ড. আতিউর রহমানঃ
দুর্যোগে দুঃসময়ে যে বাংলাদেশ তার আত্মশক্তির বলে ঘুরে দাঁড়াতে পারে, তা সে আবার প্রমাণ করল। সম্প্রতি ৫৩টি দেশের করোনা মহামারি মোকাবিলার সক্ষমতা পরিমাপ করে ব্লুমবার্গ যে তালিকা প্রকাশ করেছে, তাতে বাংলাদেশ চার ধাপ এগিয়ে শীর্ষ ২০-এ স্থান করে নিয়েছে। এই তালিকায় বাংলাদেশের পেছনে পড়ে গেছে অনেক উন্নত দেশ। তার মানে এই নয় যে, বাংলাদেশে কোনো সংকট নেই। নিশ্চয়ই কম আয়ের মানুষ কষ্টে আছেন। নগরের অনেক পরিবারের বয়স্কজন স্বাস্থ্যঝুঁকিতে রয়েছেন। অনানুষ্ঠানিক খাতের অবস্থা এখনও আগের মতো হতে পারেনি। তবু বিশ্বব্যাপী অর্থনৈতিক সংকোচনের মধ্যেও সম্প্রতি প্রকাশিত অষ্টম পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনায় ২০২৪-২৫ অর্থবছর নাগাদ ৮.৫১ শতাংশ প্রবৃদ্ধির যে লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারিত হয়েছে, তা থেকেও বোঝা যাচ্ছে আমরা প্রবৃদ্ধির ইতিবাচক ধারাতেই আছি। প্রধানত নিজেদের সম্পদেই এই পরিকল্পনার লক্ষ্য পূরণের উদ্যোগ নিয়েছে সরকার। এই মহামারি না এলে ২০২০ সালেই আমরা বাংলাদেশের অর্থনীতিকে এক নয়া উচ্চতায় নিয়ে যেতে পারতাম। উল্লেখ্য, মহামারির আগে আগে আমরা দারিদ্র্য ও অতিদারিদ্র্য যথাক্রমে ২০ শতাংশ ও ১০ শতাংশের কাছাকাছি নামিয়ে এনেছিলাম। দুই অঙ্কের জিডিপি প্রবৃদ্ধি চলে এসেছিল হাতের নাগালে। এক দশকের মধ্যে অর্থনীতির আকার দ্বিগুণ হতে যাচ্ছিল। সব মিলিয়ে একটা খুবই আশাব্যঞ্জক অবস্থায় আমরা ছিলাম।
আমাদের স্বপ্নের অভিযাত্রায় একটা ছেদ পড়েছে- এ কথা মেনে নিয়েও বলতে হবে মহামারিজনিত অর্থনৈতিক অচলাবস্থা মোকাবিলায় আমরা বেশ ভালোই করেছি। ২০২০ সালের সামষ্টিক অর্থনৈতিক সূচকগুলো সে কথাই বলছে। ২০১৯ সালের জুনে আমাদের রিজার্ভ ছিল ৩২ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের বেশি। এখন তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৪২ বিলিয়ন মার্কিন ডলারে। এর পেছনে প্রধানতম ভূমিকা রেখেছে রেমিট্যান্স। আর রেমিট্যান্স বাড়লে বাজারে তারল্যও বাড়ে আমাদের অর্থনৈতিক সক্ষমতার পেছনে, তাই এই প্রবাস আয় বড় ভূমিকা রাখছে। ২০২০ সালে এখন পর্যন্ত রেমিট্যান্স এসেছে ২১ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। গত পাঁচ মাসেই এর প্রবাহ বেড়েছে ৪১ শতাংশ। আগেই ২ শতাংশ প্রণোদনা এবং ডিজিটাল মাধ্যমে সহজে অর্থ প্রেরণের সুযোগ সৃষ্টি করার ফলেই এই প্রবৃদ্ধি হয়েছে। রপ্তানি আয় প্রাথমিকভাবে কিছুটা ঝুঁকির মধ্যে পড়লেও পরিস্থিতি আবার অনুকূল হতে শুরু করেছে। ২০২০ সালের জুলাই থেকে নভেম্বর পর্যন্ত রপ্তানির পরিমাণ ১৬ বিলিয়ন মার্কিন ডলার, যা আগের বছরের একই সময়ে রপ্তানির চেয়ে ১ শতাংশ বেশি। নিঃসন্দেহে এই হার যথেষ্ট নয়। বিশেষ করে করোনার দ্বিতীয় ধাক্কা রপ্তানিকে আবার চ্যালেঞ্জের মধ্যে ফেলতে পারে, সেজন্য আমাদের মানসিকভাবে প্রস্তুত থাকতে হবে।
এ অবস্থাতেই আসছে ২০২১। তার ঠিক আগে সরকার যে পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনা সামনে নিয়ে এসেছে তা আমাদের বিশেষভাবে আশাবাদী করেছে- এ কথা শুরুতেই বলেছি। তবে এই আত্মবিশ্বাস কেবল এ বছর জুড়ে মহামারি মোকাবিলায় যে দক্ষতা আমরা দেখিয়েছি, তা থেকেই এসেছে এমন নয়।
১৯৭৫ সালে মাথাপিছু আয় ছিল ২৭৮ ডলার। তা ২০১৯ সালে ১,৮৫৬ ডলারে উঠে এসেছে। আর এই বিশাল বৃদ্ধির ৭৩ শতাংশ কিন্তু হয়েছে শেষ দশ বছরে। গত দশ বছরে যেখানে প্রবৃদ্ধির হার গড়ে ৭ শতাংশ, সেখানে তার আগের দুই দশকের গড় প্রবৃদ্ধির হার ৫ শতাংশের বেশি। রপ্তানি বৃদ্ধিতেও একই ধারা দেখি। ১৯৭৬ থেকে ২০১৯ পর্যন্ত বার্ষিক রপ্তানির পরিমাণ ৯৮ গুণ বেড়ে ৩৯ বিলিয়ন ডলারে ঠেকেছে। এখানেও কিন্তু মোট প্রবৃদ্ধির দুই-তৃতীয়াংশ বেড়েছে শেষ দশকেই। কৃষি উৎপাদন গত দশ বছরে গড়ে বার্ষিক ৩৭ মিলিয়ন মেট্রিক টন। অথচ ১৯৯০ থেকে ২০০৯ পর্যন্ত এই গড় ছিল ২৪ মিলিয়ন মেট্রিক টন। এসবের পাশাপাশি মূল্যস্টম্ফীতিকে নিয়ন্ত্রণে রাখা গেছে, জিডিপিতে কৃষির অবদান কমলেও গ্রামে কর্মসংস্থান সৃষ্টি হওয়ায় সেখানকার আয়েরও ৬০ শতাংশ আসছে অ-কৃষি খাত থেকে, বেড়েছে কৃষি মজুরিও।
সর্বোপরি আয়ু বৃদ্ধি, মাতৃমৃত্যু ও শিশুমৃত্যু রোধ, শিক্ষার প্রসারের মতো সূচকগুলোতেও আমরা ভালো করেছি। প্রবৃদ্ধি বাড়লে সাধারণত বৈষম্য বাড়ে। আমাদের দেশেও আয় বৈষম্য বেড়েছে। কিন্তু ভোগবৈষম্য কিন্তু একইভাবে বাড়েনি। সমাজের পাটাতনের নিচের অংশের মানুষের দু’বেলা দু’মুঠো খাবার জুটছে। তবে শতভাগ পরিবারে সামাজিক সুরক্ষা কর্মসূচি চালু করা যায়নি। অবশ্য, কমিনিউটি স্বাস্থ্যকেন্দ্রের কল্যাণে গ্রাম পর্যায়ে প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবা দেওয়া সম্ভব হচ্ছে। তবে নগরের গরিবদের জন্য এ দুটি সেবা এখনও সেভাবে দেওয়া যাচ্ছে না। মোটকথা, বিগত দশকে জনবান্ধব নীতি ও কর্মসূচি বাস্তবায়নের ধারাবাহিকতায় দেশকে একটি শক্তিশালী সামষ্টিক অর্থনৈতিক ভিত্তির ওপর দাঁড় করানো সম্ভব হয়েছে। তাই তো মহামারির শুরুতেই মাননীয় প্রধানমন্ত্রী দ্রুততম সময়ের মধ্যে জিডিপির ৪.৩ শতাংশের সমান ২১টিরও বেশি স্টিমুলাস প্যাকেজ ঘোষণা করেছেন। এই প্যাকেজগুলোর বাস্তবায়নে বিশেষ করে ছোট উদ্যোক্তাদের কাছে এসবের সুফল পৌঁছে দেওয়ার ক্ষেত্রে কিছু চ্যালেঞ্জ রয়েছে। সেজন্য এ প্যাকেজগুলোর বাস্তবায়নের সময়সীমা এপ্রিল নাগাদ বাড়ানো হয়েছে। তবে আশার কথা এই যে, কুটির, ক্ষুদ্র ও ছোট উদ্যোক্তাদের জন্য অসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোর অংশীদারিত্বে আরও দশ হাজার কোটি টাকার নয়া প্রণোদনা কর্মসূচি চালু করতে চাইছে সরকার।
এই প্রেক্ষাপটেই সম্প্রতি প্রকাশিত পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনা নিয়ে ইতিবাচক কথা শোনাতে পারছি। নিঃসন্দেহে অনেক ক্ষেত্রেই আমাদের প্রত্যাশার তুলনায় ছোট খানিকটা কাটছাঁট করেই লক্ষ্য নির্ধারণ করতে হয়েছে। জানতে পেরেছি আগামী বছর প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রা জাতীয় বাজেটের চেয়ে কিছুটা কমিয়ে ধরা হয়েছে। সেটি বড় কথা নয়। আমার মতে মূল বিবেচ্য প্রায় ৬৫ লাখ কোটি টাকার এই পরিকল্পনায় আমাদের পুনরুদ্ধার প্রক্রিয়ার জন্য কতটা সহায়ক হলো সেটি।
এই পরিকল্পনায় মোট বিনিয়োগের ৮১ শতাংশের বেশি বেসরকারি খাত থেকে নিয়ে আসার কথা বলা হয়েছে। বেসরকারি বিনিয়োগের বিষয়ে আমি বিশেষ করে আশাবাদী কারণ ব্যবসার পরিবেশ উন্নয়নে বিডাসহ অন্যান্য সংশ্নিষ্ট সরকারি বিভাগ সম্প্রতি সাফল্য দেখিয়েছে। আরও আশাবাদী হয়েছি, যখন জেনেছি আগামী পাঁচ বছরে এক কোটি ১৩ লাখ ৩০ হাজার মানুষের কর্মসংস্থানের কথা বলা হয়েছে। এই লক্ষ্য অর্জন করা গেলে মানুষের হাতে টাকা যাবে। ফলে অভ্যন্তরীণ বাজারে চাহিদা বেগবান থাকবে। এবারের পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনার মেয়াদান্তে ৩০ হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারিত হয়েছে। প্রধানমন্ত্রী নিজে ‘সবুজি প্রবৃদ্ধি’র পক্ষে বৈশ্বিক আন্দোলনে নেতৃত্ব দিচ্ছেন। কাজেই আশা করছি ওই ৩০ হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুতের একটি উল্লেখযোগ্য অংশই আসবে নবায়নযোগ্য উৎস থেকে। মনে রাখতে হবে, পুনরুদ্ধার প্রক্রিয়াকে সবুজ রাখার কোনো বিকল্প নেই। তাছাড়া, নবায়নযোগ্য বিদ্যুৎ উৎপাদনের প্রযুক্তি আরও উন্নত হচ্ছে। তাই আশা করছি, প্রতিযোগিতা করেই সামনের দিনগুলোতে নবায়নযোগ্য বিদ্যুৎ মূলধারার জ্বালানি শক্তিতে পরিণত হবে। আর অর্থনীতির এই সবুজায়নে আমাদের তরুণরা বড় ভূমিকা পালন করতে পারে। শিক্ষা খাতে আরও মনোযোগী হতে হবে আমাদের। ২০২০ সাল শিক্ষা খাত খুবই নাজুক অবস্থার মধ্যে ছিল। আশা করছি জুন-জুলাই নাগাদ পূর্ণোদ্যমে সব শিক্ষা কার্যক্রম শুরু করা সম্ভব হবে।
সব শেষে বলতে চাই, পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনাটিকে একটি ফ্রেমওয়ার্ক ডকুমেন্ট হিসেবে নিয়েই আমাদের এগোতে হবে। এখানে যে নির্দেশনাগুলো রয়েছে, সেগুলোকে সামনে রেখে এখন কৌশল সাজাতে হবে সরকারি ও বেসরকারি সব অংশীজনকে; এবং ওই কৌশলগুলো বাস্তবায়নের ক্ষেত্রেও কাজ করতে হবে সকলে মিলেই। বঙ্গবন্ধুকন্যা গত এক দশকে আমাদের মধ্যে যে প্রতিকূলতা পেরিয়ে এগিয়ে যাওয়ার সংস্কৃতিকে লালন ও বিকশিত করেছেন, তার জোরে আমরা এ লক্ষ্য অর্জন করতে সক্ষম হবো। আগামী বছরেই শুরু হবে সেই নতুন অভিযাত্রা। ২০২১ হবে আমাদের ঘুরে দাঁড়াবার বছর- এই আশাবাদ ব্যক্ত করে সবাইকে জানাই মুজিববর্ষ ও স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীর শুভেচ্ছা।
লেখক: প্রাবন্ধিক, অর্থনীতিবিদ
সূত্রঃ সমকাল