খালেদ শহীদ, রামুঃ
তথ্য মন্ত্রণালয়ের সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সদস্য আলহাজ্ব সাইমুম সরওয়ার কমল এমপি বলেছেন, সম্প্রীতি বিশ্বাসে জাহাজ ভাসা উৎসব আজ মিলনমেলায় পরিণত হয়েছে। যারা সম্প্রীতি রক্ষা করে, তাদেরই বিজয় আজ। যারা বৌদ্ধ সম্প্রীতি ধ্বংস করতে চেয়েছিল, তারা আজ পরাজিত। সব ধর্মের মানুষের অংশগ্রহনের এ উৎসবের মাধ্যমে অসাম্প্রদায়িক চেতনা চর্চা হচ্ছে রামুতে। তিনি বলেন, জাহাজ ভাসা উৎসব শুধু বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের মধ্যে সীমাবদ্ধ নাই। এই উৎসব সকল ধর্মের মানুষের উৎসব, বাঙ্গালীর উৎসব।
গতকাল সোমবার (১৪ অক্টোবর) বিকাল ৫ টায় রামুর বাঁকখালী নদীতে অনুষ্ঠিত জাহাজ ভাসা উৎসবে প্রধান অতিথির বক্তৃতা করেন, তথ্য মন্ত্রণালয়ের সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সদস্য আলহাজ¦ সাইমুম সরওয়ার কমল এমপি।
রামু কেন্দ্রীয় প্রবারণা পুর্ণিমা ও জাহাজ ভাসা উৎসব উদযাপন পরিষদের সভাপতি জ্যোতির্ময় বড়ুয়া রিগ্যানের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত জাহাজ ভাসা উৎসব উদ্বোধন করেন, কক্সবাজার জেলা প্রশাসক মো. কামাল হোসেন।
সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির বিশ্বাসে রামু কেন্দ্রীয় প্রবারণা পুর্ণিমা ও জাহাজ ভাসা উৎসব উদযাপন পরিষদের উদ্যোগে অনুষ্ঠিত হয় জাহাজ ভাসা উৎসব। জেলা-উপজেলার বিভিন্ন গ্রামের হাজারো বৌদ্ধ নরনারী ছাড়াও বিভিন্ন ধর্মাবলম্বীর উপস্থিতিতে এটি অসা¤প্রদায়িক চেতনার উৎসবে পরিনত হয়। জাহাজ ভাসানো উৎসবের মূল আনন্দায়োজনে রামুর বিভিন্ন বৌদ্ধ গ্রামের ১০টি কল্প-জাহাজ অংশ নেয়। উৎসবে পূজনীয় পন্ডিত সত্যপ্রিয় মহাথের’র মহাপ্রয়াণ স্মরণে কালো ব্যাজ ধারণ ও কল্প জাহাজে কালো পতাকা উড়ানো হয়। সন্ধ্যায় নদীতে প্রদীপ ভাসানো ও আকাশে ফানুস উড়ানোর মাধ্যমে পূণ্যার্পন করা হয়।
কক্সবাজার জেলা প্রশাসক মো. কামাল হোসেন বলেন, সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির ঐতিহ্যবাহী স্থান রামু। আমাদের ঐতিহ্যকে ধারণ করে এগিয়ে নিতে রামু জাহাজ ভাসা উৎসব। কক্সবাজারের পর্যটন শিল্পকে আরো সমৃদ্ধ করবে এ উৎসব। তিনি বলেন, রামুতে উৎসাহ-উদ্দীপনায় প্রবারনা পূর্ণিমা ও জাহাজ ভাসা উদযাপনই বলে দেয়, হাজার বছর ধরে এ অঞ্চলের সম্প্রীতির চর্চায় বেঁচে থাকবে রামু জাহাজ ভাসা উৎসব।
বৌদ্ধরা জানান, সম্প্রীতির স্বারক হিসেবে প্রচলিত রামু উপজেলার জাহাজ ভাসা উৎসব, দুইশত বছর পূর্বে মিয়ানমারে প্রচলিত জাহাজ ভাসা উৎসবের আদলে রামুর রাখাইনরা বাঁকখালী নদীতে আয়োজন শুরু করে। এরপর থেকে রামুতে বৌদ্ধরা প্রবারনা পূর্ণিমা উপলক্ষে বাঁকখালী নদীতে জাহাজ ভাসা উৎসবের আয়োজন করে আসছে। তারই ধারাবাহিকতায় গতকাল সোমবার দুপুর থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত এ উৎসবকে ঘিরে রামুর বাঁকখালী নদীর দু’পাড়ে নেমেছিল হাজার হাজার নর-নারীর অসাম্প্রদায়িক সম্মিলন। তাঁরা নানা বাদ্য বাজিয়ে সেখানে নাচছে। গাইছে বুদ্ধ কীর্তন ‘বুদ্ধং শরণং গচ্ছামী, ধম্মং শরণং গচ্ছামী, সংঘং শরণং গচ্ছামী’। ‘বুদ্ধ, ধর্ম সংঘের নাম সবাই বলো রে’ বুদ্ধের মতো এমন দয়াল আর নাইরে’। জাহাজ ভাসা উৎসবে সকল সম্প্রদায়ের মানুষের উপস্থিতিকে আস্তার সংকট উত্তরণের পথ হিসেবে দেখছেন বৌদ্ধ নেতৃবৃন্দরা।
অনুষ্ঠানে বিশেষ অতিথির বক্তব্য রাখেন, এটিএন নিউজের প্রধান নির্বাহী সম্পাদক মুন্নী সাহা, কক্সবাজার পুলিশ সুপার এবিএম মাসুদ হোসেন, অতিঃ পুলিশ সুপার মো. আদিবুল ইসলাম, রামু উপজেলা নির্বাহী অফিসার প্রণয় চাকমা, বৌদ্ধ ধর্মীয় কল্যাণ ট্রাস্টের ভাইস চেয়ারম্যান সুপ্ত ভূষণ বড়ুয়া, সহকারি কমিশনার (ভূমি) চাই থোয়াইলা চৌধূরী, রামু থানা অফিসার ইনচার্জ মো. আবুল খায়ের, ওসি (তদন্ত) এস এম মিজানুর রহমান, বৌদ্ধ ধর্মীয় কল্যাণ ট্রাস্টের ট্রাস্টী এড. দ্বীপংকর বড়ুয়া পিন্টু, ফতেখাঁরকুল ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান ফরিদুল আলম, খুনিয়াপালং ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান আবদুল মাবুদ, কক্সবাজার জেলা পূজা উদযাপন পরিষদের সাধারণ সম্পাদক বাবুল শর্মা, জেলা যুবলীগের সাবেক শ্রম ও কর্মসংস্থান বিষয়ক সহ-সম্পাদক পলক বড়ুয়া আপ্পু, রামু উপজেলা যুবলীগের সাধারণ সম্পাদক নীতিশ বড়ুয়া, জেলা বৌদ্ধ সম্প্রীতি পরিষদের আহবায়ক অমরবিন্দু বড়ুয়া অমল, জেলা ছাত্রলীগের সাবেক সাংস্কৃতিক বিষয়ক সম্পাদক রজত বড়ুয়া রিকু, সাবেক ছাত্র নেতা অর্পন বড়ুয়া, কক্সবাজার সদর উপজেলা ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক মুন্না চৌধূরী প্রমুখ।
রামু কেন্দ্রীয় প্রবারণা পুর্ণিমা ও জাহাজ ভাসা উৎসব উদযাপন পরিষদের প্রধান সম্বনয়ক স্বপন বড়ুয়ার সঞ্চালনায় অনুষ্ঠানে স্বাগত বক্তব্য রাখেন, উৎসব উদযাপন পরিষদের সাধারণ সম্পাদক মিথুন বড়ুয়া বোথাম প্রমুখ।
সোমবার বিকালে রামু উপজেলার ফকিরা বাজারের পূর্ব পাশে বাঁকখালী নদীতে সাত-আটটি নৌকার উপর বসানো হয়েছে এক একটি কল্প-জাহাজ। বাঁশ, কাঠ, বেত, রঙ্গিন কাগজ দিয়ে রেঙ্গুনী কারুকাজে তৈরী দৃষ্টি নন্দন বৌদ্ধ বিহার, সিংহ, হাতি, হাঁস, ঘোড়া, ড্রাগনের প্রতিকৃতি ফুটিয়ে তোলা এসব জাহাজ খুব সহজেই দৃষ্টি কাড়ে মানুষের। প্রতিটি জাহাজেই ছিলো একাধিক মাইক। ক্যাসেট প্লেয়ার, ঢোল, কাঁসর, মন্দিরাসহ নানা বাদ্যের তালে তালে শিশু কিশোর ও যুবকরা নেচে গেয়ে মেতেছে অন্যরকম বাঁধভাঙা আনন্দে। জাহাজ নিয়ে ভাসতে ভাসতে এপার থেকে ওপারে যেতে যেতে মাইকে চলে বৌদ্ধ কীর্তন, নাচ, গানসহ নানা আনন্দায়োজন। শুধু বৌদ্ধ ধর্মালম্বীরা নয়, এ আনন্দে মেতে উঠেছে অন্যান্য স¤প্রদায়ের লোকজনও। প্রায় শতবছর ধরে, রামুর বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীরা প্রবারণা পূর্ণিমা উপলক্ষে প্রতি বছর জাহাজ ভাসা উৎসবের আয়োজন করে আসছে।