁকে পড়ার আগেই তাদের হিমশীতল কুয়াশা পান করেছি আঁজলাভরে
আমার ভেসে বেড়ানোর এমন আনন্দ দেখে চাঁদও বেরিয়ে এসেছে মুখাচ্ছাদন থেকে
এইসব জাগতিক আনন্দকে আমি শুধু বলতে চেয়েছি—
আমি বহিরাগত নই, বহিরাগত নই, আমি তোমাদেরই একজন
যার মনোভূমিতে রাতের তারারা, অলক্ষ্যে ঘোরে, ভো-চক্কর দেয় পৃথিবীময়
ল্যান্ডিংয়ে সামান্য কাদা-পানি পেলে যার চোখে-মুখে ঘুরে বেড়ায় প্রশান্তির হাসি
লিপ অব ফেইথ দেখো, আকাশ থেকে হালকা দৌড়ে কীভাবে সবুজে নামছি—
পা রাখছি নরোম জমিনে
সমস্ত ভয় ডর উবে কীভাবে দাঁড়িয়ে যাচ্ছি প্রস্তুত হয়ে
এখন একটুও পা কাঁপছে না আমার
হাত দুটোও সমানে-সমান
যেন আমি এভারেস্ট বিজয়ী শেরপা একজন!
বিশাখা ও আমি
সংকটকালে গাঢ় অশ্বত্থের নিচে মুখ নিচু করে দাঁড়ালে, প্রিয় দেবদূতগণ আমার দিকে ছুঁড়ে দেয় পাঁচটি উজ্জ্বল প্রজ্ঞা
সেগুলো কুড়িয়ে চিঠি লিখতে বসি বিশাখাকে, “দৈবাৎ পেয়ে গেছি প্রজ্ঞা, এমন রাজসিক উপহার কখনো পাইনি
ঝরে পড়লো যেন মহাকালের প্রাজ্ঞবৃন্ত থেকে, আমি শব্দরূপী মাকাল ফল—গেয়ো ভিখারি, ঘোর তন্দ্রায় থাকি
প্রজ্ঞাগুলো তোমার সমীপে পাঠাচ্ছি। একটু দেখে শুনে রেখো গো শ্রেষ্ঠী!”
ওদিকে শীতে জড়জড় গাছের পাতা, বসন্তের পরাগায়ন মেখে কচি কচি সবুজ কিশলয়ও সরব
পাখিরা দলবেঁধে আরও দক্ষিণে ফেরে। না উত্তর, না দক্ষিণ। কোনো দিক থেকে বিশাখাকে লেখা
আমার চিঠির প্রত্যুত্তর আসে না।
অভিমানে অশ্বত্থের কুলকুল পাতার ধ্বনিতে আমি মিশে যাই, ধ্যানেমগ্ন হলে টের পাই স্বয়ং গাছদেবতা
ছুঁড়ে দিচ্ছেন সতেজ অশ্বত্থ পাতা। যেন পাতা নয়, ফুলের মতো অসহ্য আনন্দ পাশাপাশি বিশ্বলোকে পড়ছে
সেগুলো কুড়িয়ে বৃক্ষ সমীপে গুছিয়ে রাখি, বাতিঘরে মোম জ্বালাই, দগ্ধমনে চক্রমণের জন্যে উদ্যত হলে দ্যাখি
চাঁদের ধূসরতা চুঁয়ে অন্ধকারে একজন নারী কণ্ঠে বলছে, “পূজনীয় ভিক্ষুগণ, বসন্তে গুপ্তস্থানে ধ্যানের জন্য
হিমালয়ে পাড়ি জমাচ্ছে! আমরা শ্রেষ্ঠীরা ছুটে গেছি দূর-দূরান্ত হতে সেখানে পরমান্ন হাতে!
তখুনি মুখ ফসকে বেরিয়ে আসে, “সেকি, স্বর্গে গিয়েও বিশ্রাম নেই কারুর? তাহলে পৃথিবীতে অর্জিত সমস্ত পূণ্যরাশি
সেগুলোও কী দান ও ত্যাগের মহিমায় বৃক্ষ সমীপে ঝরছে অকাতরে?”
বিশাখা, যেন দৃষ্টির কোটরে জ্বলছে অন্য এক আলোর দ্যুতি! সে দ্যুতি নিয়েই কলহাস্যে বলে ওঠে, “নিজের শেকড় ছেড়ে
কত পথ হেঁটে গেছি, সেখানে লাল গোলা সুতা পেচিয়ে রেখেছে আমারই কাটা-ছেঁড়া ক্ষত, বিদ্রোহ-অপমান…স্বর্গ ছেড়েছি
তাই মানুষের ভিড়ে আত্মপরিচয়ে আধেক আলোতে আধেক ভালোতে সুড়ঙ্গ-মানুষ হয়ে সমাজ-শৃঙ্খলে পা বাড়াই…”
মায়াময় বিশাখা হাসতে হাসতে মিশে যায় শব্দ কায়ায়! তাঁর পদচ্ছাপে পংক্তির মতো কিছু স্ফটিক ফুটে ওঠে
আমাদের রাত্রির সংলাপে, আরও কিছু অশত্থের সতেজ পাতা—গাছ থেকে উড়ে যায়…
—বুঝি, আমার মতোই স্বর্গে দোটানায়, অস্বস্তিতে আছে বিশাখা!
বিমূর্ত সম্পর্ক
বসন্তদিন দ্যাখো,
বেয়ারিং চিঠি হাতে কড়া নাড়ছে পোস্টম্যান
তাঁবুঘর থেকে বেরিয়ে সেই দৃশ্য দেখছে— ব্যথাতুর বিকেল
চিঠি কোথায়? খাম খুলে দ্যাখি, পাতাজুড়ে ডট-হাইফেন
যেন গোধূলি আলোয় উড়ে গেছে ভাষা কোনো শরণার্থী শিবিরে
নিরুদ্দেশ অক্ষরগুলোও তামাটে শরীরে ধানের আগায় কাঁপছে
জানি না, কী জমিয়ে রেখেছে চিঠির নৈঃশব্দে, পরিপাটি ভাঁজে
যেন একটা পুরনো সাংকেতিক গল্প, পারস্পরিক কথোপকথনের
যেখানে রোদ সেঁকছে—স্তব্ধ কুমড়ো ফুল আর রগচটা শালিক
আসলে, বেয়ারিং চিঠি মানেই লাল কমল, নীল কমল, ডিপ্রেশন ট্রেন
ছুটছে—খুব উত্তেজিত, ঝড়োগতিতে স্টেশনের একান্ত নৈঃশব্দে