অনলাইন ডেস্কঃ
বাংলাদেশের নিম্ন আদালতের নতুন যুগে প্রবেশের দুই দিনে প্রায় দেড়শ’র মতো আবেদনের ভার্চুয়াল শুনানি নিয়ে ১৪৪ আসামির জামিন হয়েছে।
মঙ্গলবার রাতে সুপ্রিম কোর্টের মুখপাত্র ও হাই কোর্টের বিশেষ কর্মকর্তা মোহাম্মদ সাইফুর রহমান বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে এই তথ্য জানিয়েছেন।
কোভিড-১৯ মহামারীর কারণে সাধারণ ছুটির মধ্যে তথ্যপ্রযুক্তি ব্যবহার করে আদালতের বিচারকাজ চালানোর অধ্যাদেশ জারির পর ‘প্র্যাকটিস ডাইরেকশন’ জারি করেন প্রধান বিচারপতি সৈয়দ মাহমুদ হোসেন।
তার ভিত্তিতে শুরু হয় নতুন ধরনের আদালত কার্যক্রম। যেখানে প্রচলিত এজলাসে বসেননি বিচারক। আর আইনজীবীরা গাউন ছাড়া কালো কোট পরে বিভিন্ন ফৌজদারি মামলার অভিযুক্ত, আসামিদের পক্ষে জামিন শুনানি করেছেন তথ্য প্রযুক্তি ব্যবহার করে।
গত রোববার সুপ্রিম কোর্ট থেকে তিনটি আলাদা ‘প্র্যাকটিস’ নির্দেশনার পাশাপাশি ভার্চুয়াল কোর্ট পরিচালনা সংক্রান্ত বিজ্ঞপ্তি জারি করা হয়।
এরপর সোমবার থেকে নিম্ন আদালতে জামিন শুনানি শুরু হয়। প্রথম কুমিল্লা জেলা ও দায়রা জজ এক আসামিকে জামিন দেন।
মঙ্গলবার ঢাকা মহানগর দায়রা জজ আদালত ৪টি মামলার শুনানি নিয়ে ৪ জনকেই জামিন দিয়েছেন। আর ঢাকার মুখ্য মহানগর হাকিম (সিএমএম) আদালত ১৯ মামলায় ৩৪ জনকে জামিন দিয়েছেন।
এছাড়া নোয়াখালীর মুখ্য বিচারিক হাকিমের আদালতে (সিজেএম) ২০টি জামিন আবেদনের মধ্যে ১০টির শুনানি করে ৪ জনকে জামিন দেওয়া হয়েছে।
কুমিল্লার জেলা ও দায়রা জজ আদালত ৭টি মামলার মধ্যে দুটির শুনানি করে একজনকে জামিন দিয়েছে। আরেক আসামির জামিন আবেদন খারিজ করা হয়েছে।
ফেনীর মুখ্য বিচারিক হাকিম (সিজেএম) আদালতে ২২টি আবেদনের মধ্যে ৩টির শুনানি শেষে ৬ জনকে জামিন দেওয়া হয়েছে।
ব্রাহ্মণবাড়িয়ার সিজেএম আদালতে মোট ২০০ আবেদনের মধ্যে দুটির শুনানি শেষে ২ আসামির জামিন হয়েছে।
দিনাজপুরে জেলা ও দায়রা জজ আদালত ৮টি মামলায় ৬ আসামিকে জামিন দিয়েছে। দুটি আবেদন খারিজ করা হয়েছে।
দিনাজপুর মুখ্য বিচারিক হাকিম (সিজেএম) আদালতে মোট আবেদন পড়ে ৮০টি। এর মধ্যে ২৬টি আবেদনের শুনানি শেষে ২৪ আসামির জামিন হয়েছে।
ঠাকুরগাঁও মুখ্য বিচারিক হাকিম (সিজেএম) একজন আসামির জামিন দিয়েছেন। খারিজ করা হয়েছে ৩টি আবেদন।
সিলেট জেলা ও দায়রা জজ আদালতে ৫টি আবেদনের শুনানি নিয়ে ৩টি খারিজ করা হয়েছে। দুই মামলায় ২ আসামিকে জামিন দিয়েছে আদালত। সিলেট মহানগর দায়রা জজ আদালত ৮ আবেদনের মধ্যে ২টি মঞ্জুর করে ৮ আসামিকে জামিন দিয়েছে।
সিলেট মুখ্য বিচারিক হাকিম (সিজেএম) আদালতে ৯টির শুনানি নিয়ে ৮টিতে ১৫ জনকে জামিন দেওয়া হয়।
সিলেট মুখ্য মহানগর হাকিম (সিএমএম) আদালত ১৩টি আবেদনের শুনানি নিয়ে ৭টি মামলার ৭ আসামির জামিন মঞ্জুর করে। খারিজ করা হয়েছে ৬টি আবেদন।
এছাড়াও সিলেট শিশু আদালতে একটি আবেদনের শুনানি করে এক শিশুকে জামিন দিয়েছে।
সুনামগঞ্জ মুখ্য বিচারিক হাকিম (সিজেএম) আদালতে ৮টি আবেদনের শুনানি নিয়ে ৫টি আবেদন মঞ্জুর করে ৫ আসামিকে জামিন দিয়েছে। তিনটি আবেদন খারিজ করা হয়েছে।
নেত্রকোনার জেলা ও দায়রা জজ আদালত ৪টি আবেদনের শুনানি নিয়ে ৪ জনকেই জামিন দিয়েছে। নেত্রকোনা মুখ্য বিচারিক হাকিম (সিজেএম) তিনটি আবেদনের শুনানি নিয়ে ৪ আসামিকে জামিন দিয়েছেন।
মাগুরা মুখ্য বিচারিক হাকিম (সিজেএম) আদালত ১৫টি আবেদনের মধ্যে ১৩টি মঞ্জুর করে ১৮ আসামিকে জামিন দিয়েছে। দুটি আবেদন খারিজ খারিজ করা হয়েছে।
সুপ্রিম কোর্টের মুখপাত্র মোহাম্মদ সাইফুর রহমান জানিয়েছেন, হাই কোর্টে বিচারপতি জাহাঙ্গীর হোসেনের ভার্চুয়াল আদালতে সোম-মঙ্গলবার মিলিয়ে ১৫০টি জামিন আবেদন জমা পড়েছে।
ঢাকার আইনজীবীদের মধ্যে মিশ্র প্রতিক্রিয়া
পরিকল্পনা থাকলেও অনেকটা প্রস্তুতিহীনভাবে ভার্চুয়াল আদালত চালু হওয়ায় আইনজীবীদের মধ্যে মিশ্র প্রতিক্রিয়া পাওয়া যাচ্ছে।
কয়েকটি জেলায় আইনজীবীরা ভার্চুয়াল আদালত বর্জনের সিদ্ধান্তও নিয়েছেন। তারা যুক্তি দেখিয়েছেন, এই ধরনের কাজ শুরুর আগে তাদের কোনো প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা হয়নি।
দেশের বৃহত্তম ঢাকা বারের আইনজীবীদের মধ্যেও মিশ্র প্রতিক্রিয়া দেখা গেছে।
তারা বলেছেন, শুনানি ভার্চুয়ালি হলেও ওকালতনামা, জামিননামা, আদেশ সংগ্রহ করতে আইনজীবীদের আদালতপাড়ায় আসতেই হচ্ছে। ফলে মূল উদ্দেশ্যই পূরণ হচ্ছে না।
তারা বলেন, আরও সমস্যা হবে জামিন দেওয়ার পর। কেননা জামিননামা (বেইল বন্ড) ও মুক্তির আদেশের অনুলিপি স্ক্যান করে কারাগারে পাঠানো হবে। সেখানে দুর্নীতি করে আসামির নাম বদলে দেওয়ার সুযোগ থেকে যায়।
আবার ওকালত নামা, জামিন আবেদন, জামিননামায় দেওয়া কোর্ট ফি কাজ শেষে তুলে ফেলে আবারও ব্যবহারের আশঙ্কাও করছেন কেউ কেউ, যাতে সরকার রাজস্ব হারাবে।
পাশাপাশি প্রবীণ অনেক আইনজীবীর তথ্য প্রযুক্তি ব্যবহারে অনভ্যস্ততা এবং প্রশিক্ষণ না পাওয়ার কথাও বলছেন প্রায় সবাই।
আইনজীবী পারভেজ হাসেম বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “এতে বিচারপ্রার্থী বা আইনজীবী কেউ লাভবান হবেন না। কেননা এটি আসলে অ্যানালগ ও ডিজিটালের মাঝামাঝি একটা কিছু।”
সবার সামনে শুনানি না হওয়ায় দুর্নীতি সুযোগ তৈরি হবে বলেও মনে করেন তিনি।
“সাধারণ আইনজীবীদের বঞ্চিত করে দলীয় আইনজীবীরা প্রাধান্য পাওয়ার সুযোগ আরও বাড়বে। কেননা যেহেতু প্রকাশ্যে হিয়ারিং হবে না। সেহেতু ট্রান্সপারেন্সি থাকবে না।”
আরেক আইনজীবী দুলাল মিত্র বলেন, “সামাজিক দায়বদ্ধতা, নৈতিকতা না বাড়াতে পারলে সমস্ত উদ্যোগই হবে ‘সকলি গরলি ভেল’।”
ফৌজদারি মামলায় অভিজ্ঞ আইনজীবী আমিনুল গণী টিটো কিছু প্রশ্নের উত্তর খুঁজছেন।
“রিমান্ডসহ জামিনের আবেদনের কীভাবে শুনানি হবে? আসামি কোথায় থাকবে- কাঠগড়ায় না হাজতখানায়? ফৌজদারি আইনে আসামির অনুপস্থিতিতে শুনানির সুযোগ কোথায়? আত্মসমর্পণসহ জামিনের পদ্ধতি কী?
“(আবেদনের) সিরিয়াল নিশ্চিত কী করে হবে? দলীয় আইনজীবী নেতা ও সাধারণ আইনজীবী সমবিবেচনায় শুনানির সুযোগ পাবে কি না?”
এদিকে মঙ্গলবার ভার্চুয়ালি শুনানি গ্রহণকারী ঢাকার একজন মহানগর হাকিম বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “এ প্রক্রিয়াটি শুরু করায় বেশ ভালো হল। ভবিষ্যতে এই প্রক্রিয়া খুব কাজে আসবে।”
রাজনৈতিক অস্থিরতার সময়ে কিংবা নিরাপত্তার প্রশ্নে গুরুত্বপূর্ণ বন্দি কিংবা বিপজ্জনক আসামিকে এজলাসে হাজির না করে এখন ভার্চুয়ালি বিচার করা যাবে বলে মনে করেন তিনি।
সূত্রঃ বিডিনিউজ