অনলাইন ডেস্কঃ
দেশের মাধ্যমিক স্তরের (ষষ্ঠ থেকে দশম শ্রেণি) ৩৭ শতাংশ শিক্ষক বাজার থেকে কেনা নোট-গাইড বইয়ের ওপর নির্ভরশীল। তাদের ২২ দশমিক ৪ ভাগ নিজের বাসায় অর্থের বিনিময়ে প্রাইভেট পড়ান। প্রশ্ন তৈরি করতে পারেন না বেশিরভাগ শিক্ষক। ১৪ দশমিক ৪ ভাগ শিক্ষক সরাসরি শিক্ষক সমিতি বা খোলাবাজার থেকে প্রশ্নপত্র কিনে পরীক্ষা নেন নিজ স্কুলে। বেসরকারি সংস্থা (এনজিও) গণসাক্ষরতা অভিযান পরিচালিত ‘এডুকেশন ওয়াচ ২০১৮-২০১৯’-এর প্রতিবেদনে মাঠ পর্যায়ের এমন চিত্রই উঠে এসেছে।
গতকাল রোববার আনুষ্ঠানিকভাবে প্রকাশ করা হয়েছে এ প্রতিবেদন। রাজধানীর এলজিইডি ভবনে অনুষ্ঠিত এই প্রতিবেদন প্রকাশনা অনুষ্ঠানের আয়োজন করে গণসাক্ষরতা অভিযান। প্রতিবেদনে বলা হয়, দেশের মাধ্যমিক স্তরের শিক্ষকদের মধ্যে ব্যাপক বৈষম্য রয়েছে। সরকারি, এমপিওভুক্ত এবং নন-এমপিও- এই তিন ধরনের শিক্ষকদের বেতন কাঠামো বিশ্নেষণ করে ‘এডুকেশন ওয়াচ ২০১৮-২০১৯’ প্রতিবেদনে এমন তথ্যই তুলে ধরা হয়েছে। এতে বলা হয়, সরকার সব শিক্ষার্থীকে নিখরচায় পাঠ্যপুস্তক সরবরাহ করেছে। শিক্ষণ-শিখন মূলত শ্রেণিকক্ষেই হওয়া উচিত। তা সত্ত্বেও শিক্ষকদের গাইডবই ব্যবহার এবং গৃহশিক্ষকতায় অংশগ্রহণের প্রবণতা কমেনি। ২২.৪ শতাংশ শিক্ষক গৃহশিক্ষকতায় (বাসায় কোচিং) জড়িত। তারা গড়ে ২৩.৩ জন শিক্ষার্থীকে পড়ান। গৃহশিক্ষকতায় ব্যাপক ব্যবধান রয়েছে। তারা একজন থেকে শুরু করে ২৩০ জন পর্যন্ত শিক্ষার্থী পড়ান। সরকারি বিদ্যালয়ের ১৭.১ শতাংশ, বেসরকারি বিদ্যালয়ের ২৩.৭ শতাংশ, স্কুল ও কলেজ ২৪.২ শতাংশ, দাখিল মাদ্রাসার ১৯.৭ শতাংশ, উচ্চতর মাদ্রাসার ২০.৭ শতাংশ শিক্ষক গৃহশিক্ষকতায় জড়িত। গৃহশিক্ষকতায় অংশ নেওয়া শিক্ষকদের মধ্যে গণিতের শিক্ষকরা সবার শীর্ষে, ইংরেজি শিক্ষকরা ছিলেন তাদের ঠিক পরই, আর এর পরই আছেন বিজ্ঞান বিষয়গুলোর শিক্ষকরা। শিক্ষকরা গাইডবই ব্যবহার করেন ৩৭.১ শতাংশ। ইংরেজি ও গণিত বিষয়ের জন্য মাধ্যমিকের সব শ্রেণিতেই গাইডবই ব্যবহার করে থাকেন তারা। নবম ও দশম শ্রেণিতে পদার্থবিজ্ঞান, রসায়ন ও উচ্চতর গণিতের ক্ষেত্রে এবং মাদ্রাসার সব শ্রেণিতে আরবি বিষয়ে গাইডবই ব্যবহারের প্রবণতা বেশি।
শিক্ষকদের মাঝে বেতন বৈষম্য: ওই প্রতিবেদনে বলা হয়, মাধ্যমিক স্তরের এক শতাংশ শিক্ষক সবচেয়ে বেশি আয় করেন। তাদের গড় আয় সবচেয়ে কম আয় করেন এমন এক-পঞ্চমাংশের গড় আয়ের সাড়ে ৩ গুণ। সরকারি বিদ্যালয়ের শিক্ষকদের আয় সবচেয়ে বেশি। তাদের আয় এমপিওভুক্ত শিক্ষকদের আয়ের প্রায় দ্বিগুণ। আর এমপিওভুক্ত নন এমন শিক্ষকদের আয়ের প্রায় সাড়ে ৩ গুণ।
গবেষণার তথ্য অনুযায়ী, সরকারি বিদ্যালয়ের শিক্ষকের বার্ষিক গড় আয় ৫ লাখ ৩৭ হাজার। আর এমপিওভুক্ত শিক্ষকের ২ লাখ ৮৬ হাজার। এ ছাড়া এমপিওবিহীন শিক্ষকের ১ লাখ ৪১ হাজার।
জরিপের ৫ শতাংশ শিক্ষক জানিয়েছেন, তারা সব সময়ই অভাবে ছিলেন। ২০ শতাংশের বেশি শিক্ষকরা জানিয়েছেন, তারা মাঝে মাঝে অভাবে ছিলেন। প্রায় ৩৫ শতাংশ খেয়ে-পরে সমান ছিলেন। তার ৪০ শতাংশ শিক্ষক জানিয়েছেন, বছরের সব খরচ মিটিয়ে তাদের কিছু টাকা উদ্বৃত্ত ছিল।
জরিপের সব শিক্ষকের প্রথম পেশা হিসেবে শিক্ষক। তবে দুই-তৃতীয়াংশ শিক্ষকের দ্বিতীয় একটি পেশাও রয়েছে। শিক্ষকদের এক-পঞ্চমাংশে দ্বিতীয় পেশা হিসেবে গৃহ ব্যবস্থাপনা রয়েছে। নারীদের ক্ষেত্রে এই হার ৮৬ শতাংশ। শিক্ষকদের ২৩ শতাংশের দ্বিতীয় পেশা কৃষিকাজ। ১১ শতাংশের গৃহশিক্ষকতা। ব্যবসা ৪ শতাংশের। সরকারি স্কুলের ৫৭ শতাংশের বেশি এবং অন্যান্য প্রতিষ্ঠানের এক-তৃতীয়াংশ শিক্ষকের একমাত্র পেশা শিক্ষকতা।
প্রতিবেদনে বলা হয়, মাধ্যমিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে ক্রমবর্ধমান বৈষম্য নিরসনের লক্ষ্যে প্রতিষ্ঠানভেদে শিক্ষকদের শিক্ষাগত যোগ্যতা, অবকাঠামো ও অন্যান্য সুবিধা-সংক্রান্ত যেসব পার্থক্য রয়েছে সেগুলো দূর করতে হবে। প্রতিষ্ঠানের ধরনভেদে শিক্ষকদের একই পদ্ধতিতে নিয়োগদান এবং চাকরি ও অবসরকালীন আর্থিক ও অন্যান্য সুবিধার ক্ষেত্রে সমতা বিধান করা। প্রচলিত শিক্ষক নিয়োগ পদ্ধতি সময়ের সঙ্গে শুধু অসমতা বাড়িয়ে দিয়েছে, তাই এ ক্ষেত্রে এর একটা পরীক্ষা-নিরীক্ষা ও পর্যালোচনা এখন সময়ের দাবি। এ ক্ষেত্রে বেসরকারি মাধ্যমিক বিদ্যালয় ও দাখিল মাদ্রাসার প্রতি বিশেষ নজর দেওয়া উচিত।
অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি ছিলেন শিক্ষা উপমন্ত্রী ব্যারিস্টার মহিবুল হাসান চৌধুরী নওফেল। বিশেষ অতিথি ছিলেন সংসদ সদস্য অ্যারোমা দত্ত, প্রধানমন্ত্রীর এসডিজিবিষয়ক মুখ্য সমন্বয়ক মো. আবুল কালাম আজাদ। সভাপতিত্ব করেন গণসাক্ষরতা অভিযানের সহসভাপতি ড. মনজুর আহমেদ। অনুষ্ঠান সঞ্চালনা করেন গণসাক্ষরতা অভিযানের নির্বাহী পরিচালক রাশেদা কে. চৌধুরী।
প্রতিবেদনে সুপারিশ করা হয়, প্রতিটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শিক্ষার্থী-শিক্ষক অনুপাতের একটি উপযোগী মাত্রা নিশ্চিত করতে হবে। বর্তমান শিক্ষার্থী-শিক্ষক অনুপাত, গত পাঁচ বছরে শিক্ষার্থী সংখ্যা এবং শিক্ষকদের জন্য অনুমোদিত পদসংখ্যা বিবেচনায় নিয়ে প্রতিটি প্রতিষ্ঠানের জন্য আলাদাভাবে তথ্য বিশ্নেষণ করতে হবে।
শ্রেণি শিক্ষকদের মানোন্নয়নে শিক্ষকদের দায়িত্বশীল করে গড়ে তোলার নিমিত্তে শ্রেণিকক্ষে তাদের পাঠদান দক্ষতার ওপর ভিত্তি করে বার্ষিক শিক্ষক মূল্যায়নের ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। শ্রেণিকক্ষে কার্যকর শিক্ষণ ব্যাহত হওয়ার অন্যতম কারণ শিক্ষকদের জ্ঞানের সীমাবদ্ধতা।
উপমন্ত্রী মহিবুর হাসান চৌধুরী বলেন, ‘মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের কিছু টেক্সট বই নিয়ে আমি নিজেই পরীক্ষা করে দেখেছি। সেখানে গণিতসহ বিজ্ঞান ও অন্য বিভাগের কিছু বইয়ে যে ধরনের কনটেন্টগুলো রয়েছে, তা একজন শিক্ষার্থীর একার পক্ষে ৫ থেকে ৭ শতাংশের বেশি সমাধান করা সম্ভব নয়। এ জন্য তাদের পুরোপুরিভাবেই শিক্ষকের ওপর নির্ভর করতে হয়। অনেকেই এই সুযোগ ব্যবহার করেই আলাদাভাবে শিক্ষার্থীদের পড়ানো এবং সহায়ক গ্রন্থগুলো তাদের বাণিজ্য কার্যক্রম শুরু করে।’
আবুল কালাম আজাদ বলেন, ‘শিক্ষকদের প্রশিক্ষণের জন্য আমাদের প্রতিষ্ঠানের সীমাবদ্ধতা আছে, তবে আন্তরিকতা থাকলে শিক্ষকরা আরও ভালোভাবে শিক্ষা দিতে পারবেন। শিক্ষার্থীর থেকে তার বইয়ের ওজন বেশি। সেটি আসলে শিক্ষক ও স্টু্কল অথরিটির কাজ। সরকার প্রণীত বইগুলোর ওজন খুব বেশি নয়। অতিরিক্ত বইগুলো দেওয়া হয় শিক্ষক এবং স্টু্কলের অথরিটি থেকে।’
রাশেদা কে. চৌধুরী বলেন, ‘আমরা দেশে বর্তমানে দক্ষ, যোগ্য ও আদর্শ শিক্ষক পাচ্ছি না। পেলেও সেই দু’একজনকে প্রয়োজনমতো সাপোর্ট দেওয়া হচ্ছে না।’
অনুষ্ঠানে শিক্ষা মন্ত্রণালয়, শিক্ষাবিদ, শিক্ষক নেতৃবন্দসহ বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থার কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন।
সূত্রঃ সমকাল