ক্রীড়া ডেস্কঃ
দেড় যুগ আগে কেউ ভাবতে পেরেছিলেন দেশের মেয়েরা ফুটবল খেলে আন্তর্জাতিক অঙ্গন থেকে সাফল্য আনতে পারবেন? যখন মেয়েদের বল নিয়ে মাঠে নামাটাই ছিল ঝুঁকিপূর্ণ। ২০০৩ সালে মেয়েদের ফুটবল আয়োজন করতে গেলে সামনে হাজির পাহাড়সম বাধা। হুমকি-ধামকি। মিছিল-মিটিং, আন্দোলন। সব বাধা ঠেলে দেশের নারী ফুটবল এখন জায়গা করে নিয়েছে অনন্য উচ্চতায়। এক যুগের ব্যবধানে ফুটবল নিয়ে এখন স্বপ্ন দেখে সহস্র নারী। শতশত নারী ফুটবলকে বেছে নিয়েছেন আয়ের উৎসব হিসেবে। নারীরা তাদের পরিবারকেই বদলে দিচ্ছেন ফুটবল খেলে।
দেশে এগিয়ে যাচ্ছে। এগিয়ে যাচ্ছেন বাংলাদেশের নারীরা। সমাজের সর্বক্ষেত্রের ন্যায় খেলাধুলায়ও নারীরা নিজেদের ধাপে ধাপে তুলছেন নতুন উচ্চতায়। দেশে-বিদেশে, ঘরোয়া এবং আন্তর্জাতিক অঙ্গনে এখন বিভিন্ন সাফল্যের স্বাক্ষর রাখছেন বাংলাদেশের মেয়েরা। অদম্য এ নারীরা ফুটবল খেলে কীভাবে নিজেদের পরিবারকে বদলে দিচ্ছেন সেই গল্পই জানা যাক নারী দিবসে।
নারীদের বিশ্বকাপ ফুটবল চীন থেকে যাত্রা শুরু ১৯৯১ সালে। দল ছিল মাত্র ১২টি। চীন ছাড়াও এশিয়ার অন্য দুই দেশ জাপান ও চাইনিজ তাইপে। নারী বিশ্বকাপের সর্বশেষ আসর বসেছিল গত বছর ফ্রান্সে। দল দ্বিগুন ২৪টি। বিশ্বকাপ শুরুর পরই ফিফা উদ্যোগ নিয়েছিল পুরো বিশ্বে নারী ফুটবল ছড়িয়ে দিতে। সদস্য দেশগুলোকে অনুপ্রণীত করতে ফিফা আর্থিক অনুদানও দিতে শুরু করে। একপর্যায়ে নারী ফুটবলের চর্চা করা হয় বাধ্যতামূলক। বাংলাদেশ ফুটবল ফেডারেশন ২০০৩ সালে প্রথম নড়েচড়ে বসে।
১৭ বছর আগে নারী ফুটবলের চর্চার শুরুতে ভারতের পশ্চিমবঙ্গ থেকে একটি দল আনা হয় প্রীতি ম্যাচ খেলতে। বাফুফে একাদশ নামের একটি দল গঠন করতে শুরু হয় অনুশীলন। তারপর অনেক বাধা-বিপত্তি। তিনটি ম্যাচ হওয়ার কথা থাকলেও একটি বাতিল করা হয় উগ্র মৌলবাদীদের হুমকির কারণে। দমে যায়নি বাফুফে, দমে যাননি নারীরা। বাফুফে মহিলা উইং গঠন করে ঘরোয়া ফুটবলের আয়োজন করার উদ্যোগ নেয়। সেই বাংলাদেশ এখন নারী ফুটবলে শ্রেষ্ঠত্ব দেখাচ্ছে দক্ষিণ এশিয়ায়। বয়সভিত্তিক দলগুলো সাফ ও এএফসির বিভিন্ন টুর্নামেন্ট জিতে দেশের নারীরা গাইছেন ফুটবলজয়ের গান।
দেশে এখন শীর্ষ যে শতাধিক নারী ফুটবলার আছেন তাদের বেশিরভাগই নিম্নমধ্যবিত্ত পরিবার থেকে উঠে আসা। খেলার ছলে ফুটবল খেলেছেন তারা। কলসিন্দুরের মারিয়া মান্দা যেমন বলছিলেন, ‘আমরা আনন্দ করার জন্য ফুটবল খেলতাম। প্রধানমন্ত্রী যদি তার মায়ের নামে প্রাইমারি স্কুল ফুটবল শুরু না করতেন তাহলে আমরা এ পর্যন্ত আসতে পারতাম না। তখন জানতাম না ফুটবলে খেললে টাকা পাওয়া যায়, বিদেশে যাওয়া যায়। এখন বুঝি ফুটবলের মূল্য। অনেকের টাকা আছে কিন্তু বিদেশে সবার যাওয়া হয় না। প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে দেখা করার সুযোগ কয়জনের হয়? আমরা তার সাথে কয়েকবার দেখা করেছি। আমাদের টাকা দিয়েছেন। আদর করেছেন। আমরা অনেকবার বিদেশে গিয়েছি। একসময় আমাদের পরিবার অনেক কষ্ট করে চলতো। বাবা মারা যাওয়ার মা অন্যের জমিতে কাজ করে আমাদের খাওয়াতেন। এখন ফুটবল খেলে প্রধানমন্ত্রীর কাছ থেকে যে টাকা পেয়েছি তা দিয়ে জমি কিনেছি। অসুস্থ নানাকে চিকিৎসা করিয়েছি, ঘরবাড়ি ঠিক করেছি। এখন আর আমাদের অভাব নেই। এসব কিছুই হয়েছে ফুটবলের জন্য।’
এএফসি অনূর্ধ্ব-১৪, সাফ অনূর্ধ্ব-১৫, এএফসি অনূর্ধ্ব-১৬, সাফ অনূর্ধ্ব-১৮ এবং বঙ্গমাতা আন্তর্জাতিক গোল্ডকাপ জেতা মেয়েদের সংবর্ধনা দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী। তাদের পুরস্কার হিসেবে দিয়েছেন লাখ লাখ টাকা। বেশ কয়েকজন মেয়ে প্রধানমন্ত্রীর কাছ থেকে ১৫ লাখ টাকা পেয়েছেন। কেউ ১০, কেউ ৩, কেউ ১ লাখ। এভাবে ১ লাখ থেকে ১৫ লাখ টাকা পর্যন্ত পাওয়া মেয়ের সংখ্যা ৪৫ জন বলে জানিয়েছেন নারী ফুটবলের প্রধান কোচ গোলাম রব্বানী ছোটন। এর বাইরেও মেয়েরা বাফুফে, বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে আর্থিক পুরস্কার পেয়েছেন। মেয়েদের কেউ জমি কিনেছেন, কেউ বাড়িতে পাকা ঘর দিয়েছেন, কেউ টাকা ব্যাংকে স্থায়ী আমানত হিসেবে রেখেছেন, কেউ বাজারে দোকান ঘর কিনে ভাড়া দিয়েছেন। এভাবে এ মেয়েরা বদলে দিয়েছেন তাদের পরিবার।
রংপুরের কিশোরী ইসরাত জাহান রত্না। তিন দফায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছ থেকে পুরস্কার পেয়েছেন ১৪ লাখ টাকা। ২০১৭ সালে বাবাকে হারিয়েছেন। তিন বোনের বড়জনের বিয়ে হয়েছে। রত্না ও বৃষ্টি দুজনই ফুটবল খেলেন। রত্নাকেই দেখাশুনা করতে হয় পরিবার। পুরস্কার পাওয়া টাকার মধ্যে ১০ লাখ টাকা স্থায়ী আমানত হিসেবে ব্যাংকে রেখেছেন। বাকি টাকা দিয়ে জমি কিনে বর্গা দিয়েছেন। বাবার কবর পাকা করেছেন। এখন রত্নার পরিববার সুখেই আছে।
অথচ এই রত্না ২০১৬ সালে বাফুফের ক্যাম্পেই যোগ দিতে চাননি। বাবা সব্জির ব্যবসা করতেন। বাবাকে সহযোগিতা করতেন রত্না। ক্যাম্প শুরুর সপ্তাহখানেক পরও যোগ দিচ্ছিলেন না রত্না। নারী দলের প্রধান কোচ গোলাম রব্বানী ছোটন বলেন, ‘রত্না যখন আসছিল না তখন আমি লিটুকে (সহকারী কোচ মাহবুবুর রহমান) বলি তাকে দরকার। লিটু তখন ফোনে রত্নার বাবার সাথে কথা বলেন। ৫-৭ দিন পর রত্না ক্যাম্পে যোগ দেন।’
রত্না বলেন, ‘বাবাকে সহযোগিতা করব বলেই ক্যাম্পে আসতে চেয়েছিলাম না। তখন না আসলে আমাদের অভাব হয়তো কাটতো না।’
সানজিদা আক্তারদের পরিবার আগে থেকেই স্বচ্ছল। ফুটবল খেলে পাওয়া অর্থ তাদের অবস্থার আরও পরিবর্তন এনে দিয়েছে। পোস্ট অফিস এবং দুটি ব্যাংকে মিলিয়ে ১৫ লাখ টাকা স্থায়ী আমানত করেছেন। তার বাবা লিয়াকত আলী নিজেদের জমিজমা দেখাশুনা করছেন। চার কন্যা ও দুই পুত্র লিয়াকত আলী ও জোসনা খানম দম্পতির। বড় দুই মেয়ের বিয়ে দিয়েছেন। এখন দুই ভাই, দুই বোনের সংসার সানজিদাদের। আগের চেয়ে অনেক বেশি ভালো আছেন তারা।
টাঙ্গাইলের কৃষ্ণা রানী সরকার তিন দফায় প্রধানমন্ত্রীর কাছ থেকে উপহার পেয়েছেন ১৪ লাখ টাকা। জমি কিনেছেন, ব্যাংকে স্থায়ী আমানত হিসেবে ১০ লাখ টাকা রেখেছেন, বাড়িঘর নতুন করে সাজানোর উদ্যোগ নিয়েছেন। তিনতলা বিল্ডিংয়ের কাজও শুরু করেছেন কৃষ্ণারা। গোপালপুরে বাসুদেব সরকার ও নমিতা রানীর এক মেয়ে ও এক ছেলেকে নিয়ে সংসারে এখন স্বচ্ছলতার হাওয়া। কৃষ্ণার ভাই উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষার্থী।
তহুরা খাতুন ফুটবল থেকে পাওয়া টাকা দিয়ে প্রথমে বাড়ির পাশে তার পছন্দের একটা জমি কিনতে চেয়েছিলেন। কিন্তু সেই জমির কাগজপত্র ঠিকঠাক না থাকায় ময়মনসিংহের কলসিন্দুর বাজারে দোকান কিনেছেন এবং বাকি টাকা দিয়ে কিনেছেন অন্য একটি জমি। দোকান ভাড়া দিয়ে প্রতি মাসে দুই হাজার টাকা পান তার বাবা। পাঁচ বোন ও এক ভাই তহুরারা। বড় বোনের বিয়ে হয়েছে। এখন চার বোন, এক ভাই এবং বাবা-মাকে নিয়ে সুখে আছেন তহুরারা।
রাজশাহীর নার্গিস খাতুন ইনজুরির কারণে সাফ অনূর্ধ্ব-১৮ দলে থাকতে পারেননি বলে প্রধানমন্ত্রীর দেয়া ১০ লাখ টাকা মিস করেছেন। দুই দফায় চার লাখ টাকা পেয়েছেন। বাফুফে, ক্লাব ও অন্যান্য প্রতিষ্ঠান থেকে পাওয়া টাকা দিয়ে বাবা আকবর আলীর সার ও কিটনাশকের ব্যবসার কাজে লাগিয়েছেন। এখন মোদি দোকান দিয়েছেন তার বাবা। তিন বোনের মেজো নার্গিস। কোনো ভাই নেই। নার্গিসের বড় ভগ্নিপতিও তাদের ব্যবসা দেখাশুনা করেন।
সবচেয়ে বড় পরিবর্তন এসেছে পাহাড়ী দুই বোন আনুচিং মগিনি ও আনাই মাগিনির পরিবারে। দুই বোন মিলে ২০ লাখ টাকার বেশি পেয়েছেন ফুটবল খেলে। জমি কিনেছেন, বাড়ি ঠিক করেছেন, চার কক্ষের পাকা ঘর তুলছেন। জমজ আনাই-আনুচিংরা চার বোন, তিন ভাই। দুই মিনিটের ব্যবধানে পৃথিবীতে আসা এই দুই কন্যাই বদলে দিয়েছেন খাগড়াছড়ির রিপ্রু মগিনি ও আপ্রুমা মগিনি দম্পতির সংসার।
এভাবে মনিকা চাকমা, রিতুপর্ণা চাকমা, মাহমুদা, নাজমা, সাবিনাসহ প্রায় অর্ধশত নারী ফুটবলার পাল্টে দিয়েছেন তাদের পরিবার। নারী ফুটবল দলের প্রধান কোচ গোলাম রব্বানী ছোটন মেয়েদের এই বদলে যাওয়ার পেছনে প্রধানমন্ত্রীর উপহার ও অনুপ্রেরণাকেই সবচেয়ে বড় অবদান হিসেবে দেখছেন। বলেন, ‘তিনি (প্রধানমন্ত্রী) প্রাথমিক স্কুলপর্যায়ে মেয়েদের খেলা শুরু করেই প্রতিভা বাছাইয়ের সুযোগ করে দিয়েছেন। এরপর যখন সাফল্য এসেছে তখনই মেয়েদের ডেকে পুরস্কার দিয়েছেন, অনুপ্রেরণা দিয়েছেন। আমরা ভুটানে যখন চ্যাম্পিয়ন হয়েছি তখন প্রধানমন্ত্রী ঢাকা থেকে ফোন করে মেয়েদের খোঁজ-খবর নিয়েছেন। নেপালে যখন ভূমিকম্পের কারণে আমরা যখন আটকা পড়েছিলাম তখন তিনি হেলিকপ্টার পাঠিয়ে মেয়েদের ফিরিয়ে এনেছেন। এর চেয়ে বড় অনুপ্রেরণা আর কী হতে পারে? মেয়েদের ফুটবল খেলে পরিবার বদলে দেয়ার পেছনে বড় অবদান বঙ্গবন্ধুকন্যারই।’
সূত্রঃ জাগোনিউজ