আলী রীয়াজঃ
সোনাগাজীর মাদ্রাসাশিক্ষার্থী নুসরাত জাহান রাফির হত্যাকাণ্ডের পরে যে চারটি বিষয় উঠে এসেছে, তার মধ্যে যেমন আছে দেশে যৌন নিপীড়ন বৃদ্ধির বিষয়, তেমনি আছে ধর্মীয় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে যৌন নিপীড়নের প্রশ্ন। আরও আছে পুলিশ ও স্থানীয় প্রশাসনের ভূমিকা, আছে স্থানীয় রাজনীতির প্রশ্ন।
ধর্মীয় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে যেকোনো ধরনের অনৈতিক কাজ, বিশেষত যৌন নিপীড়নের ঘটনা ঘটলে তা যে বেশি মনোযোগ আকর্ষণ করে। এর কারণ, সাধারণভাবে ধরে নেওয়া হয় যে ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানে যাঁরা কাজ করেন, তাঁদের নৈতিক অবস্থান শক্তিশালী এবং জৈবিক তাড়না নিয়ন্ত্রণে তাঁরা আরও বেশি সচেতন। কিন্তু সব সময়ই তা সত্য নয়। তার সবচেয়ে বড় প্রমাণ হচ্ছে ক্যাথলিক চার্চ। কয়েক দশক ধরে সারা দুনিয়ার বিভিন্ন চার্চে ক্যাথলিক ধর্মযাজকেরা শুধু যে কিশোর (এবং কিশোরীদের) যৌন নিপীড়ন করেছেন তা–ই নয়, তা ধামাচাপা দেওয়ার জন্য এমন সব ব্যবস্থা নিয়েছেন, যা আইন ও নীতিনৈতিকতার বিবেচনায় অপরাধ। ১৯৮০–এর দশক থেকে এ বিষয়ে তথ্য-প্রমাণ ও সাক্ষ্য থাকা সত্ত্বেও ক্যাথলিক চার্চের সর্বোচ্চ প্রশাসনিক কাঠামো এই নিয়ে কথা বলেনি। ২০০২ সালে বোস্টন গ্লোব–এর অনুসন্ধানী প্রতিবেদনের পর এ নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রে আলোচনা জোরদার হয়। পোপ জন পল ২০০১ সালে এ বিষয়ে প্রথম দুঃখ প্রকাশ করেন। শুধু যে ক্যাথলিক চার্চের ক্ষেত্রেই তা ঘটেছে তা নয়, অন্যান্য ধর্মের ক্ষেত্রেও বিচ্ছিন্নভাবে হলেও যৌন নিপীড়ন, ধর্ষণের প্রমাণ আছে—প্রাতিষ্ঠানিকভাবে এই সব আচরণ রক্ষার ব্যবস্থাও আছে। এগুলো প্রমাণ করে যে সাধারণ মানুষ ধর্মীয় সংস্থার কাছে যে ধরনের উচ্চ নৈতিকতার প্রত্যাশা করে, তা সব সময় পূরণ হয় না। সেই প্রত্যাশা পূরণ নিশ্চিত করার উপায় হচ্ছে ওই সব সংস্থার স্বচ্ছতার ব্যবস্থা করা, তাদের ওপর মানুষের নজরদারির ব্যবস্থা করা, তাদের সমাজের কাছে দায়বদ্ধ করা।
ধর্মীয় বা ধর্মভিত্তিক প্রতিষ্ঠানের মধ্যে সেই সব প্রতিষ্ঠানেই বিভিন্ন ধরনের নিপীড়ন, এমনকি যৌন নিপীড়ন বেশি ঘটে, প্রধানত আবাসিক এবং কেবল ধর্মীয় অনুভূতি বিবেচনায় যেগুলোর ওপরে নজরদারির ব্যবস্থা হয় দুর্বল নতুবা অনুপস্থিত। যদিও নুসরাতের ওপরে নির্যাতন এবং তাঁকে হত্যার ঘটনা ঘটেছে আলিয়া মাদ্রাসা ধারার একটি প্রতিষ্ঠানে, তথাপি এই আলোচনায় উঠে এসেছে যে বাংলাদেশে কওমি মাদ্রাসার শিক্ষকদের বিরুদ্ধে শিশু নির্যাতনের সংবাদই সবচেয়ে বেশি শোনা যায়। আলিয়া মাদ্রাসাগুলো সরকারি শিক্ষাব্যবস্থার অধীন এবং সেগুলো সরকারিভাবে এবং স্থানীয় জনপ্রতিনিধি ও প্রশাসনের তত্ত্বাবধানেই থাকার কথা, কিন্তু তত্ত্বাবধানের অনুপস্থিতি এই ঘটনায় এবং এই ধরনের অন্যান্য প্রতিষ্ঠানের ক্ষেত্রে সুস্পষ্ট। তার কারণ প্রশাসনিক ব্যর্থতা ও রাজনৈতিক বিবেচনা, ধর্মীয় অনুভূতির প্রতি শ্রদ্ধা নয়। সমাজের সব প্রতিষ্ঠানকেই রাজনৈতিকভাবে ব্যবহারের এবং দলীয়ভাবে সাজানোর যে সংস্কৃতি গড়ে উঠেছে, তার ফলেই আজ এই পরিস্থিতি মারাত্মক রূপ নিয়েছে।
মাদ্রাসা ও অন্যান্য শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের পরিচালনা পরিষদের সঙ্গে যুক্ত ব্যক্তিরা ওই প্রতিষ্ঠানে কী ঘটে, কারা নিযুক্ত হন, তাঁরা দায়িত্ব পালন করেন কি না, সেই বিষয়ে জানেন বলে মনে হয় না। অন্যথায় একজন ব্যক্তি, যাঁর বিরুদ্ধে অতীতে অন্যত্র যৌন হয়রানির অভিযোগ ছিল, তিনি কী করে অধ্যক্ষের চাকরি পান? এখন জানা যাচ্ছে যে ‘১৯৯৬ সালে ফেনী সদরের দৌলতপুর সালামতিয়া দাখিল মাদ্রাসা থেকে অনিয়ম এবং ছাত্র বলাৎকারের অভিযোগে বহিষ্কার করা হয়েছিল’ (যুগান্তর, ১৩ এপ্রিল ২০১৯); ‘ছাত্রীদের শ্লীলতাহানি, আর্থিক দুর্নীতি এবং নাশকতা ও পুলিশের ওপর হামলা–মামলায় তিন দফা কারাভোগ করেছেন সিরাজ উদদৌলা’ (প্রথম আলো, ১১ এপ্রিল ২০১৯)। এসব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের পরিচালনা পরিষদে অভিভাবকেরা যুক্ত থাকেন বটে, এই যুক্ত থাকা নামমাত্র কি না, তাঁরা তাঁদের বক্তব্য দিতে পারেন কি না, তা–ও আমরা জানি না। কিন্তু সোনাগাজী ইসলামিয়া ফাজিল মাদ্রাসার ঘটনা থেকে এটা জানি যে তাঁদের অভিযোগ আমলে নেওয়া হয় না। এইগুলো জবাবদিহি, স্বচ্ছতার অনুপস্থিতির প্রমাণ। ভুলে যাওয়ার সুযোগ নেই যে এই মাদ্রাসার গভর্নিং বডির সভাপতি হচ্ছেন ফেনীর অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট।
শিশুদের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোর ব্যাপারে আরেকটি বিষয় বিবেচনায় নিতে হবে, তা হচ্ছে শিক্ষার পরিবেশ। যেসব প্রতিষ্ঠানের পরিবেশ শিশুর মানসিক উৎকর্ষের অনুকূল নয়, সেগুলোর বিষয়ে সরকার, শিক্ষা মন্ত্রণালয় ও ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষের দায়িত্ব কী? এই নিয়ে আলোচনার জন্য আর কত দিন অপেক্ষা করতে হবে? মাদ্রাসাবিষয়ক আলোচনায় প্রতিষ্ঠানের পরিবেশ আলোচিত হয় না। ধর্মীয় জ্ঞান অর্জন করতে হলে, জীবনাচরণ শিখতে হলে তা কেন শিশুদের ও অন্য শিক্ষার্থীদের উন্মুক্ত মানস গঠনের দরজা বন্ধের মাধ্যমে করতে হবে? ইসলামের ইতিহাস থেকে এমন উদাহরণ পাওয়া যাবে না।
এই মর্মান্তিক ঘটনার তৃতীয় দিক স্থানীয় প্রশাসন ও পুলিশের ভূমিকা। ‘স্থানীয় প্রশাসন ও পুলিশ মাদ্রাসার অধ্যক্ষ সিরাজ উদদৌলার বিরুদ্ধে অতীতে আনীত অভিযোগ তদন্ত করতে ব্যর্থ হয়েছে বা ধামাচাপা দিয়েছে। এই সব অভিযোগের মধ্যে যৌন নির্যাতনের অভিযোগ ছিল একাধিক’ (যুগান্তর, ১৩ এপ্রিল ২০১৯)। অভিযোগ আছে অর্থ আত্মসাতের। পুলিশের কর্মকর্তা নুসরাতকে জেরা করার নামে হেনস্তা করেছেন, একজন সাংবাদিককে দিয়ে হত্যাকে আত্মহত্যা বলে চালানোর চেষ্টা করেছেন, সংবাদমাধ্যমে এটা হত্যা না আত্মহত্যা বলে সংশয় প্রকাশ করেছেন। স্থানীয় পুলিশের এই আচরণে যে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের অনুমোদন ছিল, তার প্রমাণ হচ্ছে নুসরাত জাহানের পরিবারকে দোষারোপ করে পুলিশ সদর দপ্তরে চিঠি দিয়েছিলেন ফেনী জেলার পুলিশ সুপার (এসপি) জাহাঙ্গীর আলম। ১১ এপ্রিল পুলিশ সদর দপ্তর, বিশেষ শাখা ও চট্টগ্রাম রেঞ্জের ডিআইজির দপ্তরে পাঠানো ওই প্রতিবেদনে অভিযোগ করা হয়েছে, নুসরাতকে পুড়িয়ে মারার ঘটনায় মামলা করতে পরিবার ‘কালক্ষেপণ’ করেছে। পুলিশের এই ভূমিকার পেছনে এটা স্পষ্ট যে পুরো বিষয়টি ধামাচাপা দিলে তাদের কোনো রকম ক্ষতির শিকার হতে হবে না, সেই বিষয়ে তারা নিশ্চিত ছিল। ঘটনাপ্রবাহে নুসরাতের ক্ষেত্রে আমরা তা জানতে পারছি, কিন্তু এটি কি ব্যতিক্রম? অবশ্যই ব্যতিক্রম মনে করার কারণ নেই। কী কারণে পুলিশ বা স্থানীয় প্রশাসন তা মনে করতে পারে? তার উত্তর আছে এই ঘটনার চতুর্থ দিকে—স্থানীয় রাজনীতির কলুষিত বৃত্তচক্র।
সোনাগাজী ইসলামিয়া ফাজিল মাদ্রাসার অধ্যক্ষ হিসেবে সিরাজ উদদৌলার নিয়োগ এবং কার্যক্রমই কেবল প্রশ্নবিদ্ধ নয়, নিয়োগের পর থেকেই স্থানীয় রাজনীতি, সুনির্দিষ্টভাবে আওয়ামী লীগের রাজনীতির সঙ্গে তাঁর ঘনিষ্ঠতা এখন সুবিদিত। জামায়াতে ইসলামী থেকে ‘অপকর্মের কারণে’ বহিষ্কৃত একজন ব্যক্তিকে (‘কে এই সিরাজ?’, একুশে টেলিভিশন, ১৭ এপ্রিল ২০১৯) কোনো দল ও তার নেতারা গ্রহণ করবেন কি না, সেটা দলের আদর্শের প্রশ্ন। কিন্তু ক্ষমতাসীন দল ও উপদলীয় কোন্দলের সঙ্গে জড়িত এই ব্যক্তি যে অন্যায় ও বেআইনি কার্যক্রম চালিয়ে যেতে পেরেছেন তার কারণ হচ্ছে, এখন সারা দেশেই ক্ষমতাসীন দলের সদস্য হওয়ার অর্থ হচ্ছে আইনের ঊর্ধ্বে উঠে যাওয়া। এর অনেক উদাহরণ আছে, একটি সাম্প্রতিক ঘটনা উল্লেখ করলে বুঝতে সহজ হবে। ১৭ এপ্রিল নারায়ণগঞ্জের আড়াইহাজারে পুলিশের এক কর্মকর্তাসহ দুই কনস্টেবলকে মারধর করেন স্থানীয় ছাত্রলীগের নেতা ও তাঁর সহযোগীরা। তাঁদের আটক করার পর ছেড়ে দিয়েছেন থানার ওসি, কারণ কী? তাঁর ভাষ্যে, ‘সব নিজেরা নিজেরা। বিএনপি হইত একটা কথা আছিল, ব্যবস্থা নিতে পারতাম।’ অর্থ, ক্ষমতা, প্রভাব, প্রতিপত্তি মিলেমিশে যে একাকার হয়ে গেছে এবং সেখানে নীতিনৈতিকতা যে আর কারও বিবেচ্য বিষয় নয়, এই হচ্ছে তার উদাহরণ।
কিন্তু এটি ব্যতিক্রম নয়, সিরাজ উদদৌলা একা নন। স্থানীয় ও জাতীয় পর্যায়ে রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বিতার রাজনীতির অবসান হওয়ার সঙ্গে এর সম্পর্ক বুঝতে না পারার কারণ নেই। ক্ষমতাসীন দলের নেতাদের সাধারণ নাগরিকদের কাছে জবাবদিহি করতে হয় না, ফলে তাঁদের জন্য যা লাভজনক, তা–ই এখন নির্ধারকের ভূমিকা নিয়েছে। প্রশাসন এই নিয়ে আপত্তি করবে, এমন সম্ভাবনাও নেই—‘সব নিজেরা নিজেরা’।
সোনাগাজী ইসলামিয়া ফাজিল মাদ্রাসার ছাত্রী নুসরাতের হত্যাকারীদের, হত্যাকাণ্ডের পরিকল্পনাকারীদের, তার মদদদাতাদের বিচার হোক সেটা আশা করি। আদালতের মতোই আশা করি ‘এই মামলা হারিয়ে যাবে না’। কিন্তু জবাবদিহির অনুপস্থিতির যে সংস্কৃতি—সেটা যৌন নিপীড়নের বিচার, মাদ্রাসার শিক্ষা, স্থানীয় প্রশাসনের আচরণ ও পুলিশের কার্যক্রম এবং স্থানীয় রাজনীতির বিষাক্ত চক্রের মধ্যে দিবালোকের মতো স্পষ্ট। এই চারটি দিক যেখানে এসে এক জায়গায় মিলেছে, তার কী হবে? এই বৃত্তচক্রকে বহাল রেখে কতজন নুসরাতের হত্যার বিচার করা সম্ভব?
আলী রীয়াজ: যুক্তরাষ্ট্রের ইলিনয় স্টেট ইউনিভার্সিটির সরকার ও রাজনীতি বিভাগের ডিস্টিংগুইশড প্রফেসর