ক্রীড়া ডেস্কঃ
ইতালিয়ানরা পাওলো রসিকে আদর করে ডাকত ‘পাবলিতো’। আর ব্রাজিলিয়ানদের কাছে তিনি ছিলেন ‘জল্লাদ’! রূপকথার গল্পের মতো ইতালিকে ১৯৮২ বিশ্বকাপ এনে দেওয়া এই তারকা গত বৃহস্পতিবার চিরবিদায় নিয়েছেন পৃথিবী থেকে। তার জন্য পুরো ইতালি শোকে বিহ্বল। একইভাবে ব্রাজিলিয়ানরাও তাকে মনে রেখেছে ‘সারিয়া ট্র্যাজেডি’-এর জন্য। অনেকের মতে, ওই ট্র্যাজেডি ব্রাজিলের ফুটবল-দর্শনকে বদলে দিয়েছিল।
ব্রাজিলিয়ানদের কাছে ফুটবল মানেই হলো গোলের খেলা। প্রতিপক্ষের সীমানায় সাগরের ঢেউয়ের মতো আক্রমণে আছড়ে পড়ার নামই সেলেকাওদের কাছে ফুটবল। ১৯৮২ সালে স্পেনে ব্রাজিলিয়ান ফুটবলের সর্বশেষ রোমান্টিক কোচ হিসেবে খ্যাত টেলে সান্তানার নেতৃত্বে খেলতে এসেছিল সেলেকাওরা। সান্তানার ফুটবল দর্শন ছিল, আক্রমণ এবং আক্রমণ। কারণ যে দল বেশি গোল করে, তারাই তো জেতে! যার অন্য নাম ‘জোগো বোনিতো’ বা সুন্দর ফুটবল। ভাগ্যক্রমে সেবার তিনি হাতে পেয়েছিলেন জিকো, সক্রেটিস, ফ্যালকাও, জুনিয়র, এডেরের মতো একঝাঁক শিল্পী ফুটবলার। কিন্তু পাওলো রসি একা থামিয়ে দিয়েছিলেন একঝাঁক তারকার দলটিকে। ফুটবল ইতিহাসে বিশ্বকাপ জিততে না পারা সেরা দলগুলোর তালিকায় আজও দীর্ঘশ্বাসের সঙ্গে উচ্চারিত হয় জিকো-সক্রেটিসদের সে দলটির নাম।
সারিয়া স্টেডিয়ামে কোয়ার্টার ফাইনালে রূপ নেওয়া দ্বিতীয় রাউন্ডের সেই ম্যাচে পাওলো রসির হ্যাটট্রিকে ৩-২ গোলে জিতে যায় ইতালি। বিশ্বকাপ ইতিহাসে অন্যতম সেরার মর্যাদা পায় সেই ম্যাচ। ওই বিশ্বকাপে ব্রাজিল এসেছিল অবিসংবাদিত ফেভারিট হয়ে। প্রথম চার ম্যাচে প্রতিপক্ষকে আক্রমণের তোড়ে উড়িয়ে দিয়ে ১৩ গোল করে ফেভারিট তকমার প্রতি সুবিচার করেছিল সান্তানার ব্রাজিল। অন্যদিকে ইতালি আগাচ্ছিল অনেকটা খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে। গ্রুপ পর্বের তিন ম্যাচে পেরু, পোল্যান্ড ও ক্যামেরুনের বিপক্ষে গোলশূন্য ড্র করে তারা। এরপর দ্বিতীয় গ্রুপ পর্বে অনেকটা আশ্চর্যজনকভাবে আর্জেন্টিনাকে ২-১ গোলে হারিয়ে ব্রাজিলের মুখোমুখি হয়েছিল আজ্জুরিরা। আর রসির কথা তো বলাই বাহুল্য! তার বিশ্বকাপ খেলতে যাওয়াটাই ছিল রহস্য রোমাঞ্চ গল্পের মতো। ১৯৮০ সালে ‘টোটেনেরো’ কেলেঙ্কারি নাড়িয়ে দিয়েছিল ইতালির ফুটবলকে। সেই ম্যাচ ফিক্সিং কেলেঙ্কারিতে জড়িত থাকায় তিন বছর নিষিদ্ধ হয়েছিলেন রসি। শেষ পর্যন্ত ইতালি জাতীয় দলের কোচ এনজো বেয়ারজোত কলকাঠি নেড়ে এক বছর নিষেধাজ্ঞা কমিয়ে বিশ্বকাপ স্কোয়াডে নেন রসিকে।
তবে বিতর্কিত, কলঙ্কিত, দু’বছর ফুটবল থেকে নির্বাসিত, ফিটনেস হারিয়ে ফেলা রোগাপাতলা এক স্ট্রাইকারকে নেওয়ায় সমালোচনার ঝড় ওঠে ইতালির গণমাধ্যমে। স্পেনে পৌঁছতেই ফের বিতর্ক। প্রথমেই দেখা গেল, রসির ওজন কম। পেশিতে শক্তি বলে কোনো কিছু নেই। কেমন করে বিশ্বের বলশালী সব ডিফেন্ডারের সঙ্গে লড়াই করবেন তিনি? কেবল মাত্র কোচের অনড় মনোভাবের জন্য একাদশে সুযোগ পান রসি।
বার্সেলোর সারিয়া স্টেডিয়ামে মহাকাব্যিক এক লড়াইয়ে অবতীর্ণ হয়েছিল ব্রাজিল ও ইতালি। সেদিন সেমিতে ওঠার জন্য ব্রাজিলের দরকার ছিল ড্র। কিন্তু পঞ্চম মিনিটেই ডিফেন্সের ভুলে হেডে গোল করে বসেন রসি। সাত মিনিট পরই সক্রেটিস-জিকোর যুগলবন্দিতে লাতিন আমেরিকানরা সমতা ফিরিয়ে আনে। তখন বিসিবির বিখ্যাত ধারাভাষ্যকার জন মোটসন বলেছিলেন, ‘ব্রাজিলিয়ান ফুটবল দর্শনের দারুণ বাস্তবায়ন।’ এরপর রসির দুর্দান্ত শটে আবার এগিয়ে যায় ইতালি। বিরতির পর আবার সমতা ফিরিয়ে আনেন ফ্যালকাও। কিন্তু রসির তৃতীয় গোলটির আর জবাব দিতে পারেনি ব্রাজিলের ইতিহাসের অন্যতম সেরা দলটি।
বিশ্ব ফুটবলের অনেক পণ্ডিতের মতে, ওই একটি হার ব্রাজিলের ফুটবল দর্শনকে বদলে দিয়েছিল। তারাও ইউরোপিয়ানদের মতো রক্ষণের প্রতি মনোযোগী হয়ে ওঠে। নব্বইয়ের দশকে ব্রাজিলের ঘরোয়া ফুটবলে ডিফেন্ডাররা ভীষণ আগ্রাসী হয়ে উঠেছিল। তখন প্রতি ম্যাচে ৫০ থেকে ৬০টির মতো ফাউল হতো। ইতালির কাছে হারের ফলেই যে এই পরিবর্তন, সেটা স্বীকার করেছেন জিকো পর্যন্ত। এক সাক্ষাৎকারে তিনি বলেন, ‘যদি আমরা সেই ম্যাচটা জিততাম, তাহলে ফুটবল অন্যরকম হতো। কিন্তু ওই ম্যাচের পর থেকে আমরা যে কোনোভাবে জেতার চেষ্টা শুরু করে দিলাম। প্রতিপক্ষের আক্রমণগুলো ফাউল করে ঠেকানোর রীতি প্রতিষ্ঠিত হয়ে গেল ফুটবলে।’ ব্রাজিলের চার সৃষ্টিশীল মিডফিল্ডার, উইঙ্গার ও স্ট্রাইকারের আক্রমণাত্মক ফরমেশনও হারিয়ে যায়।
এই পরিবর্তনের জন্য অনেকেই রসিকে দায়ী করেন। ওই হারের দগদগে ঘা অনেক দিন ব্রাজিলিয়ানরা ভুলতে পারেননি। দুই বছর আগে জিকোর সঙ্গে এক যৌথ সাক্ষাৎকারে রসি জানান, ওই ম্যাচের সাত বছর পর ১৯৮৯ সালে তিনি ব্রাজিল গিয়েছিলেন। তখন নাকি এক ট্যাপি ড্রাইভার তাকে চিনতে পেরে গাড়ি থেকে নামিয়ে দিয়েছিল। তবে ওই জয়ের জন্য ভীষণ গর্ববোধ করতেন রসি, ‘যে বিষয়টা আমাকে গর্বিত করে সেটা হলো সেদিন যে ব্রাজিলকে হারিয়ে ছিলাম, সেটা ছিল ইতিহাসের অন্যতম সেরা দল। ১৯৮২ বিশ্বকাপের ব্রাজিল ছিল একঝাঁক সৃষ্টিশীল চ্যাম্পিয়নের অনন্য এক দল!’
সূত্রঃ সমকাল