অনলাইন ডেস্কঃ
ক্ষুদ্র উদ্যোক্তা রেবেকা খানম। তার স্বামী আশরাফ আলম একসময় এনজিওকর্মী ছিলেন। চাকরি চলে যাওয়ার পর স্বামী-স্ত্রী মিলে বুটিক শপ গড়ে তুলেন বছর তিনেক আগে। রাজধানীর শ্যামলীর বাসিন্দা এই দম্পতি দুই সন্তান নিয়ে ভালোই চলছিলেন। নিজেরা পণ্য বাজারজাত করতেন। আবার অনলাইনে কিছু কার্যাদেশ পেতেন। ক্রমান্বয়ে বিক্রি বাড়ায় ছোট আকারে কারখানা করেন বাসার পাশেই। পাঁচজন কর্মীও আছেন। কিন্তু করোনার কারণে তাদের জীবনে আকস্মিক বিপদ নেমে আসে। কাজ না থাকলেও দুই মাস ধরে শ্রমিকদের বেতন দিচ্ছেন। দিনে দিনে তাদের দুশ্চিন্তা বাড়ছে।
রেবেকা খানম সমকালকে বলেন, ‘আমাদের মতো মধ্যবিত্তরা সবচেয়ে কষ্টে আছে। আমাদের বড় সম্পদ আত্মসম্মান। ত্রাণের জন্য না পারি লাইনে দাঁড়াতে, না পারি কারও কাছে হাত পাততে। বুকের ভেতর চাপা কষ্ট, পাথর বেঁধে বেঁচে আছি।’
সোবহানবাগের বাসিন্দা নাজিম উদ্দিন জানান, করোনায় সবচেয়ে অসহায় মধ্যবিত্ত। গাজীপুরে প্লাস্টিক ফ্যাক্টরিতে চাকরি করেন তিনি। দুই মাস ধরে ফ্যাক্টরি বন্ধ। মার্চের বেতন পেয়েছেন। মালিক জানিয়ে দিয়েছেন, এভাবে চলতে থাকলে কারখানা বন্ধ করা ছাড়া উপায় থাকবে না। হাছান আরিফ নামে একজন তার ফেসবুকে স্ট্যাটাসে লিখেছেন, ধনীদের ধন আছে। গরিবের আছে সরকার। মধ্যবিত্তেরে কেউ নেই। আছে শুধু হাহাকার। শুভাশীস নামে এক তরুণ লিখেছেন, নিম্ন আয়ের লোকদের সরকার খাদ্য দিচ্ছে। বেসরকারি সংগঠনও এগিয়ে এসেছে। ধনীদের আছে অগাধ অর্থ। শুধু কাঁদে মধ্যবিত্ত। উবার চালিয়ে সংসার চালাতেন কাজীপাড়ার তৌফিক। তারও আয়-রোজগার বন্ধ। তার পরিবারে এখন দুঃসময়। রাজধানীর আগারগাঁও বাজারের মসজিদের মোয়াজ্জিন আব্বাস উদ্দিন বিভিন্ন বাসায় টিউশনি করতেন। করোনার কারণে তার সব টিউশনি বন্ধ। মসজিদ থেকে যা পান তা দিয়ে সংসার চলে না। এগুলো মধ্যবিত্তদের জীবনের খণ্ড চিত্র। অনেকেই বলেছেন, করোনায় কাজ-কর্ম বন্ধ থাকায় খেটে খাওয়া নিম্ন আয়ের মানুষের দুঃখ-কষ্টের কথা সংবাদমাধ্যমে এলেও মধ্যবিত্তদের বেদনার কথা সেভাবে উঠে আসে না।
অর্থনীতিবিদরা বলেছেন, করোনার প্রভাবে মধ্যবিত্ত সংকটে পড়ায় দেশে বড় সমস্যা তৈরি করবে। ক্ষতিগ্রস্ত মধ্যবিত্তদের জন্য যুক্তরাষ্ট্র,
যুক্তরাজ্যসহ অনেক দেশেই নগদ সহায়তা দেওয়া হলেও আমাদের দেশে এ নিয়ে চিন্তা করা হয় না। তাদের জন্যও আর্থিক সুবিধা দিতে হবে। সরকার মধ্যবিত্তদের জন্য একটি হেলপলাইন বা হটলাইন খুলতে পারে। যাদের সহায়তা দরকার আবেদন করবে। সেখান থেকে যাচাই-বাছাই করে প্রকৃত ক্ষতিগ্রস্তদের সহায়তা দিতে পারে।
অর্থনীতিবিদরা আরও বলছেন, সম্পদশালীদের অনেক সুবিধা আছে। গরিব মানুষের জন্য প্রান্তিকভাবে এক ধরনের ব্যবস্থা আছে। কিন্তু বিকাশমান মধ্যবিত্তরা সবসময় চাপে থাকে। রাজনীতিবিদরা ভোটের কারণে নিম্নবিত্তদের গুরুত্ব দেন। আবার নির্বাচনের টাকা সংগ্রহের জন্য সম্পদশালীদের গুরুত্ব দেন। কিন্তু মধ্যবিত্তদের মূল্যায়ন করা হয় না।
বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের সাবেক মহাপরিচালক কেএএস মুরশিদ সমকালকে বলেন, মধ্যবিত্তরা কারও কাছে হাত পাততে পারে না। তাদের জন্য আলাদা হটলাইন বা সেল গঠন করা যেতে পারে। তাদের নগদ সহায়তা দিলে ভালো। তবে অনুদান না দেওয়া গেলে কম সুদে দীর্ঘ মেয়াদে ঋণ দেওয়ার পরামর্শ দেন তিনি। কেএএস মুরশিদ আরও বলেন, মাসে ৯ হাজার টাকা আয় করেন- এমন শ্রেণির মানুষকে আমাদের দেশে দারিদ্র্যসীমার নিচে ধরা হয়। অন্যদিকে দেশে নিম্ন মধ্যবিত্তের সংখ্যাই বেশি, যাদের মাসিক আয় ২৫ হাজার টাকা। করোনার কারণে এই শ্রেণির রুটি-রোজগারে আঘাত এসেছে বেশি। এতে সমাজে বড় ধরনের অস্থিরতা দেখা দিতে পারে। সরকারি চাকরিতে হয়তো কোনো সমস্যা হবে না। কিন্তু বেসরকারি চাকরিতে যারা আছেন মালিকের আয় না থাকলে নিয়মিত বেতন দেবে না। এতে তারা চাকরি হারাবে। এভাবে মধ্যবিত্তদের অনিশ্চয়তা তৈরি হবে। সামাজিক সুরক্ষার অংশ হিসেবে মধ্যবিত্তদেরও সুযোগ-সুবিধা দিতে হবে। তবে এর জন্য সুবিধাভোগীদের চিহ্নিত করতে হবে।
বিআইডিএসের গবেষণা পরিচালক ডক্টর নাজনীন আহমেদ বলেন, সরকার মধ্যবিত্তদের খাওয়াতে পারবে না। আবার খাদ্য সহায়তার জন্য তারা লাইনেও দাঁড়াতে পারবে না। তাদের নগদ টাকা দিতে হবে। আধুনিক রেশনিংয়ের ব্যবস্থা করতে হবে। প্রত্যেককে কার্ড দিতে হবে। অনলাইনে টাকা পরিশোধ করবে। খাদ্যপণ্য বাসায় পৌঁছে যাবে। এর জন্য নীতিমালা করতে হবে। একই সঙ্গে একটি ডাটাবেজ তৈরি করতে হবে। বিষয়টি সরকারকে নিশ্চিত করতে হবে।
সূত্রঃ সমকাল