অনলাইন ডেস্ক
>> প্রকৃত ক্ষতিগ্রস্তদের প্যাকেজে অন্তর্ভু্ক্ত করতে হবে
>> ব্যাংকগুলোর প্রতিবন্ধকতায় সহায়তা দেবে অর্থ মন্ত্রণালয়
>> প্রণোদনা বাস্তবায়নে থাকবে তিন স্তরের মনিটরিং সেল
বৈশ্বিক মহামারি করোনাভাইরাসের কারণে স্থবির হয়ে পড়েছে গোটা বিশ্ব। দেশে দেশে চলছে লকডাউন। গণপরিবহন বন্ধ, বন্ধ আকাশপথ। শিল্পপ্রতিষ্ঠানের উৎপাদন বন্ধ, ধস নেমেছে ব্যবসা-বাণিজ্যে। সারাবিশ্বের মতো ভয়াবহ সঙ্কটের মুখে পড়েছে দেশের সার্বিক অর্থনীতিও।
করোনার এমন পরিস্থিতিতে অর্থনীতির চাকা সচল রাখতে ক্ষতিগ্রস্ত ব্যবসায়ীসহ সব খাতের মানুষের জন্য প্রায় এক লাখ কোটি টাকার প্রণোদনা প্যাকেজ ঘোষণা করেছে সরকার। এ প্যাকেজ বাস্তবায়নে ইতোমধ্যে প্রজ্ঞাপনও প্রকাশ করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। কিন্তু প্রজ্ঞাপনের জটিলতা এবং বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর নিজস্ব কর্মপন্থা তৈরি না হওয়ায় ক্ষতিগ্রস্ত উদ্যোক্তারা প্রণোদনার টাকা নিতে পারছেন না। এ অবস্থায় সৃষ্ট জটিলতা দ্রুত নিরসন করে সুষ্ঠুভাবে প্যাকেজ বাস্তবায়নের নির্দেশ দিয়েছে অর্থ মন্ত্রণালয়।
অর্থ মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা যায়, ঘোষিত প্যাকেজের সুষ্ঠু বাস্তবায়নে সঠিক কর্মপরিকল্পনা প্রণয়ন, সম্ভাব্য ক্ষয়-ক্ষতি নিরূপণ ও বাস্তবায়নে কোনো ধরনের প্রতিবন্ধকতা থাকলে তা নিরসনে সুপারিশ প্রণয়নের জন্য রাষ্ট্র মালিকানাধীন ব্যাংক এবং আর্থিক প্রতিষ্ঠানের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) ও সিইওদের সঙ্গে বৈঠক করেছে মন্ত্রণালয়। অর্থ মন্ত্রণালয়ের সভাকক্ষে আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের সিনিয়র সচিব মো. আসাদুল ইসলামের সভাপতিত্বে বৃহস্পতিবার (৭ মে) অনুষ্ঠিত ভার্চুয়াল সভা থেকে এমন নির্দেশনা দেয়া হয়।
সভায় অর্থ মন্ত্রণালয়ের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা ছাড়াও সোনালী, জনতা, অগ্রণী, রূপালী, বেসিক ব্যাংকসহ সব রাষ্ট্রীয় ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের এমডিরা ভার্চুয়ালি উপস্থিত ছিলেন। সভায় উপস্থিত একাধিক ব্যাংকের এমডি ও অর্থ মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে এসব তথ্য জানা গেছে।
বৈঠকে উপস্থিত আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের ঊর্ধ্বতন এক কর্মকর্তা জাগো নিউজকে বলেন, সিনিয়র সচিব মো. আসাদুল ইসলাম রাষ্ট্রীয় ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের এমডি ও সিইওদের উদ্দেশ্যে বলেন, করোনা পরিস্থিতিতে সৃষ্ট আর্থিক ক্ষতি কাটিয়ে উঠতে প্রায় এক লাখ কোটি টাকার প্রণোদনা প্যাকেজ ঘোষণা করা হয়েছে। প্রণোদনা প্যাকেজ বাস্তবায়নে বাংলাদেশ ব্যাংক গাইডলাইনও প্রকাশ করেছে। কিন্তু বাস্তবায়ন এখনও শুরু করা সম্ভাব হয়নি। এটা যেন সঠিকভাবে এবং যত দ্রুত সম্ভব বাস্তবায়ন তথা প্যাকেজের ঋণ বিতরণ শুরু করা যায় সে ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। এজন্য দ্রুত প্রস্তুতিও গ্রহণ করতে হবে।
তিনি আরও বলেন, এমনিতেই গত দেড়-দুই মাস করোনার কারণে দেশের ব্যাংক খাত অনেক লস করেছে। এ পরিস্থিতিতে এ ধরনের প্যাকেজ বাস্তবায়ন ব্যাংক খাতের জন্য বড় চ্যালেঞ্জ। তারপরও এ সংকটকালে এটাকে চ্যালেঞ্জ হিসেবে গ্রহণ করেই আমাদের বাস্তবায়ন করতে হবে। পাশাপাশি এ প্যাকেজের অর্থ কোনোভাবেই যাতে মিসইউজ না হয় সে বিষয়েও কঠোরভাবে দায়িত্ব পালনের নির্দেশ দেন তিনি।
প্যাকেজের অর্থ শুধু সোনালী কিংবা রূপালি ব্যাংক নয় বরং সব ব্যাংকের মাধ্যমে বিতরণের জন্য বাংলাদেশ ব্যাংককে প্রয়োজনীয় উদ্যোগ নিতে বলেছেন তিনি। সব ব্যাংকের মাধ্যমে যদি ঋণ বিতরণ করা হয় তাহেল চাপ কিছুটা কমবে। এছাড়া প্রকৃত ক্ষতিগ্রস্তদেরই এ প্যাকেজের অর্থ দেয়ার জন্যও বলা হয়েছে। এজন্য বাংলাদেশ ব্যাংক যেসব গাইড লাইন দিয়েছে তা ফলো করতে বলেন সিনিয়র সচিব।
বৈঠকের বিষয়ে জানতে চাইলে সোনালী ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) ও প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) আতাউর রহমান প্রধান বলেন, বৈঠকে মূলত সঠিকভাবে প্যাকেজ বাস্তবায়নের কর্মপরিকল্পনা নিয়ে আলোচনা হয়েছে। এ প্যাকেজ বাস্তবায়নে যদি ব্যাংকগুলো কোনো প্রতিবন্ধকতার মুখে পড়ে তাহলে সেগুলো সমাধানেরও আশ্বাস দেয়া হয়েছে।
এদিকে ব্যবসায়ীদের অভিযোগ, করোনার ভয়াল পরিস্থিতির মধ্যে ব্যবসায় টিকে থাকতে প্রণোদনার ঘোষণা দিয়েছে সরকার। তবে আমাদের পর্যায়ে তা পাওয়ার ক্ষেত্রে নানা ধরনের জটিলতা তৈরি হয়েছে। নথি ও আইনি জটিলতায় অনেক ক্ষুদ্র উদ্যোক্তা এ সুবিধার বাইরে থাকছেন। আবার নীতিনির্ধারণী পর্যায় থেকে আসা নির্দেশনার ক্ষেত্রে সমন্বয়ের ঘাটতিও দেখা যাচ্ছে। এ ধরনের নানামুখী সমস্যা সমাধান করে দ্রুত সরকার ঘোষিত প্রণোদনার অর্থ ছাড়ের জন্য ব্যাংকগুলোকে আরও বেশি উদ্যোগী হওয়ার আহ্বান জানান তারা।
গতকাল বুধবার রাজধানীর মতিঝিলে ফেডারেশন ভবনে ‘সরকার ঘোষিত প্রণোদনা প্যাকেজ বাস্তবায়ন’ শীর্ষক সভার আয়োজন করে ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন এফবিসিসিআই। সভায় সভাপতিত্ব করেন সংগঠনের সভাপতি শেখ ফজলে ফাহিম। আলোচনায় বর্তমান ও সাবেক নেতাদের পাশাপাশি অর্থনীতিবিদরা ডিজিটাল যোগাযোগের মাধ্যম ব্যবহার করে তাদের মতামত তুলে ধরেন।
সভায় বক্তব্য রাখেন এফবিসিসিআইয়ের সাবেক সভাপতি কাজী আকরাম উদ্দিন আহমেদ, সফিউল ইসলাম মহিউদ্দিন, আবদুল মাতলুব আহমাদ, ওয়ার্ল্ড ব্যাংক গ্রুপের সাবেক সিনিয়র ইকোনমিস্ট মাশরুর রিয়াজ প্রমুখ।
সভায় ব্যবসায়ীরা বলেন, নোভেল করোনাভাইরাসের কারণে আর্থিক ক্ষতি কাটিয়ে উঠতে সরকার সম্প্রতি প্রায় এক লাখ কোটি টাকার প্রণোদনা প্যাকেজ ঘোষণা করেছে। তবে নানা নিয়মকানুনের ফাঁদে পড়ে অনেক উদ্যোক্তাই ওই প্রণোদনার সুবিধা নিতে পারছেন না। ব্যবসায়ীরা মরে যাবে, আর ব্যাংকগুলো এখনও মুনাফার চিন্তা করবে— এই মনোভাব থেকে বেরিয়ে আসতে হবে। সব প্রক্রিয়া শেষ করে দ্রুত এ প্যাকেজ বাস্তবায়নের আহ্বান জানান তারা।
করোনায় ক্ষতিগ্রস্ত ব্যবসায়ীসহ বিভিন্ন শ্রেণির মানুষের জন্য প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা প্রায় এক লাখ কোটি টাকার প্রণোদনা প্যাকেজ ঘোষণা করেন। এর মধ্যে শিল্প ঋণের জন্য ৩০ হাজার কোটি টাকা, ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্প খাতের জন্য ২০ হাজার কোটি টাকা, রফতানিমুখী শিল্পের শ্রমিক-কর্মচারীদের বেতন-ভাতা পরিশোধে পাঁচ হাজার কোটি টাকার প্রণোদনা প্যাকেজ ঘোষণা করা হয়। পাশাপাশি নিম্ন আয়ের মানুষ ও কৃষকের জন্য পাঁচ হাজার কোটি টাকা, রফতানি উন্নয়ন ফান্ড গঠনে ১২ হাজার ৫০০ কোটি টাকা, প্রিশিপমেন্ট ঋণে পাঁচ হাজার কোটি টাকা, গরিব মানুষের নগদ সহায়তা বাবদ ৭৬১ কোটি টাকা, অতিরিক্ত ৫০ লাখ পরিবারকে ১০ টাকা কেজিতে চাল দেয়ার জন্য ৮৭৫ কোটি টাকা। এছাড়া করোনা মোকাবিলায় স্বাস্থ্য খাতে বাজেটের অতিরিক্ত ৪০০ কোটি টাকা বরাদ্দ দেয়া হয়।
যদিও এক লাখ কোটি টাকার প্রণোদনা প্যাকেজের অধিকাংশই সংস্থান হবে দেশের ব্যাংক ব্যবস্থা থেকে। এরপরও প্রণোদনা প্যাকেজের ঋণে সুদ ভুর্তকি বাবদ প্রায় তিন হাজার কোটি টাকা এবং রফতানিমুখী শিল্পের শ্রমিক-কর্মচারীদের বেতন-ভাতা পরিশোধে পাঁচ হাজার কোটি টাকার সংস্থান বাজেট থেকে হবে। গরিব মানুষের নগদ সহায়তার ৭৬১ কোটি টাকা, অতিরিক্ত ৫০ লাখ পরিবারকে ১০ টাকা কেজিতে চাল দেয়ার জন্য ৮৭৫ কোটি টাকা, স্বাস্থ্য খাতের জন্য অতিরিক্ত ২৫০ কোটি টাকাসহ বেশকিছু টাকা বাজেট থেকে সংস্থান হবে।
এ প্রণোদনা প্যাকেজ বাস্তবায়ন ঠিক মতো হচ্ছে কি-না, তা দেখতে তিন স্তরে তদারকি হবে। প্যাকেজ বাস্তবায়নে বাংলাদেশ ব্যাংকের একটি মনিটরিং টিম গঠন করা হবে। পাশাপাশি রাষ্ট্রায়ত্ত ও বেসরকারি বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর প্রতিটির ব্যবস্থাপনা পরিচালকদের (এমডি) নেতৃত্বে আলাদা আলাদা মনিটরিং সেল গঠন করা হবে। প্যাকেজে কোনোভাবেই যাতে অনিয়ম না হয় সে বিষয়ে কঠোর মনিটরিং করবে সেলগুলো।
এ দুটি সেলের কার্যক্রম তদারকি করবে অর্থ মন্ত্রণালয়ের মনিটরিং সেল। মন্ত্রণালয়ের অর্থ বিভাগ ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগ যৌথভাবে এ তদারকির কাজ করবে। অর্থাৎ ক্ষতিগ্রস্ত অর্থনীতি পুনরুদ্ধারে সরকারের প্রণোদনা বাস্তবায়নে তিন স্তরে তদারকি হবে। মনিটরিংয়ের মূল কাজ হবে বিভিন্ন প্রণোদনা প্যাকেজ বাস্তবায়ন ঠিক মতো হচ্ছে কি-না, তা পর্যবেক্ষণ করা। পাশাপাশি প্যাকেজের অর্থ কীভাবে ব্যবহার হচ্ছে, যাদের জন্য প্যাকেজ করা হয়েছে তারা সহায়তা পাচ্ছেন কি-না, কোনো ঋণখেলাপি ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান এর থেকে কোনো ধরনের সহায়তা পাচ্ছে কি-না, তাও খতিয়ে দেখা হবে। অর্থ মন্ত্রণালয় সূত্রে এসব তথ্য জানা গেছে।
সূত্রঃ জাগোনিউজ