অনলাইন ডেস্কঃ
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে লেখাপড়া শেষ করে একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে কর্মরত আছেন সামিয়া সিদ্দিকা (ছদ্মনাম)। সারা দিন ব্যস্ততা শেষে রাতে ঘুমানোর সময় মোবাইলটা হাতে নিতেই হোয়াটস অ্যাপে অপরিচিত নম্বর থেকে কল এলো।
বার বার কেটে দেওয়ার পরেও কল করেই যাচ্ছিল ওপাশ থেকে। এক সময়ে কল ধরতে হল সামিয়াকে। কল ধরার সাথে সাথেই ওপাশ থেকে অশালীন ভাষায় নানা মন্তব্য ও কুরুচিপূর্ণ কথাবার্তা ভেসে আসছিল। কল কেটে দেওয়ার সাথে সাথে ইনবক্সে বিভিন্ন অশ্লীল ছবি আসতে শুরু করল।
দুই দিন এভাবে চলার পর সামিয়া পুলিশ সাইবার সাপোর্ট ফর উইমেন সম্পর্কে জানতে পারেন। কল করেন তাদের হটলাইন নম্বরে। সেখান থেকে পরামর্শ নিয়ে তিনি থানায় জিডি করেন।
‘নারীর জন্য নিরাপদ সাইবার স্পেস’ এই মূলমন্ত্রকে সামনে রেখে পুলিশ সাইবার সাপোর্ট ফর উইমেন- (পিসিএসডব্লিউ) নামে অফিসিয়াল ফেইসবুক পেইজ চালু করেছে পুলিশ সদর দপ্তর। সামিয়ার মতো হাজারো নারী হয়রানির প্রতিকারের জন্য তাদের কাছে যাচ্ছেন।
প্রযুক্তির সাথে তাল মিলিয়ে এগিয়ে যাওয়া নারীরা অনেক সময় সাইবার সংক্রান্ত বিভিন্ন সমস্যার সম্মুখীন হচ্ছেন। শুধু নারীদের ওপর সংঘটিত সাইবার অপরাধ নিয়ে কাজ করতে বাংলাদেশ পুলিশের এই উদ্যোগ। গত ১৬ নভেম্বর এই কর্মসূচির যাত্রা শুরু হয়, বাংলাদেশ পুলিশের মহাপরিদর্শক বেনজীর আহমেদের উদ্যোগেই এটি চালু হয়েছে।
নারীরা সম্পূর্ণ নিশ্চিন্তে নিজেদের সমস্যার কথা জানাতে পারছেন এই প্ল্যাটফর্মে। ভুক্তভোগী নারীর তথ্যের গোপনীয়তা নিশ্চিত করে আইনের আলোকে সব অভিযোগের উপযুক্ত পরামর্শ ও সেবা দেওয়া হচ্ছে এখান থেকে।
অভিযোগ জানানোর জন্য Police Cyber Support for Women- PCSW নামে ফেইসবুক পেইজে মেসেজ দিতে হবে। অথবা [email protected] ঠিকানায় ই-মেইল করেও অভিযোগ জানানো যাবে।
এছাড়া হটলাইন নম্বর ৯৯৯ এবং পুলিশ সদর দপ্তরের ০১৩২০০০০৮৮৮ নম্বরে ফোন করেও অভিযোগ করা যাবে।
উদ্বোধনের পর ১৬ ডিসেম্বর বিজয় দিবসে সেবাটির এক মাস পার হয়েছে। পুলিশ সদর দপ্তরের তথ্য অনুসারে, এই এক মাসে সর্বমোট ৫ হাজার ৬৬৬ জন নারী যোগাযোগ করেছেন। তাদের মধ্যে ফেইসবুক পেইজে মেসেজের মাধ্যমে ৩ হাজার ৪৫৩ জন, হটলাইন নম্বরে ফোন করে ৩ হাজার ২৫৪ জন এবং ১৩৬ জন ই-মেইলের মাধ্যমে যোগাযোগ করেছেন।
অভিযোগকারীদের ১ হাজার ৯৩৬ জনকে প্রয়োজনীয় সেবা দেওয়া হয়েছে। ১ হাজার ৭৯৬ জনের কাছে প্রয়োজনীয় তথ্য চাওয়া হয়েছে এবং অবশিষ্ট ১ হাজার ৯৩৪ জনের সাথে কথা বলে সমস্যাগুলো সমাধানের প্রক্রিয়া চলছে।
অভিযোগের ধরন যাচাই করলে দেখা যায়, বেশিরভাগই ফেইক আইডির মাধ্যমে হয়রানির শিকার হয়েছেন।
ভুক্তভোগীর ছবি বা পরিচয় বা উভয়ই ব্যবহার করে মিথ্যা বা বেনামে আইডি খুলে তার ছবি, ভিডিও বা তথ্য প্রচার করার অভিযোগ এসেছে ১ হাজার ৪৪৩টি। এছাড়া কারও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের আইডি হ্যাক করা, পাসওয়ার্ড চুরি করে অ্যাকাউন্টের দখল নেওয়া অর্থাৎ আইডি হ্যাকের অভিযোগ এসেছে ৭১৬টি। পূর্ব পরিচয় কিংবা সম্পর্কের জের ধরে বা অন্য কোনোভাবে প্রাপ্ত ছবি, ভিডিও বা তথ্য ইন্টারনেটে ছড়িয়ে দেওয়ার ভয় দেখিয়ে কোনো সুবিধা আদায় বা টাকা দাবি করা অর্থাৎ ব্ল্যাকমেইলিংয়ের অভিযোগ এসেছে ৪১৭টি।
মোবাইল ফোন ব্যবহার করে বুলিং, হয়রানি বা ভয় দেখানোর অভিযোগ ৫২৮টি, বিভিন্ন মাধ্যমে অশ্লীল শব্দ, লেখা, ছবি বা ভিডিও পাঠিয়ে হয়রানি করা অর্থাৎ অশ্লীল কনটেন্ট পাঠানোর অভিযোগ এসেছে ৪৩০টি। এছাড়া এসব অপরাধের তালিকায় পড়ে না এমন অন্যান্য অভিযোগ এসেছে ৬৩টি। এছাড়াও মোট ১ হাজার ৪৯৪টি নন সাইবার অপরাধ এবং পুরুষ সেবা প্রত্যাশীদের থেকেও অভিযোগ এসেছে বলে জানিয়েছে পুলিশ সদর দপ্তরের সাইবার সাপোর্ট ফর উইমেন টিম।
কোন ভাবনা থেকে এই সেবার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে জানতে চাইলে পুলিশ সদর দপ্তরের মুখপাত্র মিডিয়া উইংয়ের সহকারী মহাপরিদর্শক সোহেল রানা বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি (আইসিটি) আইন, ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন, পর্নগ্রাফি নিয়ন্ত্রণ আইন এবং টেলিকমিউনিকেশন অ্যাক্টের মামলাগুলো পর্যালোচনায় দেখা গেছে ভুক্তভোগীদের বেশিরভাগই নারী। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে নারীরা তাদের ওপর ঘটে যাওয়া অপরাধ সম্পর্কে অভিযোগ করেন না। তারা যাতে নির্দ্বিধায় অভিযোগ করতে পারেন, সেজন্য একটি অল-উইমেন ইউনিট গঠন করা হয়েছে।
“আমাদের সরকার দেশের নাগরিকদের প্রযুক্তির সাথে সংযুক্তি স্থাপনের জন্য অবিরাম চেষ্টা করে যাচ্ছে। ইন্টারনেট সহজলভ্য হওয়ায় এবং অন্যান্য দেশের মতো এর ব্যবহারে কোনো বিধি-নিষেধ না থাকায় এর অপব্যবহার হচ্ছে। বিকৃত রুচির লোকজন ইন্টারনেটকে কাজে লাগিয়ে নারীদের সম্মানহানি করছে। তার জন্যই আমাদের এই উদ্যোগ।”
ভুক্তভোগী এবং তাদের সহায়তা করতে পুলিশ সদরদপ্তরের যে নারী সদস্যরা ইউনিটটিতে কাজ করছেন, তাদের ব্যক্তিগত গোপনীয়তা রক্ষা ও সুরক্ষার কথাটি মাথায় রেখে সবার পরিচয় গোপন করা হয়েছে। গণমাধ্যমেও তাদের বিষয়ে কোনো তথ্য দেওয়া হচ্ছে না বলে জানান সোহেল রানা।
সবার সহযোগিতা ও পরিশ্রমে সেবাটি চূড়ান্ত সফলতা অর্জন করতে সক্ষম হবে বলে আশাবাদ ব্যক্ত করেন তিনি।
পুলিশ সদর দপ্তরের দেওয়া তথ্য মতে, এই সেবা চালুর আগেও বাংলাদেশ পুলিশের অন্যান্য ইউনিট সাইবার সংক্রান্ত অভিযোগ নিয়ে কাজ করেছে এবং এখনও করে যাচ্ছে। অন্যান্য সাইবার সেকশনগুলো হল-
-ডিএমপির সাইবার ক্রাইম ইনভেস্টিগেশন ডিভিশন
-সিআইডির সাইবার পুলিশ সেন্টার
-সিএমপির সাইবার ইউনিট
-বগুড়া জেলা পুলিশের সাইবার সেল
-আরএমপির সাইবার ইউনিট
তবে নারীদের সাইবার সংক্রান্ত হয়রানি বিষয়ক সেবাদানের প্ল্যাটফর্ম হিসেবে এটিই প্রথম বলে জানান সংশ্লিষ্টরা।
বাংলাদেশ পুলিশের এই উদ্যোগকে ইতিবাচক দৃষ্টিতে দেখছেন অনেকেই।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অপরাধ বিজ্ঞান বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক জিয়া রহমান বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “আমরা বিভিন্ন সময়ে পুলিশের বিভিন্ন বিভাগের সাথে আলোচনায় এ ধরনের একটি উদ্যোগের ব্যাপারে প্রস্তাব করেছি। সাইবার ক্রাইমের সংখ্যা এতই বেড়েছে যে, এটি নিয়ে জরুরি ভিত্তিতে ব্যবস্থা গ্রহণ করা এখন সময়ের দাবি।
“সাইবার স্পেসে মানুষের বিচরণ এতই বেশি, কিন্তু এখানকার পরিস্থিতি সামাল দেয়ার ক্ষেত্রে সরকারের তেমন তৎপরতা দেখা যাচ্ছিল না। এই অবস্থা থেকে বেরিয়ে এসে বাংলাদেশ পুলিশের এমন একটি উদ্যোগ নিঃসন্দেহে প্রশংসার দাবিদার।”
তিনি বলেন, “সেবা চালুর প্রাথমিক পর্যায়েই যেহেতু এতটা সাড়া পাওয়া যাচ্ছে, তাই তাদের এ বিষয়টি যাতে সব সময়ের জন্য অব্যাহত থাকে এমনটাই আশা করব।”
তবে যোগাযোগ করে কোনো সাড়া পাওয়া যায়নি বলেও অভিযোগ পাওয়া গেছে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের শিক্ষার্থী শাহারীন আমিন সুপ্তি নিজ জেলা কিশোরগঞ্জের একটি ফেইসবুক পেইজে কিছু ব্যক্তির অশালীন মন্তব্য, বিভিন্ন নারীর ছবি আপলোড করে ধর্ষণের হুমকি দেওয়ার বিষয়ে অভিযোগ জানিয়েছিলেন পুলিশ সাইবার সাপোর্ট ফর উইমেনের পেইজে।
সুপ্তি বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “গত ২১ নভেম্বর আমি তাদের পেইজে মেসেজ দিয়েছিলাম, তাৎক্ষণিকভাবে সাড়া পাব বলে আশা করেছিলাম। কিন্তু সাড়া পাইনি। বাংলাদেশে এমন একটি সেবা চালু হয়েছে জেনে খুবই খুশি হয়েছিলাম। হয়ত তাদের কাছে হাজার হাজার অভিযোগের ভিড়ে আমার মেসেজটি তারা খেয়াল করেননি।
“তবে এসব সমস্যা ধীরে ধীরে কাটিয়ে উঠে সকলের অভিযোগে তাৎক্ষণিকভাবে সাড়া দিয়ে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করবে বলে আমি আশা করি।”
অন্যদিকে এ সেবার মাধ্যমে উপকৃত হয়ে সন্তুষ্টি জানিয়েছেন অনেকেই।
ফাতেমা নাসরিন নামের একজন পুলিশ সাইবার সাপোর্ট ফর উইমেনের ফেইসবুক পেইজের একটি পোস্টে মন্তব্যে জানিয়েছেন নিজের সন্তুষ্টির কথা।
তিনি লিখেছেন, “কে কী বলবে, কে কী বলছে জানি না। তবে আমি আমার সঠিক তথ্য দিয়ে এক ঘণ্টার মধ্যে পরামর্শ ও সহযোগিতা পেয়েছি। ধন্যবাদ PCSW কে। বাংলাদেশ পুলিশের এই মহতী উদ্যোগকে সাধুবাদ জানাই। সেই সাথে যারা এর সাথে সংযুক্ত হয়ে রাত-দিন পরিশ্রম করে যাচ্ছেন উনাদের স্যালুট জানাই।
“কিছু মানুষ আছে অহেতুক উনাদের বিব্রত করার চেষ্টা করে হয়ত। আমরা এসব বিকৃত মানসিকতা থেকে বেরিয়ে এসে উনাদের কাজের সুযোগ করে দেই। নতুন ইউনিট চালু হয়েছে, গুছিয়ে নিতে একটু সময় লাগবে। সবাই একটু ধৈর্য্য ধরি। ধন্যবাদ বাংলাদেশ পুলিশকে। ধন্যবাদ সংশ্লিষ্ট সকলকে। সবাই সুস্থ ও নিরাপদ থাকুন- শুভকামনা নিরন্তর।”
সূত্রঃ জাগোনিউজ