হাফিজুল ইসলাম চৌধুরী :
কক্সবাজারের রামু উপজেলা সদরের চৌমুহনী থেকে প্রায় ৩৫ কিলোমিটার দূরের দুর্গম পাহাড়ি গ্রাম লোহারঝিরি। এই গ্রামে দু একজন বাঙালি ছাড়া বাকি বসবাসকারী বাসিন্দারা সবাই রাখাইন সম্প্রদায়ের। সবদিক থেকেই পিছিয়ে আছে এই গ্রাম। বিদ্যুৎ নেই। আশপাশে বিদ্যালয়ও নেই। স্বাস্থ্যসেবায় ভরসা পার্শ্ববর্তী উপজেলার বাইশারী বাজারের ওষুধের দোকান। চিকিৎসকের কাছে যাওয়া হয় না। আয়-রোজগারের একমাত্র পথ পাহাড় থেকে জ্বালানি কাঠ সংগ্রহ করে বিক্রি ও জুমচাষ।
সবচেয়ে বড় বিষয় হচ্ছে ব্রিটিশ আমল থেকেই তাঁদের বসবাস হলেও গ্রামের ৯৫ ভাগ লোক অশিক্ষিত। সম্প্রতি লোহারঝিরি গ্রাম ঘুরে দেখা গেছে, পাহাড়ের টিলায় তৈরি রাখাইনদের জীর্ণ অসংখ্য ঘরবাড়ি। ছেলেমেয়েরা ঘরের আঙিনায় খেলাধুলায় ব্যস্ত। অধিকাংশ শিশুর খালি গা। কিছু নারী-পুরুষ পাহাড় থেকে জ্বালানি কাঠ সংগ্রহ করে খোলা মাঠে স্তুপ করছেন।
বাসিন্দারা জানান, এই পাড়ার আশপাশে কোনো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান নেই। কয়েকজন ছেলে পাশের বান্দরবান জেলার নাইক্ষ্যংছড়ি উপজেলার বাইশারী বেসরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে গিয়ে লোখাপড়া করছে। গ্রামের আরও শতাধিক রাখাইন শিশু কিশোর পড়ালেখা করতে পারছে না। পুরো গ্রামে এসএসসি পাস শিক্ষার্থী রয়েছে দুজন। এরা হলো মং ঙেই চাই ও বুচিং রাখাইন। মং ঙেই চাই আর বুচিং নাইক্ষ্যংছড়ি হাজি এম এ কালাম ডিগ্রি কলেজের ছাত্র।
রাখাইন নারী তামাপ্রু (৫০) ও মাশিং (৪৮) আমাদের রামু ডটকমকে বলেন, ছেলেমেয়েদের লেখাপড়া শিখিয়ে মানুষ করার ইচ্ছা থাকলেও সম্ভব হচ্ছে না। অভাবের সংসারে তারা বনের জ্বালানি কাঠ সংগ্রহ করে বাড়তি টাকা উপার্জন করছে। গ্রামে একটা স্কুল তৈরি হলে একসঙ্গে দুটো কাজ সামলানো যেত।
একসময় তাঁতে তৈরি রকমারি কাপড় বিক্রি করে সংসার চালাতেন এখানকার বাসিন্দারা। এখন অধিকাংশ তাঁত বন্ধ। তাই খেয়ে না খেয়ে চলছে দিন। পাড়ার বাসিন্দা ছাই থোয়াং (৬৪) জানান, ‘ব্রিটিশ আমল থেকেই এই গ্রামে ৬০টির বেশি রাখাইন পরিবারের বসবাস। অথচ এখনো এই গ্রামে বিদ্যুৎ পৌঁছেনি। গ্রামে নেই কোনো বড় রাস্তা। নেই কোনো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান।
একসময় রাখাইনদের তাঁতে বোনা কাপড়-চোপড়ের দেশব্যাপী চাহিদা থাকলেও এখন সেই দিন নেই। মিয়ানমার থেকে চোরাইপথে আসা কাপড়ে বাজার সয়লাব। তাই অভাব-অনটনেই চলছে রাখাইনদের সংসার।’ আরও কয়েকজন বাসিন্দা অভিযোগ করেন, রাতের বেলায় বাইরের লোকজন তাঁদের গ্রামে এসে হইচই করে। রাখাইন মেয়েদের উত্ত্যক্ত করে। জ্বালানি কাঠ সংগ্রহের বিপরীতে চাঁদা আদায় করে। দিনমজুরি আর লাকড়ি সংগ্রহ করে সংসার চালাতে তাদের হিমশিম খেতে হচ্ছে। তাই প্রতিবাদ করার সাহস পাচ্ছেন না।
গর্জনিয়া ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) চেয়ারম্যান তৈয়ব উল্লাহ চৌধুরীে আমাদের রামু ডটকমকে জানান, লোহারঝিরির বাসিন্দারা অত্যন্ত গরিব। রাখাইনদের শিক্ষা-স্বাস্থ্য ও কর্মসংস্থান সৃষ্টির লক্ষ্যে নানা উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে। রাতে রাখাইনপল্লিতে বহিরাগতদের উৎপাত চললেও দুর্গম পাহাড়ি অঞ্চল বলে তা নিয়ন্ত্রণ সম্ভব হচ্ছে না।
এ ব্যাপারে গর্জনিয়া পুলিশ ফাঁড়ির ইনচার্জ উপপরিদর্শক রফিকুল ইসলাম আমাদের রামু ডটকমকে বলেন, গেল বছরের জুলাইয়ের বন্যায় বাঁকখালী নদীর ওপর তৈরি গর্জনিয়া সেতুর সংযোগ সড়ক বিলীন হলে সেই থেকে সড়ক যোগাযোগ বন্ধ রয়েছে। এ কারণে দিনে ডিঙি নৌকায় চড়ে বাঁকখালী নদী অতিক্রম করে গর্জনিয়া এলাকায় পুলিশ টহল দিলেও সন্ধ্যার পর তা সম্ভব হচ্ছে না। তবে কেউ লিখিত অভিযোগ দিলে পুলিশ বখাটেদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিবে।