খালেদ শহীদঃ
রামুর ঐতিহাসিক আঁধার মানিক গুহার গুপ্ত রহস্য উন্মোচনে প্র্ত্নতাত্ত্বিক জরিপ ও অনুসন্ধান কাজ উদ্বোধন করা হয়েছে। সড়ক পরিবহণ ও মহাসড়ক বিভাগের যুগ্ন সচিব মো. জাকির হোসেন শনিবার (১৬ নভেম্বর) বিকালে রামু উপজেলার কাউয়ারখোপ ইউনিয়নের উখিয়ারঘোনা এলাকায় ঐতিহাসিক আঁধার মানিক গুহা’র জরিপ ও অনুসন্ধান উদ্বোধন করেন। স্থানীয়রা এটি কানা রাজার সুড়ঙ্গ বলেও অবিহিত করেন। একই সাথে কক্সবাজার জেলার আরো তিন উপজেলা উখিয়া, মহেশখালী ও কক্সবাজার সদর উপজেলার প্র্ত্নতাত্ত্বিক জরিপ ও অনুসন্ধান কাজ উদ্বোধন করা হয়েছে। সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরের চট্টগ্রাম ও সিলেট বিভাগের উদ্যোগে প্র্ত্নতাত্ত্বিক জরিপ ও অনুসন্ধান কাজ পরিচালনা করা হচ্ছে।
উদ্বোধন অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি যুগ্ন সচিব মো. জাকির হোসেন বলেন, আমাদের ইতিহাস, ঐহিত্য, সংস্কৃতিকে লালন না করি, না জানি এবং ভালবেসে ধরে না রাখি, তাহলে এমনিতেই নষ্ট হয়ে যাবে প্রাচীন নিদর্শন। আমরা আমাদের ইতিহাস-ঐতিহ্যকে বের করবো, জানবো এবং মানুষদেরকে জানাবো। সেই সাথে মানুষ আমাদের কাছে আসবে, মানুষের সাথে মেলবন্ধনে মিলিত হবো। তিনি বলেন, পর্যটন শিল্প শুধু হোটেল ব্যবসা নয়। আমাদের ইতিহাস-ঐতিহ্য ভাললাগা, লোক সংস্কৃতি ও সংগীত সহ আরো অনেক কিছু মিলেই আমাদের পর্যটন। লেখাপড়া ও গবেষনার সাথে এসব নিদর্শন সংরক্ষণ করতে হবে। মহাসড়কের পাশে যে সব পর্যটন স্থাপনা রয়েছে, সেই সব নিদর্শন চিহ্নিত করতে হবে।
প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরের চট্টগ্রাম ও সিলেট বিভাগের আঞ্চলিক পরিচালক ড. মো. আতাউর রহমান উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করেন। অনুষ্ঠানে বিশেষ অতিথির বক্তব্য রাখেন, কক্সবাজার ট্যুরিস্ট পুলিশের পুলিশ সুপার জিল্লুর রহমান, রামু সরকারি কলেজের অধ্যক্ষ আবদুল হক, কক্সবাজার সিভিল সোসাইটির সভাপতি সাংবাদিক ফজলুল কাদের চৌধুরী, সাধারণ সম্পাদক আ.ন.ম হেলাল উদ্দিন, জেলা পরিষদের সদস্য শামসুল আলম চেয়ারম্যান ও নুরুল হক কোম্পানী, কাউয়ারখোপ ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান মোস্তাক আহমদ, কবি এম সুলতান আহমদ মনিরী ও কক্সবাজার আর্ট ক্লাবের সাধারণ সম্পাদক রিয়াজুল কবির বিবণ।
প্রধান অতিথি মো. জাকির হোসেন বলেন, কয়েক হাজার বছর আগের শহর অঞ্চল রামু। প্রায় আড়াই বছর আগের গুহা। গুহা খননের সাথে ইতিহাসকে খনন করা হবে। ইতিহাসকে জানা হবে। তিনি আরো বলেন, এই গুহা খনন কাজটা সেনসেটিভ হবে। এখানকার মাটি পাথুরে না। এখনে অনেকদিন ধরে পানি জমে আছে, কাদা জমে আছে। সয়েল বিশেষজ্ঞের দরকার হবে। তাদেরকেও এ কাজে যুক্ত করতে হবে।
ড. মো. আতাউর রহমান বলেন, ইতিহাস-ঐতিহ্যে ভরপুর পর্যটন শহর কক্সবাজারের রামু উপজেলা হাজার বছরের ঐতিহ্যে সমৃদ্ধ জনপদ। প্রাকৃতিক ও প্রতœতাত্তি¡ক নিদর্শন এবং রাজা-বাদশাদের আবাসস্থল হওয়ায় এ উপজেলার গুরুত্ব ও পরিচিতি দেশজুড়ে। রামুর অনেক এলাকার নামের সাথে মিশে আছে সমৃদ্ধ ইতিহাস। ঐতিহাসিক এসব নিদর্শন এখনো রামুতে দৃশ্যমান। কাঁনা রাজার সুড়ঙ্গ যার অন্যতম। ইতিহাস-ঐহিত্য জানতে হবে এবং ঐতিহাসিক নিদর্শন সংরক্ষণ করতে হবে। রামুর কাঁনা রাজার সুড়ঙ্গ যথাযথ সংরক্ষণের মাধ্যমে এর ইতিহাস তুলে ধরতে পারলে এখানে জ্ঞান পিপাসুদের পাশাপাশি পর্যটকদের আকর্ষণও বাড়বে।
সাংবাদিক সোয়েব সাঈদের সঞ্চালনায় অনুষ্ঠানে স্বাগত বক্তব্য রাখেন, কক্সবাজার আর্ট ক্লাবের সভাপতি তানভীর সরওয়ার রানা। শুভেচ্ছা বক্তব্য রাখেন, ছড়াকার কামাল হোসেন। স্থানীয় বাসিন্দারা স্বতঃস্ফূর্তভাবে ওই গুহায় যাওয়ার সড়কটি সংস্কার করে যাতায়াতের উপযোগি করে তোলেন। কাউয়ারখোপ হাকিম রকিমা উচ্চ বিদ্যালয় ও উখিয়ারঘোনা সাইমুম সরওয়ার কমল উচ্চ বিদ্যালয়ের শিক্ষক ও স্কাউটস দল অতিথিদের ফুলেল সম্ভাষণ জানান।
রামুর ঐতিহাসিক নিদর্শন কাউয়ারখোপ ইউনিয়নের উখিয়ারঘোনার দুর্গম পাহাড়ী এলাকার ‘আঁধার মানিক গুহা’। কথিত আছে এটি প্রায় সাড়ে তিন শত বছরের প্রাচীন নিদর্শন। স্থানীয়দের কাছে ‘আঁধার মানিক গুহা’টি ‘কানা রাজার সুড়ঙ্গ’ নামে পরিচিত। ৪০০ মিটার দীর্ঘ এই গুহা নিয়ে মানুষের মধ্যে প্রচলিত নানা কিংবদন্তি ইতিকথা। আরাকান রাজা চিন পিয়ান বৃটিশদের কাছে রাজ্য হারিয়ে উদ্বাস্তু জীবনের শেষ সময়ে রামু উখিয়ার ঘোনার পাহাড়ে গুপ্ত গুহা খনন করে লুকিয়ে থাকতেন। ওই সময়ে আরাকান রাজা চিন পিয়ানকে গ্রেফতার করতে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি তৎকালীন ৫ হাজার টাকা পুরস্কার ঘোষণা করেছিলেন। কথিত আছে আরাকান রাজা চিন পিয়ান এর একটি চোখ অন্ধ ছিল। তাই স্থানীয়রা তাকে কানা রাজা বলেও সম্বোধন করতেন। সেই কারণে গুপ্ত গুহাটির নাম ‘কানা রাজার গুহা’ বা ‘কানা রাজার সুড়ঙ্গ’। অন্ধকার রাতে ওই গুহার ভিতর থেকে আলো দেখা যেতো, মানিকের মতো আলো জ্বলত বলেই এটি ‘আঁধার মানিক গুহা’ নামেও পরিচিতি পায়। সেই ইতিহাস এখন কিংবদন্তি হয়ে আছে। কক্সবাজারের রামু উপজেলা সদর থেকে আধ ঘন্টার দূরত্বে কাউয়ারখোপ ইউনিয়নে উখিয়ার ঘোনায় এই গুপ্ত গুহা।
ওই গ্রামের প্রবীণ বাসিন্দা এমদাদ মিয়া জানান, ওই গুহার ভিতরে একটি মঞ্চ বা ধ্যানস্থান রয়েছে। ১০০ ফুটের মতো ভিতরে গেলেই আরো তিনটি গুহার পথ দেখা যায়। গুহার দেয়ালে আছে নানা ছবি আঁকা। তাদের ধারণা, এ গুহা দিয়ে প্রবেশ করে অন্য আরো কয়েকটি গুহা দিয়ে বের হওয়ার যায়। বহু বছর আগে বৌদ্ধদের চৈত্রসংক্রান্তি উৎসবে মিয়ানমারসহ আশপাশের রাখাইন ও বৌদ্ধ নারী-পুরুষ এ গুহা দেখতে আসত এবং মোমবাতি জ্বালাত গুহার মুখে।
সংস্কার ও সংরক্ষণের উদ্যোগ নিলে রামুর ঐতিহাসিক এ নিদর্শন উন্মোচন করতে পারে পর্যটনের সম্ভাবনার নতুন দিগন্ত। কক্সবাজারের কাছেই এ গুহা দেশি-বিদেশি পর্যটকদের কাছে অন্যতম দর্শনীয় স্থান হতে পারে বলে মন্তব্য করেন কাউয়ারখোপের প্রবীন বাসিন্দা শিক্ষক-কবি সুলতান আহমদ মনির।
প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরের চট্টগ্রাম ও সিলেট বিভাগের আঞ্চলিক পরিচালক ড. মো. আতাউর রহমানের নেতৃত্বে প্রাক জরিপ দল রামুর কাউয়ারখোপ ইউনিয়নে ঐতিহাসিক কাঁনা রাজার সুড়ঙ্গ বা আঁধার মানিক ছাড়াও ফতেখাঁরকুল ইউনিয়নের অফিসেরচর এলাকার ঐতিহাসিক লামার পাড়া বৌদ্ধ বিহার ও ক্যাপ্টেন হিরাম কক্সের ডাক বাংলো পরিদর্শন করেন। প্র্ত্নতাত্ত্বিক জরিপ ও অনুসন্ধান টিমে রয়েছেন, ফিল্ড অফিসার মো. শাহীন আলম, সহকারী কাস্টোডিয়ান মো. হাফিজুর রহমান, গবেষণা সহকারি মো. ওমর ফারুক, সার্ভেয়ার চাইথোয়াই মারমা, পটারী রের্কডার ওমর ফারুক ও লক্ষণ দাস।