অনলাইন ডেস্কঃ
কক্সবাজারে রোহিঙ্গা ক্যাম্পের লোকজনের সাথে বিভিন্ন সংস্থার কর্মকর্তাদের যোগাযোগের জন্যে রোহিঙ্গা ক্যাম্পের ফোন যোগাযোগ ব্যবস্থা সক্রিয় রয়েছে বলে জানিয়েছেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ কে আব্দুল মোমেন।
করোনাভাইরাস সংক্রমণ রোধে নিজেদের মধ্যে এবং দাতা সংস্থাগুলোর সাথে যোগাযোগ অব্যাহত রাখার স্বার্থে রোহিঙ্গা ক্যাম্পে মোবাইল ফোন ও ইন্টারনেট সার্ভিস পুনঃস্থাপনের আহবান জানিয়ে পররাষ্ট্রমন্ত্রীকে গত ২৩ এপ্রিল চিঠি দিয়েছে মার্কিন কংগ্রেসে উভয়কক্ষের শীর্ষস্থানীয় কয়েকজন সিনেটর আর কংগ্রেসম্যান।
ওই চিঠির পরিপ্রেক্ষিতে ড. মোমেন ঢাকা থেকে ফোন সার্ভিস বন্ধ হয়নি জানিয়ে নিয়ে বলেন, করোনা ভাইরাস রোধে বাংলাদেশ সরকারের গৃহীত পদক্ষেপের সবটুকুই বিদ্যমান রয়েছে রোহিঙ্গা ক্যাম্পে। ক্যাম্পের লোকজনের সাথে বিভিন্ন সংস্থার কর্মকর্তাদের যোগাযোগের জন্যে রোহিঙ্গা ক্যাম্পের ফোন সক্রিয় রয়েছে। সার্বিক নিরাপত্তার স্বার্থে ক্যাম্পের অধিবাসীদের কাছে এই মুহূর্তে ইন্টারনেট সার্ভিস ও উচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন ফোনসার্ভিস দেয়া সম্ভব নয় বলে ইউএস সিনেটর-কংগ্রেসম্যানদের জানিয়ে দিচ্ছি।
ওয়াশিংটন ডিসি থেকে যুক্ত স্বাক্ষরের পত্রটি দিয়েছেন যুক্তরাষ্ট্র কংগ্রেসের নিম্নকক্ষ প্রতিনিধি পরিষদে পররাষ্ট্র বিষয়ক কমিটির চেয়ারম্যান কংগ্রেসম্যান (ডেমক্র্যাট-নিউইয়র্ক) ইলিয়ট এঙ্গেল, উচ্চকক্ষ ইউএস সিনেটে পররাষ্ট্র বিষয়ক কমিটির প্রভাবশালী সদস্য ইউএস সিনেটর (ডেমক্র্যাট-নিউজার্সি) বব ম্যানেন্ডেজ, সিনেটে পূর্ব এশিয়া সম্পর্কিত সাব কমিটির প্রভাবশালী সদস্য সিনেটর (ডেমক্র্যাট-ম্যাসেচুসেট্স )এডোয়ার্ড জন মারকি, সিনেটর (ডেমক্র্যাট-কানেকটিকাট) ক্রিস মারফি, কংগ্রেসম্যান (ডেমক্র্যাট-মিশিগান) এন্ডি লেভিন, প্রতিনিধি পরিষদে এশিয়া বিষয়ক পররাষ্ট্র সম্পর্কিত কমিটির চেয়ারম্যান কংগ্রেসম্যান (ডেমক্র্যাট-ক্যালিফোর্নিয়া) এ্যামি বেরা।
পত্রে উল্লেখ করা হয়েছে, ‘করোনাভাইরাসের মহামারি সত্ত্বেও প্রায় ১০ লাখ রোহিঙ্গা উদ্বাস্তুকে আশ্রয় দেয়ার জন্যে বাংলাদেশ সরকার এবং বাংলাদেশের মানুষের প্রতি পুনরায় ধন্যবাদ ও কৃতজ্ঞতা জানাচ্ছি। এটি শুধুমাত্র মহান মানুষের পক্ষেই সম্ভব। সারাবিশ্বে সকল দেশই নিজ নিজ অবস্থান থেকে সর্বোচ্চ পর্যায়ে চেষ্টা চালাচ্ছে করোনা মহামারি নির্মূল এবং দমনের জন্যে, করোনা যাতে সংক্রমিত হতে না পারে সে চেষ্টাও বিরাজমান, তা করার চেষ্টা চলছে সময় অনুযায়ী, প্রাপ্ত বিশ্বাসযোগ্য তথ্যের ভিত্তিতে। বিশেষ করে জনগণকে নিরাপদ রাখতে মেডিকেল ইনফরমেশনের গুরুত্ব অপরিসীম।’
‘রোহিঙ্গা রিফ্যুজি ক্যাম্পে ইন্টারনেট এবং টেলিফোন সার্ভিসে নিষেধাজ্ঞা আরোপের পরিপ্রেক্ষিতে এই মহামারি দমনে সকল উদ্যোগ বাধাগ্রস্ত হচ্ছে বলে আমরা খুবই উদ্বিগ্ন। আমরা আপনার সরকারের প্রতি আহবান জানাচ্ছি মানবাধিকার গ্রুপসমূহের সাথে আলোচনাক্রমে ক্যাম্পের টেলি-যোগাযোগ ব্যবস্থার নিষেধাজ্ঞা উঠিয়ে নেয়ার জন্যে। এটি করা উচিত মানবিক সহযোগিতা এবং যোগাযোগ ব্যবস্থা অব্যাহত রাখার স্বার্থেই। করোনাভাইরাসের দ্রুত সংক্রমণের তথ্য যথাসময়ে কর্তৃপক্ষের গোচরে দেয়া সম্ভব না হলে অথবা বিলম্বিত হলে, রিফ্যুজিদের প্রচন্ড ঝুঁকিতে থাকার শংকা বাড়বে। শুধু তাই নয়, কক্সবাজারের অধিবাসী এবং দাতা সংস্থাগুলোর লোকজনকেও প্রচন্ড ঝুঁকিতে থাকতে হবে’- উল্লেখ করা হয়েছে পত্রে।
ড. মোমেনকে লেখা এই পত্রে আরো উল্লেখ করা হয়েছে, ‘এমন অস্বাভাবিক পরিস্থিতিতে আমাদের সকলকে অবশ্যই পরস্পরের সহযোগী হয়ে কাজ করতে হবে। বিশেষ করে ঠাঁই-ঠিকানাহীন উদ্বাস্তুদের জীবন বাঁচাতে উদারচিত্তে কাজের বিকল্প নেই। এটা আমরা সকলেই নিশ্চিত যে, রোহিঙ্গা সংকটের উৎপত্তি হয়েছে বার্মিজ সামরিক বাহিনীর বর্বরতা থেকে। আমরা আপনার সরকারের প্রতি আহবান জানাচ্ছি যতদ্রুত সম্ভব কক্সবাজার রোহিঙ্গা ক্যাম্পে ইন্টারনেট এবং টেলিফোন সার্ভিস পুনঃস্থাপনের জন্যে।’
কংগ্রেসের পত্রের পরিপ্রেক্ষিতে নিউইয়র্কের আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংগঠক ড. পার্থ ব্যানার্জি এ সংবাদদাতাকে বলেন, শরাণার্থী শিবিরে অনলাইন সার্ভিস এবং ফোর অথবা ফাইভ জি নেটওয়ার্ক প্রদান না করার মধ্যে মানবাধিকার লংঘনের কিছু নেই। এটি নির্ভর করে বাংলাদেশের আর্থ-সামাজিক অবস্থার ওপর। কারণ, বাংলাদেশে বর্তমানে যত মানুষ মোবাইল ফোন ব্যবহার করছেন তার ৮০% হচ্ছেন থ্রি-জি ব্যবহারকারী। অর্থাৎ তাদের সামর্থ্য নেই জি ফোর কিংবা জি-ফাইভ ফোন ব্যবহারের।
তাহলে শরণার্থী শিবিরের জন্যে জি ফোর অথবা ফাইভের টাওয়ার ইন্সটলশেন ফি কে দেবেন? ‘ড. ব্যানার্জি উল্লেখ করেন, ইতিমধ্যেই অনেকে আন্তর্জাতিক আদম পাচারকারী চক্রের যোগসাজশে গভীর সাগরে নৌকা ভাসিয়েছিলেন অনেক নারী-পুরুষ নিয়ে। তারা যে সন্ত্রাসে লিপ্ত হতেন না সে গ্যারান্টি কে দেবে?
নিউইয়র্কের খ্যাতনামা মানবাধিকার এটর্নী অশোক কর্মকার বলেন, ‘আমার বাসায় অতিথি এলে তাকে রোস্ট-পোলাও দিয়ে আপ্যায়ন করবো, নাকি সাদা ভাত আর ডাল-ভাজি দিয়ে করবো সেটি নির্ভর করে আমার সামর্থের ওপর। তাই, কক্সবাজারের রোহিঙ্গা শিবিরে কী ধরনের যোগাযোগ ব্যবস্থা অব্যাহত থাকবে সেটি একান্তভাবেই বাংলাদেশ সরকারের সামর্থ্যরে ওপর নির্ভর করছে। রোহিঙ্গারা অনলাইনের সুবাদে কোন আন্তর্জাতিক সন্ত্রাসী নেটওয়ার্কে জড়িয়ে পড়বে না-এমন নিশ্চয়তা কে দেবে? করোনা পরিস্থিতির অজুহাত দেখিয়ে ক্যাম্পে অনলাইন সার্ভিস এবং উচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন টেলিফোন-টাওয়ার পুনস্থাপনের দাবিটি একেবা্রেই অবাস্তব বলেই মনে করেন অভিবাসী আর রিফ্যুজি সম্পর্কিত অভিজ্ঞ এই এটর্নি।
কয়েক মাস আগে কক্সবাজারের রোহিঙ্গা ক্যাম্প পরিদর্শন করে নিউইয়র্কে ফেরা ডেমক্র্যাটিক পার্টির ডিস্ট্রিক্ট লিডার এবং ইউএস সুপ্রিম কোর্টের খ্যাতনামা এটর্নি মঈন চৌধুরী বলেন, মনে হয়েছে শরণার্থীরা আরাম-আয়েসেই রয়েছেন। কারণ, তাদের কোন ধরনের কাজ-কর্ম করতে হচ্ছে না। খাবার-দাবার ঠিকমত পাচ্ছেন। এটর্নী মঈন উল্লেখ করেন, কাজ করতে সক্ষম শরনার্থীদের জাতীয় উন্নয়ন কর্মকাণ্ডে নিয়োগ করা দরকার। তাহলে উভয়েরই লাভ। এক্ষেত্রে ওদেরকে বিশেষ নজরদারিতে রাখার প্রয়োজন হবে।
পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. মোমেন বলেন, ‘করোনা মহামারীর পরিপ্রেক্ষিতে খুবই সংকট অতিবাহিত করছে বাংলাদেশসহ গোটাবিশ্ব। তাই এমন সময়ে যুক্তরাষ্ট্রসহ আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের প্রতি বীনিত অনুরোধ রাখছি রোহিঙ্গা ইস্যুর স্থায়ী নিস্পত্তির জন্যে যথাযথ পদক্ষেপ গ্রহণ করতে।’
চিঠির পরিপ্রেক্ষিতে পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. মোমেন মঙ্গলবার পাঠানো জবাবে উল্লেখ করেছেন, ক্যাম্প-এলাকায় ইন্টারনেট যোগাযোগ এবং টেলি-কমিউনিকেশন নেটওয়ার্ক চালু রয়েছে। দৈনন্দিন যোগাযোগ অব্যাহত রয়েছে। ক্যাম্প-এলাকার সকল মানুষ সেল ফোন ব্যবহার করছেন।
এ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘আমি বহুবছর যুক্তরাষ্ট্রে বসবাস করেছি। কখনো দেখিনি বা শুনিনি যে ডিটেনশন সেন্টারের লোকজন সেলফোন ব্যবহার করতে পারে। এমনকি কালেক্ট কল অথবা প্রি-পেইড কলের সময়েও কর্তৃপক্ষের মনিটরিং চলমান থাকে। কক্সবাজারের রোহিঙ্গা ক্যাম্পের লোকজন যে কোন সময় যে কাউকে ফোন করতে পারেন কোন ধরনের মনিটরিং ছাড়াই।
মন্ত্রী বলেন, জাতিসংঘের কর্মকর্তা এবং দাতা সংস্থাসমূহের কর্মকর্তাসহ বাংলাদেশের তদারকি কর্মকর্তারা কয়েক মিনিট দূরত্বে ক্যাম্পের বাইরে বিলাসবহুল হোটেলে বসবাস করছেন। গোটাবিশ্বের সাথে তাদের সবধরনের যোগাযোগ ব্যবস্থায় ন্যূনতম বাধা নেই।
পররাষ্ট্রমন্ত্রী জানান, ক্যাম্পে ফোর-জি ফ্যাসিলিটি প্রদানের জন্যে টেলিফোন ব্যবসার সাথে জড়িতরা লবিং চালাচ্ছেন। কিন্তু সেটি কেবলমাত্র মেট্রপলিটন সিটিসমূহে চালু রয়েছে। ক্যাম্পে সেই নেটওয়ার্ক বিস্তৃত করলে অধিবাসীদের আই-ফোনসহ সর্বাধুনিক প্রযুক্তির সেলফোন ক্রয় করতে হবে। তবে বিদ্যমান মোবাইল ফোনে (টু-জি, থ্রি-জি) সকলেই তাদের মৌলিক যোগাযোগ করতে সক্ষম হচ্ছেন।
তিনি বলেন, ক্যাম্পের ফোর-জি ফ্যাসিলিটি প্রত্যাহার করা হয়েছে সামগ্রিক নিরাপত্তার কারণে। অপকর্ম বন্ধ, শিশু ও নারী পাচার রোধ, বেআইনিভাবে মাদক ব্যবসা ঠেকাতে, ধর্মীয় বিদ্বেষমূলক অপপ্রচারণাসহ মানুষের মধ্যে ঘৃণার সৃষ্টি রোধকল্পে, নীল ছবির ব্যবসা রোধে এবং আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রাখার স্বার্থে এ ধরনের পদক্ষেপ নিতে হয়েছে। এজন্যে করোনা পরিস্থিতি মোকাবেলায় ন্যূনতম সমস্যা হচ্ছে বলে কেউই মনে করছি না। কারণ, ক্যাম্পের অনেকের কাছে মোবাইল ফোন রয়েছে।
সূত্রঃ সমকাল