আগের দিন সন্ধ্যায়ও হলি আর্টিজান বেকারির সবুজ লনে পোষা কুকুরের সঙ্গে খেলছিল কয়েকটি শিশু। লনের পাশে চেয়ারে বসে আয়েশ করে কফিতে চুমুক দিতে দিতে আড্ডায় বসেছিল দেশি-বিদেশি বেশ কয়েকজন। রাতেই পাল্টে গেল সব চিত্র।
শুক্রবার রাত ৯টার দিকে একদল বন্দুকধারী রাজধানীর কূটনীতিকপাড়ার ওই ক্যাফেতে অস্ত্র ও বিস্ফোরকসহ ঢুকে বিদেশিসহ কয়েকজনকে জিম্মি করেন। তাদের মোকাবেলায় গিয়ে নিহত হন দুই পুলিশ কর্মকর্তা।
এরপর আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সঙ্গে সামরিক বাহিনী এই জিম্মিদের উদ্ধারে কমান্ডো অভিযানে নামে শনিবার সকালে। ঘণ্টাখানেকের মধ্যে সঙ্কটের অবসান ঘটে।
সকাল সাড়ে ৭টায় সাঁজোয়া যান নিয়ে অভিযান শুরুর পর প্রায় এক ঘণ্টা প্রবল গোলাগুলি চলে।
গুলশান ২ নম্বরের ৭৯ নম্বর সড়কের ওই ক্যাফের কাছে একটি ভবন থেকে অভিযান দেখা এক প্রত্যক্ষদর্শী জানান, সকাল সোয়া ৮টার পর দুটি জলপাইরঙা সেনা সাঁজোয়া যান আর্টিজান বেকারির সীমানা দেয়াল ভেঙে ভেতরে ঢুকে পড়ে। সাদা আরেকটি সাঁজোয়া যান ছিল রাস্তায়। পরে অভিযানে যুক্ত হয় আরও তিনটি জলপাই রঙের সাঁজোয়া যান।
সাঁজোয়া যান ক্যাফে কম্পাউন্ডে ঢোকার সময় এর বাইরের দিকে থাকা পিজা কর্নার এবং লাগোয়া লেক ভিউ ক্লিনিকের গাড়ি পার্কিংয়ে রাখা দুটি গাড়ি গুঁড়িয়ে যায়। বিকট শব্দে বাজছিল একটি গাড়ির অ্যালার্ট সিস্টেম।
আশপাশের ভবনের ছাদে স্বয়ংক্রিয় রাইফেল আর টেলিস্কোপ লাগানো স্নাইপার রাইফেল নিয়ে অবস্থান নেন কমান্ডোরা।
সোয়া ৮টা থেকে একে একে কয়েকজনকে ক্যাফেটি থেকে উদ্ধার পেয়ে বেরিয়ে আসতে দেখা যায়। তাদের সঙ্গে সঙ্গে অ্যাম্বুলেন্সে করে হাসপাতালে পাঠানো হয়।
কমান্ডো অভিযানের মধ্যেই ঢাকা মহানগর পুলিশের উপ-কমিশনার (চ্যান্সেরি) জসিম উদ্দিন সাংবাদিকদের বলেন, “একজন একজন (জিম্মিদের) করে উদ্ধার করা হচ্ছে।”
সকাল ৯টার দিকে র্যাবের মহাপরিচালক বেনজীর আহমেদকে সাদা পোশাকে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যদের সঙ্গে কথা বলতে দেখা যায় ভবনটির বাইরে।
কিছুক্ষণ পর আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্য, যারা আশপাশের ভবনে অবস্থান নিয়েছিলেন, তাদের বাঁশি বাজিয়ে বের হয়ে পরস্পরকে আলিঙ্গন করতে দেখা যায়।
ধ্বংসস্তূপে পরিণত হওয়া হলি বেকারির সবুজ লনে তখনও তৎপর দেখা গেছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যদের। ফায়ার সার্ভিসের কর্মীরা বহনযোগ্য ছোটো অগ্নিনির্বাপক যন্ত্র নিয়ে ছুটে যেতে দেখা যায়। একটু পরে হোস পাইপ হাতে অন্য কর্মীদেরও দেখা যায়। তবে ক্যাফেতে কোনো আগুন দেখা যায়নি।
সকাল ৯টা ২ মিনিটে বিকট একটি শব্দে চারপাশ কেঁপে উঠে। তবে এ সময় ক্যাফেটিতে থাকা আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যদের তাদের জায়গাতেই দেখা যায়।
সাড়ে ৯টার দিকে র্যাবের গণমাধ্যম শাখার সহকারী পরিচালক মিজানুর রহমান বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “অভিযান শেষ।”
হলি বেকারির সামনের প্রাঙ্গণে এরপর সেনা সদস্যদের দেখা গেছে। ছিলেন দুই-একজন র্যাব সদস্যও। পুরোদস্তুর বর্ম পরে বোমা নিষ্ক্রিয়করণ দলের সদস্যদের তৎপরতাও দেখা গেছে। আরেকটুসামনে পাহারায় মিলিটারি পুলিশ। বাকিরা দাঁড়িয়ে রাস্তায়।
বেকারির টি শার্ট পরা কিছু কর্মীকে দেখা গেছে পাশের রাস্তায়।
সকাল ৯টা ৩৭ মিনিটে আরেকটি বিকট বিস্ফোরণের শব্দ পাওয়া যায়। অবস্থাদৃষ্টে তখন স্পষ্ট, বোমা নিষ্ক্রিয়কারী দল কাজ চালিয়ে যাচ্ছিল। কারণ শব্দ হওয়ার আগেই সেনা সদস্যদের কানে আঙুল দিতে দেখা যায়।
অভিযান শেষের পর ক্যাফের পাশের বহুতল ভবনটির গ্যারেজে হাত পিছমোড়া করে বেঁধে কয়েকজন যুবককে প্রায় এক ঘণ্টা ধরে শুইয়ে রাখতে দেখা যায়। তবে তারা কারা সে বিষয়ে কিছু জানা যায়নি। বেকারির পেস্ট্রি শেফের পোশাক পরা একজনের সঙ্গে কয়েকজনকে একটি মাইক্রোবাসেও তুলতে দেখা যায়।
অনেকক্ষণের নীরবতা ভেঙে আবার বিকট শব্দ ১০টা ৫৯ মিনিটে। নিষ্ক্রিয় করা হয় আরেকটি বোমা।
সকাল সোয়া ১১টায় বেকারির প্রাঙ্গণে আনা হয় কয়েকটি কার্টন। ভেতর থেকে বের হলো অবশ্য খাবার। রক্তাক্ত অভিযানের পর ক্লান্ত সেনা সদস্যরা খাবার আর পানীয় নিয়ে গাছের ছায়ায় বসে পড়লেন।
পাশের ১০ তলা ভবনের বারান্দা থেকে উঁকি দিতে দেখা গেছে দুই বিদেশি নাগরিককে। নির্মাণ শেষ হয়ে যাওয়া ভবনটির অধিকাংশ ফ্ল্যাটই ফাঁকা, যার বেশ কয়েকটিতে অভিযানের সময় ছিলেন স্নাইপার রাইফেল হাতে সেনা সদস্যরা। সাড়ে ১০টার দিকে তাদের অনেককেই ছাদ থেকে নেমে যেতে দেখা যায়। আর্টিজানের বিপরীত দিকের ভবনটির ছাদে রাত থেকেই অপেক্ষায় ছিল কমান্ডোরা। তারাও নেমে যান।
সকাল সাড়ে ১১টার দিকে ঘটনাস্থলে দেখা যায় জ্যাকেট পরা সিআইডি সদস্যদের। একটু পর পাশের একটি ভবনের গেটে দেখা মেলে দুই জন নারী পুলিশকে। বোঝা যায় পরিস্থিতি ক্রমেই স্বাভাবিক হচ্ছে।
[বিডিনিউজ]