দৈনিকশিক্ষা:
লেখাপড়ায় যারা দুর্বল, যাদের মুখস্থ বিদ্যা কম কিংবা যাদের প্রাইভেট পড়ার সামর্থ্য নেই, মৌলভীবাজারের বাজার সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের এক সহকারী শিক্ষিকা তাদের জন্য আবিষ্কার করেছেন শতাধিক টেকনিক। কোনোটা ছড়া দিয়ে, কোনোটা খেলার ছলে, কোনোটা মজার বাক্যে, আবার কোনোটা সূত্র হিসেবে ব্যবহার করা হয়।
বর্তমানে তিনি এই টেকনিকগুলো নিজের ক্লাসের ছাত্রদের শিখিয়ে দিচ্ছেন। তবে এই টেকনিকগুলো সব ছাত্রছাত্রীর মধ্যে ছড়িয়ে দিতে প্রয়োজন সরকারের সহায়তায় এগুলো পাঠ্য পুস্তকে অন্তর্ভুক্ত করা।
একটি ছড়ার মাধ্যমে ৭টি মহাদেশের নাম, অনেক মাছের নাম, সবগুলো মৌলিক সংখ্যা, ৭টি বাক্যে দেশের ৬৪টি জেলার নাম, ভাজ্য-ভাজক, ইংরেজি প্রশ্নের উত্তর কীভাবে তৈরি করতে হয়, জ্যামিতি ও ত্রিকোনমিতিসহ বিভিন্ন বিষয়ের প্রায় শতাধিক টেকনিক আবিষ্কার করেছেন অঞ্জনা ঘোষ।
অঞ্জনা ঘোষ মাছের নাম মনে রাখার জন্য লিখেছেন মাছের ছড়া- টেংরা পুটি চিংড়ি ছড়ি চিতল, কাতল, রুই ইলিশ বোয়াল ফাইসা কই, মাগুর, সিং।
মৌলিক সংখ্যা ও যৌগিক সংখ্যা : ৯ যুক্ত ৯টি সংখ্যার মধ্যে ৪টি সংখ্যা মৌলিক নয়। যা তিনি শিখিয়েছেন ছড়ার মাধ্যমে। ৩৯, ৪৯, ৬৯, ও ৯৯- এগুলোর গুননিয়ক আছে। এরা যৌগিক। ছড়ার ভাষায়- তিন নয়, চার নয়, ছয় নয়, নয় নয় এরা মৌলিক নয় এরা মৌলিক নয়, চারটি সংখ্যা মৌলিক নয় যৌগিক হয় এরা যৌগিক হয়। মৌলিক সংখ্যা হচ্ছে দুই তিন পাঁচ সাত, এগারো তেরো, সতেরো, তেইশ একত্রিশ, সাইত্রিশ, একচল্লিশ ও তেতাল্লিশ।
সাতচল্লিশ তিপ্পান্ন আরো আছে সাতান্ন, একষট্টি, সাতষট্টি, একাত্তর ও তেয়াত্তর আরো আছে তিরাশি আর সাতানব্বই।
একটি বাক্যের মাধ্যমে ৮টি বিভাগের নাম : ‘ঢাকার খুচরা বিক্রেতা বসির মিয়া’ (ঢাকার)- ঢাকা, (খুচরা) খুলনা, চট্টগ্রাম, রাজশাহী (বসির) বরিশাল, সিলেট, রংপুর (মিয়া) ময়মনসিংহ।
একবাক্যে ৭টি মহাদেশের নাম : ‘অজগর ওই আসছে তেড়ে- একে একে মিলে এক ঝাঁক পাখি দল বেঁধে উড়ে’- অস্ট্রেলিয়া, আফ্রিকা, ইউরোপ, উত্তর আমেরিকা, এশিয়া, এন্টারর্কটিকা ও দক্ষিণ আমেরিকা।
ধারাবাহিকভাবে ৭টি বড় শহরের নাম : ঢাকায় চটপটি খেয়ে সিলেট গেল রাজা। ঢাকা, চট্টগ্রাম, খুলনা, সিলেট ও রাজশাহী।
সরল অঙ্কের ধারাবাহিকতা : সরল অঙ্কের জন্য এই সূত্রটি মনে রাখতে পারলে সরল অঙ্কে ভুল হবে না। সূত্রটি হলো- সকালে বনে ভাল্লুকগুলো যোগাযোগ বিনিময় করে (সমস্ত, বন্ধনী, এর, ভাগ, গুণ, যোগ ও বিয়োগ)
প্রশ্নে যদি হু, হোয়াট, হোয়েন, হাও, হাওমাচ, হাওম্যানি ও হোয়াই থাকে তাহলে বুঝতে হবে এগুলো প্রশ্ন। প্রশ্নে যদি ডিড থাকে তাহেল বুঝতে হবে এটি পাস্ট টেন্স। প্রশ্নে যদি ডাজ থাকে তাহলে মূল ভার্বের সঙ্গে এস বা ইএস যোগ হয়।
এভাবে তিনি অনেকগুলো ইংরেজি শিক্ষার টেকনিক বের করে ছাত্রদের শিখাচ্ছেন। তিনি সহজ পদ্বতিতে শিখিয়েছেন ভাজ্য, ভাগফল, ভাজক শিখিয়েছেন মুনাফা ও ঐকিক নিয়মের অঙ্ক। জ্যামিতি ও ত্রিকনোমিতির বেশ কয়েকটি সূত্র। যা ছাত্রদের জন্য বয়ে আনে সুফল।
তিনি আবিষ্কার করেছেন এক সূত্রে বাংলাদেশের ৬৪টি জেলার নাম। সূত্র মা ভোলা রাজ ফেনী-কুমিল্লা ঢাকা লাল।
(১) মামামু নাকি গো ফনটা সুনে বলতে পারবে সিরাজকে- মাদারীপুর, মানিকগঞ্জ, মুন্সীগঞ্জ, নারায়ণগঞ্জ, কিশোরগঞ্জ, গোপালগঞ্জ, ফরিদপুর, নড়াইল, টাঙ্গাইল, সুমানগঞ্জ, নেত্রকোনা, বগুড়া, পাবনা, সিরাজগঞ্জ।
(২) ভোলা, দিনা, চাঁপা, চুয়া নওয়া মৌলভী কুষ্টি করে। ভোলা, দিনাজপুর, নাটোর, চাঁপাইনবাবগঞ্জ, চুয়াডাঙ্গা, নওগাঁ, মৌলভীবাজার, কুষ্টিয়া, কক্সবাজার। (৩) রাজলক্ষী, চাঁদ, গাজী, জামাল শরিশের মেহের জয়।
রাজবাড়ী, লক্ষীপুর, চাঁদপুর, গাজীপুর, জামালপুর, শরীয়তপুর, শেরপুর, মেহেরপুর, জয়পুর। (৪) ফেনীর যশো ঝিনাই রাঙ্গা খাগড়া নোয়া বাগে। ফেনী, যশোর, ঝিনাইদহ, রাঙ্গামাটি, খাগড়াছড়ি, নোয়াখালী, বাগেরহাট।
(৫) কুমিল্লার কুড়িয়া বাহাদুর ব্রাহ্মণ ঠাকুর পঞ্চ গাইয়ের সাত লিটার দুধ হবে। কুমিল্লা, কুড়িগ্রাম, বান্দরবান, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, ঠাকুরগাঁও, পঞ্চগড়, গাইবান্ধা, সাতক্ষীরা, হবিগঞ্জ।
(৬) ঢাকার খুচরা বিক্রেতা বসির মিয়া। ঢাকা, খুলনা, চট্টগ্রাম, রাজশাহী, বরিশাল, সিলেট, রংপুর, ময়মনসিংহ।
(৭) লাল নীল পেঁয়াজ পটল বর মাগুর ঝাল নয়। লালমনিরহাট, নীলফামারী, পিরোজপুর, পটুয়াখালী, বরগুনা, মাগুরা, ঝালকাঠি, নরসিংদি।
অঞ্জনা ঘোষ জানান, বাংলা ইংরেজি, অঙ্ক, ভূগোল, সমাজ বিজ্ঞানসহ বিভিন্ন বিষয়ে এভাবে তিনি শতাধিক কৌশল বের করে তার ক্লাসে ছাত্রদের শিখিয়ে দিয়েছেন।
এদিকে অঞ্জনা ঘোষের এই বিশেষ ফর্মুলায় পাঠ দানে খুশি তার ক্লাসের ছাত্রছাত্রীরাও। তারা জানায়, মেডামের এই কৌশলে ছড়ার মাধ্যমে ও খেলার মাধ্যমে সহজেই তারা অনেক কিছু শিখতেছে যা তাদের পরীক্ষায়ও কাজে লেগেছে।
আর মৌলভীবাজার সরকারি প্রাথমিক শিক্ষক সমিতির সভাপতি ও বাজার সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষিকা রেহেনা আক্তার এ প্রতিবেদককে জানান, তার বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষিকা অঞ্জনার এ আবিষ্কার নিঃসন্দেহে ধন্যবাদ পাওয়ার দাবিদার।
অঞ্জনার এই আবিষ্কার সারা দেশের সব ছাত্রদের মাঝ্যে ছড়িয়ে দিতে প্রয়োজন সরকারের শিক্ষা বিভাগের হস্তক্ষেপ। অঞ্জনা ঘোষ জানান, তার আবিষ্কৃত এ কৌশল যদি সরকারের শিক্ষা বিভাগ নিতে চায় তাহলে তিনি তা দিতে প্রস্তুত।
অঞ্জনা ঘোষ শ্রীমঙ্গল শহরতলী সন্ধানী আবাসিক এলাকার পংকজ কুমার দত্তের স্ত্রী। বর্তমানে তিনি মৌলভীবাজারে স্বামী নিয়ে বসবাস করছেন। তার একমাত্র মেয়ে প্রিয়াংকা দত্ত মৌ স্বামী এডভোকেট প্রিতম দত্ত সজীবের সঙ্গে মৌলভীবাজারেই বসবাস করছে এবং এলএলবি পড়ছে।
তবে শিক্ষিকা অঞ্জনা ঘোষ জানান, তার প্রস্ফুটিত জীবনের জন্য তিনি তার স্কুল জীবনের শিক্ষক ফরেস্টার শিব প্রসাদ ভট্টাচার্যের কাছে ঋণী।