অনলাইন ডেস্কঃ
করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাবের পর বিশ্বব্যাপী স্বাস্থ্য ব্যবস্থার নিদারুণ দুর্বলতা ফুটে উঠেছে। প্রতিদিন লাখ লাখ মানুষ সংক্রমিত হচ্ছে। যথাযথ চিকিৎসা পাচ্ছে না মানুষ। হাসপাতালে চিকিৎসা না পেয়ে বাসাতেই প্রাণ হারাতে হচ্ছে। এ পর্যন্ত বিশ্বে মারা গেছে চার লাখ মানুষ। বাংলাদেশে ৯৩০। এ অবস্থায় বিশ্বজুড়ে আলোচনার মূলে রয়েছে স্বাস্থ্য খাতের উন্নয়ন। বাংলাদেশেও সাধারণ মানুষ থেকে শুরু করে বিশেষজ্ঞ সবাই একই কথা বলছেন। কিন্তু স্বাস্থ্য ব্যবস্থার উন্নয়নে আসন্ন বাজেটে বিশেষ গুরুত্ব দেখা যাচ্ছে না। আগামী অর্থবছরের বাজেটেও স্বাস্থ্য খাতে গতানুগতিক বরাদ্দ রাখার প্রস্তাব করা হয়েছে। অর্থ মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, আগামী ২০২০-২১ অর্থবছরের বাজেটে স্বাস্থ্য খাতে ২৯ হাজার ২৪৬ কোটি টাকা বরাদ্দ প্রস্তাব করতে যাচ্ছেন অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল, যা প্রস্তাবিত বাজেটের ৫ দশমিক ১৪ শতাংশ।
করোনাভাইরাসের আক্রমণে দেশের স্বাস্থ্য ব্যবস্থা টালমাটাল হলেও এ খাতে বরাদ্দ খুব বেশি বাড়ানো হয়নি। গত ২০১৮-১৯ অর্থবছরে বাজেটে স্বাস্থ্য খাতে বরাদ্দ ছিল ১৮ হাজার ৬৯৫ কোটি টাকা। চলতি ২০১৯-২০ অর্থবছরে স্বাস্থ্য খাতের বরাদ্দ আগের বছরের তুলনায় সাত হাজার ৩৭ কোটি টাকা বাড়িয়ে মূল বাজেটে ২৫ হাজার ৭৩২ কোটি টাকা করা হয়। পরে যদিও সংশোধিত বাজেটে কমিয়ে ২৩ হাজার ৬৯২ কোটি বরাদ্দ রেখেছে সরকার। কিন্তু আগামী অর্থবছরের বাজেটে স্বাস্থ্য খাতে বরাদ্দ মূল বাজেটের তুলনায় মাত্র তিন হাজার ৫১৪ কোটি টাকা বেশি প্রস্তাব করা হচ্ছে। আর সংশোধিত বাজেটের তুলনায় পাঁচ হাজার ৫৫৪ কোটি টাকা বেশি। এই বৃদ্ধির পরিমাণ চলতি অর্থবছরের তুলনায় বেশ কম। বাজেটের অংশ হিসেবে বরাদ্দ সামান্য বেড়েছে। চলতি অর্থবছরে বরাদ্দ বাজেটের ৪ দশমিক ৫২ শতাংশ, যা আগামী অর্থবছরে ৫ দশমিক ১৪ শতাংশ করা হয়েছে। যদিও করোনা পরিস্থিতিতে এই বরাদ্দ পর্যাপ্ত নয় বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।
বাজেট প্রণয়নের সঙ্গে সংশ্নিষ্ট এক কর্মকর্তা নাম না প্রকাশের শর্তে সমকালকে জানান, বাস্তবায়ন দক্ষতার অভাবে বাজেটে বেশি বরাদ্দ রাখা হয়নি। কারণ প্রতি বছর স্বাস্থ্য খাতে যে বরাদ্দ দেওয়া হয়, তা খরচ হয় না। কিন্তু বিশ্নেষকরা বলছেন, অন্যান্য বছরের সঙ্গে এ বছরের তুলনা করা ঠিক হবে না। ইতোমধ্যে স্বাস্থ্য খাতে কয়েক হাজার জনবল নিয়োগ করা হয়েছে। আরও জনবল নিয়োগ প্রক্রিয়ায় আছে। সারাদেশে স্বাস্থ্য অবকাঠামো খাতে প্রচুর ব্যয় করতে হবে। তাছাড়া এবার শুধু স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় নয়, সব মন্ত্রণালয় জনস্বাস্থ্য বিষয়ে কমবেশি কাজ করছে। ফলে আসন্ন বাজেটে স্বাস্থ্য খাতে বেশি বরাদ্দ দিলে তা ব্যয় করা অসম্ভব হতো না।
করোনাভাইরাসের কারণে দেশে স্বাস্থ্য ব্যবস্থা ভেঙে পড়েছে। সাধারণ রোগের চিকিৎসাও পাচ্ছেন না নাগরিকরা। অপর্যাপ্ত আইসিইউ সুবিধা, স্বাস্থ্য পরীক্ষার সীমাবদ্ধতা, চিকিৎসক, স্বাস্থ্যকর্মীর সংকট, দক্ষতার অভাবসহ জনস্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনার ব্যাপক দুর্বলতা ফুটে উঠেছে। অন্যদিকে অর্থনীতি ও সামাজিক ক্ষেত্রে এর ব্যাপক প্রভাব পড়েছে। অনেক মানুষ বেকার হয়েছেন। নতুন কর্মসংস্থান হচ্ছে না। আবার শিল্পকারখানা বন্ধ থাকায় উৎপাদন ও সরবরাহ ব্যাহত হচ্ছে। এ অবস্থায় স্বাস্থ্য, অর্থনীতি পুনরুদ্ধার, কর্মসংস্থান সৃষ্টিতে বাজেটে উদ্যোগ নেওয়ার তাগিদ দিচ্ছেন অর্থনীতিবিদরা।
গবেষণা সংস্থা সিডিপি বলেছে, করোনাভাইরাস ও এর প্রভাব মোকাবিলাই হওয়া উচিত আসন্ন বাজেটের প্রধান লক্ষ্য। নতুবা দারিদ্র্য, বৈষম্য আরও বেড়ে যাবে। অর্থনীতিবিদ পিআরআইয়ের নির্বাহী পরিচালক আহসান এইচ মনসুর সম্প্রতি সমকালকে বলেন, আগামী বাজেটে অপ্রয়োজনীয় ব্যয় কমিয়ে স্বাস্থ্য ব্যবস্থার উন্নয়নে জোর দিতে হবে। এর পরই শিক্ষা, সামাজিক নিরাপত্তা খাতে মনোযোগ থাকতে হবে। যদিও ইতোমধ্যে সরকার অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড গতিশীল রাখতে কারখানার শ্রমিকদের বেতন দেওয়া, চলতি মূলধন সরবরাহ করাসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে ঋণ প্রণোদনা প্যাকেজ ঘোষণা করেছে। দিয়েছে কিছু নীতি সহায়তা। এ ছাড়া বেকার ও দুস্থদের সহায়তায় ত্রাণ ও নগদ সহায়তা দিচ্ছে সরকার। এর পরও আগামী বাজেটে এ বিষয়ে উদ্যোগ থাকা দরকার বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা।
প্রতি বছরের মতো গতকাল সোমবার রাজধানী ঢাকায় এক সংবাদ সম্মেলনের মাধ্যমে বাংলাদেশ অর্থনীতি সমিতির সভাপতি অধ্যাপক আবুল বারকাত বিকল্প বাজেট পেশ করেন। এতে তিনি বলেন, স্বাস্থ্য খাতে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দিয়ে আগামী অর্থবছরের বাজেট প্রণয়ন করতে হবে। তিনি এ খাতে ৪০ হাজার কোটি টাকা বরাদ্দ রাখার প্রস্তাব করে বলেন, করোনা মোকাবিলায় গ্রাম পর্যায়সহ দেশের ৮২ ভাগ মানুষের কাছে স্বাস্থ্যসেবা পৌঁছায়নি। এ মুহূর্তে প্রয়োজন শক্তিশালী স্বাস্থ্যসেবা। এ জন্য এ খাতে বাজেটে ৪০ হাজার কোটি টাকা বরাদ্দ করা উচিত। আসন্ন বাজেটের লক্ষ্য হবে কভিড-১৯ থেকে মুক্তি।
এদিকে অর্থ অর্থ মন্ত্রণালয় সূত্র জানিয়েছে, করোনাভাইরাসের বিস্তার রোধে বাজেটে বেশকিছু কার্যক্রম নেওয়া হচ্ছে। পাশাপাশি পুরো স্বাস্থ্যব্যবস্থার উন্নয়নে ৩ হাজার ৩০০ কোটি টাকার বিশেষ প্রকল্প নেওয়া হচ্ছে। এ ছাড়া আর্থ-সামাজিক খাতে করোনাভাইরাসের যে প্রভাব, তা মোকাবিলায় অন্যান্য খাতে বরাদ্দ রাখা হচ্ছে।
সূত্র জানিয়েছে, আসন্ন বাজেটেও সরকার সবচেয়ে বেশি বরাদ্দ রাখছে শিক্ষা খাতে। করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাবে সম্পূর্ণরূপে স্থবির হয়ে পড়া এ খাতে ২০২০-২১ অর্থবছরের বাজেটে ৮৫ হাজার ৭৬০ কোটি টাকার বরাদ্দ প্রস্তাব করা হচ্ছে। যা প্রস্তাবিত বাজেটের ১৫ দশমিক শূন্য ৯ শতাংশ এবং চলতি ২০১৯-২০ অর্থবছরের মূল বাজেটের তুলনায় ৬ হাজার ২৭৪ কোটি এবং সংশোধিত বাজেটের তুলনায় ৮ হাজার ৭২১ কোটি টাকা বেশি।
আগামী বৃহস্পতিবার জাতীয় সংসদে ২০২০-২১ অর্থবছরের বাজেট পেশ করার কথা। সবকিছু ঠিক থাকলে অর্থমন্ত্রী ওই দিন দ্বিতীয়বার বাজেট পেশ করবেন। ‘অর্থনৈতিক উত্তরণ ও ভবিষ্যৎ পথপরিক্রমা’ শীর্ষক এই বাজেট প্রস্তাবে ৫ লাখ ৬৮ হাজার কোটি টাকা ব্যয়ের লক্ষ্য নেওয়া হচ্ছে। বিপুল এই ব্যয়ের মধ্যে উন্নয়ন ব্যয় ধরা হয়েছে ২ লাখ ৫ হাজার ১৪৫ কোটি টাকা। এ ছাড়া ভর্তুকি ও প্রণোদনা বাবদ ৩৮ হাজার ৬৮৮ কোটি টাকা ব্যয় প্রস্তাব করা হচ্ছে। পেনশন ও গ্র্যাচুইটিতে ২৭ হাজার ৭০৬ কোটি, সুদ বাবদ ৬৩ হাজার ৮০১ কোটি, শেয়ার ও ইক্যুইটি বিনিয়োগ বাবদ ২৭ হাজার ৯৬১ কোটি টাকা ব্যয়ের লক্ষ্য রয়েছে সরকারের।
জানা গেছে, সামাজিক নিরাপত্তা ও কল্যাণ খাতে সরকার ৩২ হাজার ১৬৬ কোটি টাকা বরাদ্দ রাখছে, যা চলতি অর্থবছরের সংশোধিত বাজেটে রয়েছে ৩১ হাজার ১০০ কোটি টাকা। এ ছাড়া কৃষি খাতে বরাদ্দ চলতি অর্থবছরের তুলনায় ২ হাজার ৯৬০ কোটি টাকা বেড়ে ২৯ হাজার ৯৮৩ কোটি টাকা করা হচ্ছে। জ্বালানি খাতে বরাদ্দে বিশেষ পরিবর্তন হচ্ছে না। মাত্র ৭০৩ কোটি টাকা বাড়িয়ে ২৬ হাজার ৭৫৮ কোটি টাকা করা হচ্ছে। পরিবহন ও যোগাযোগ খাতে আগামী বাজেটে ৬৪ হাজার ৫৮৭ কোটি টাকা বরাদ্দ দিচ্ছে সরকার, যা চলতি অর্থবছরের সংশোধিত বাজেটে রয়েছে ৫৮ হাজার ৪৯৯ কোটি টাকা। স্থানীয় সরকার ও পল্লী উন্নয়নে ৩৯ হাজার ৫৭৩ কোটি টাকা বরাদ্দ রাখা হচ্ছে। প্রতিরক্ষা খাতে থাকছে ৩৪ হাজার ৮৮২ কোটি টাকা। জনশৃঙ্খলা ও নিরাপত্তা খাতে ২৮ হাজার ৬৮৮ কোটি এবং শিল্প ও অর্থনৈতিক সেবা খাতে ৪ হাজার ৯৪০ কোটি টাকা বরাদ্দ থাকছে। এ ছাড়া জনপ্রশাসন খাতে বরাদ্দ থাকছে এক লাখ ৮০ হাজার ৭১৫ কোটি টাকা, যা চলতি অর্থবছরের সংশোধিত বাজেটে রয়েছে এক লাখ ৪০ হাজার ১৩৮ কোটি টাকা।
করোনাভাইরাসের বিস্তার রোধে গত ২৬ মার্চ থেকে সাধারণ ছুটি ঘোষণা করে সরকার। সেই থেকে সব ধরনের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ রয়েছে। যদিও কিছু শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান অনলাইনে পাঠদানের ব্যবস্থা করেছে। সরকার জাতীয় শিক্ষাক্রম অনুযায়ী টেলিভিশনে পাঠদান করার উদ্যোগ নিয়েছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, শিক্ষার ঘাটতি কমিয়ে আনতে দূরবর্তী শিক্ষা ব্যবস্থা সহজ করতে হবে। প্রশিক্ষণ বাড়াতে হবে। শিক্ষা খাতে এ ধরনের কিছু বরাদ্দ থাকবে বলে জানা গেছে।
সূত্র: সমকাল