সুভাষ সিংহ রায়ঃ
আমরা বঙ্গবন্ধুর স্বদেশ প্রত্যাবর্তন দিবস বিশেষ মর্যাদার সাথে পালন করে থাকি। গত বছর (৮ নভেম্বর ২০২০) মহান জাতীয় সংসদে বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবার্ষিকী উপলক্ষে বিশেষ অধিবেশনের আয়োজন করা হয়েছিল। অধিবেশনের শুরুতে বঙ্গবন্ধুর ১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারির সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের (তখনকার রেসকোর্স ময়দান) সেই ঐতিহাসিক ভাষণের পুরোটা আবার উপস্থাপন করা হয়েছিল। ১০ জানুয়ারি বাঙালি জাতির জন্য বিশেষভাবে তাৎপর্যপূর্ণ দিন। কেননা সেদিনই বাংলাদেশ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবকে ফিরে পেয়েছিল। ওইদিন তিনি স্বাধীন দেশের রাষ্ট্রনায়ক হয়ে বাংলাদেশে এসেছিলেন। স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের সাথে সাথে বঙ্গবন্ধু আবেগে শিশুর মতো কেঁদে ফেলেছিলেন। ১৯৭১ সালের ৭ই মার্চে যে স্থানে ১০ লাখেরও বেশি মানুষের সামনে ঘোষণা করেছিলেন, “এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম”- দেশে ফিরে এসেই সে জায়গায় ফিরে এসেছিলেন।
নয় মাস নির্জন কারাবাসের যন্ত্রণা, অনিশ্চয়তা, যে কোনও সময়ে ফাঁসিকাষ্ঠে ঝোলার পরিস্থিতি অতিক্রম করে বিশ্ব জনমতের চাপে ৮ জানুয়ারি মুক্তিলাভ করেন। স্বদেশ প্রত্যাবর্তন করে নিজের পিতা-মাতা, স্ত্রী-পুত্র-কন্যাদের কাছে না গিয়ে সরাসরি জনগণের কাছে ফিরে এসেছিলেন। লাখো মানুষের সামনে তিনি সেদিন বলেছিলেন, “…আমার বাংলাদেশ আজ স্বাধীন হয়েছে। আমার জীবনের স্বাদ আজ পূর্ণ হয়েছে। আমার বাংলার মানুষ আজ মুক্ত হয়েছে।…”
দৈনিক পূর্বদেশ-এর ১৯৭২ সালের ১১ জানুয়ারির প্রতিবেদনে স্পষ্ট উল্লেখ আছে, “জাতির জনক ও গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে বহন করেছিল ব্রিটিশ রাজকীয় বিমান বাহিনীর কমেট জেট বিমানটি। বাংলাদেশ সময় ১টা ৪১ মিনিটে বিমানটি ঢাকা বিমানবন্দরের ভূমি স্পর্শ করে।”
এদিকে সেদিনেরই ওয়াশিংটন পোস্টে বঙ্গবন্ধুর ঢাকায় প্রত্যাবর্তন নিয়ে লেখা হয়েছে, “অ্যারাইভড অ্যাট ঢাকা এয়ারপোর্ট অন ১.৪৫ অ্যাবোর্ড আ ব্রিটিশ রয়্যাল এয়ারফোর্স কমেট। হি ফ্লিউ ফ্রম নিউ দিল্লি হোয়ার মেট উইথ প্রাইম মিনিস্টার ইন্দিরা গান্ধী অ্যান্ড প্রেসিডেন্ট ভি.ভি. গিরি অন হিজ ওয়ে হোম ফ্রম লন্ডন।”
বাংলাদেশের নির্বাচিত রাষ্ট্রপতিকে বন্দি রাখায় আরও নিন্দিত হয় পাকিস্তান। আন্তর্জাতিক চাপের কাছে নতি স্বীকার করে ৮ জানুয়ারি ১৯৭২, পাকিস্তানের নতুন সরকার বঙ্গবন্ধুকে মুক্তি দেওয়ার ঘোষণা দেয়। পাকিস্তানের নতুন প্রেসিডেন্ট জুলফিকার আলী ভুট্টো কারাগারে গিয়ে বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন এবং তার সঙ্গে সৌজন্যমূলক আচরণ করেন। বঙ্গবন্ধুর স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থার কথাও জানানো হয়।
বঙ্গবন্ধুর মুক্তির কথা রেডিও-র সংবাদে শোনার পর বাংলাদেশে আনন্দের বন্যা বয়ে যায়। ৮ জানুয়ারি সন্ধ্যা থেকে সারারাত মুক্তিযোদ্ধারা রাইফেল-স্টেনগানের ফাঁকা আওয়াজ করে আনন্দ-উল্লাস করেছিল। রাস্তায় নেমে এসেছিল লাখ লাখ মানুষ। ৯ জানুয়ারি জানা গিয়েছিল, বঙ্গবন্ধু পাকিস্তান থেকে সরাসরি বাংলাদেশে না এসে তিনি লন্ডনে যাচ্ছেন। ঢাকা বা দিল্লি না গিয়ে লন্ডনে যাওয়ার সিদ্ধান্ত ছিল তার জীবনের দ্বিতীয় সর্বশ্রেষ্ঠ সিদ্ধান্ত। বঙ্গবন্ধু ঢাকা না গিয়ে লন্ডনে গেলেন কেন? এ-সম্পর্কে লন্ডনে সাংবাদিক সুন্দর কাবাদি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের এক দীর্ঘ সাক্ষাৎকার নিয়েছিলেন। সেই সাক্ষাৎকারটির সার-সংক্ষেপ আজকের মানুষের সামনে তুলে ধরা অপ্রাসঙ্গিক বলে মনে করি না। লন্ডনে কেন- সুন্দর কাবাদির এ প্রশ্নের উত্তরে বঙ্গবন্ধু বলেন,
… বন্দি হিসেবে তার ঢাকায় যাওয়ার বদলে লন্ডনে না এসে উপায় ছিল না। তিনি ঢাকাতেই যেতে চেয়েছিলেন। কিন্তু ভুট্টো তাতে রাজি হননি। তাকে ভারতে যেতে দিতেও ভুট্টো নারাজ। ভুট্টো শেখ মুজিবকে তেহরান অথবা ইস্তাম্বুলে পাঠাতে চেয়েছিলেন। কিন্তু শেখ মুজিব ঐ দুই জায়গার কোনো জায়গাতেই যেতে রাজি হননি। ভুট্টোকে বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, তেহরান বা ইস্তাম্বুল যাওয়ার বদলে তিনি পাকিস্তানের কারাগারেই থাকবেন এবং এই সিদ্ধান্ত থেকে এতটুকু নড়বেন না। এরপরই ভুট্টো বঙ্গবন্ধুকে লন্ডনে পাঠাতে রাজি হলেন। আর এ-কারণেই বঙ্গবন্ধুর লন্ডনে আসা। ভুট্টো বঙ্গবন্ধুকে বলেছিলেন, পাকিস্তানের সঙ্গে বাংলাদেশের কোনোরকম একটা সম্পর্ক রাখা যায় কি না? বঙ্গবন্ধু তাকে বলেছিলেন, দেশে ফিরে সবার সঙ্গে আলোচনা না করে তিনি কোনো মন্তব্য করবেন না।
১৯৭২ সালের ৮ জানুয়ারিতে লন্ডনে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের বক্তব্য আমরা একটু দেখে নিতে পারি।
“…আজ আমি স্বাধীনতার অপরিসীম ও অনাবিল আনন্দ অনুভব করছি। এ মুক্তিসংগ্রামের চূড়ান্ত লক্ষ্য ছিল স্বাধীন সার্বভৌম গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ। আমার জনগণ যখন আমাকে বাংলাদেশের ‘রাষ্ট্রপতি’ হিসেবে ঘোষণা করেছে তখন আমি ‘রাষ্ট্রদ্রোহ’র দায়ে মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত আসামী হিসেবে একটি নির্জন ও পরিত্যক্ত সেলে বন্দি জীবন কাটিয়েছি।… পাকিস্তানি কর্তৃপক্ষ আমার বিরুদ্ধে বিচারের নামে প্রহসন অনুষ্ঠানের আয়োজন করে। শুনানি অর্ধেক সমাপ্ত হবার পর পাক কর্তৃপক্ষ আমার পক্ষ সমর্থনের জন্যে একজন আইনজীবী নিয়োগ করে। আমি কারাগারের অন্ধ প্রকোষ্ঠে ‘বিশ্বাসঘাতক’-এর কলঙ্ক নিয়ে মৃত্যুদণ্ডের জন্যে অপেক্ষা করছিলাম। কিন্তু সবচেয়ে বিস্ময়কর, আমার বিচারের জন্যে যে ট্রাইব্যুনাল গঠন করা হয়েছিল তার রায় কখনও প্রকাশ করা হবে না। সাবেক প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান বিচারের নামে প্রহসন অনুষ্ঠান করে আমাকে ফাঁসিকাষ্ঠে ঝুলানোর ফন্দি এঁটেছিলেন। কিন্তু ভুট্টো এই মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করতে অস্বীকার করেন। জনাব ভুট্টো আমাকে না বলা পর্যন্ত স্বাধীনতা সংগ্রামের বিজয় সম্পর্কে আমি কিছুই জানতাম না। জেলখানা এলাকায় বিমান আক্রমণের জন্যে নিষ্প্রদীপ জারি করার পর আমি ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধের কথা জানতে পারি। জেলখানায় আমাকে এক নিঃসঙ্গ ও নিকৃষ্টতম কামরায় বন্দী করে রাখা হয়েছিল যেখানে আমাকে তারা কোনো রেডিও, কোনো চিঠিপত্র দেয় নাই। এমনকি বিশ্বের কোথায় কী ঘটছে, তা জানতে দেয়া হয় নাই।”
৮ জানুয়ারি পাকিস্তান সময় দুপুর ৩টায় রেডিও পাকিস্তান ঘোষণা করে যে, শেখ মুজিবের ইচ্ছানুসারে একটি বিশেষ পাক-বিমানে তাকে লন্ডনে পৌঁছে দেওয়া হয়েছে। তিনি লন্ডনের ক্লারিজস হোটেলে অবস্থান করছেন।
ওই সময় বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরী বলেছিলেন, “বঙ্গবন্ধুকে যথাসম্ভব শীঘ্র লন্ডন থেকে ঢাকায় নিয়ে আসার আয়োজন করা হচ্ছে।” ‘আগামীকালের মধ্যে শেখ মুজিবকে বাংলাদেশের জনগণের মাঝে পৌঁছে দিতেই হবে’ বলে জনাব চৌধুরী উল্লেখ করেছিলেন। তিনি বলেছিলেন, ঢাকা বিমানক্ষেত্রটি এখনও আন্তর্জাতিক বিমান অবতরণের উপযোগী হয়নি। তাই লন্ডন থেকে ঢাকা যাওয়ার পথে হয়তো মাঝে কোথাও তার বিমান বদল করার প্রয়োজন হবে।
আমরা জেনে থাকব, বঙ্গবন্ধু প্রয়োজনের তুলনায় এক মিনিটও বেশি লন্ডনে থাকেননি। ব্রিটিশ সরকার তাকে আরামে রাখার জন্য যথাসম্ভব ব্যবস্থা করেছিল। ৪০ বছর আগে গান্ধীজিকে তারা যেভাবে গ্রহণ করেছিলেন, এবার শেখ মুজিবকেও তারা সেভাবে গ্রহণ করেছেন। যদিও ব্রিটিশ সরকারের একজন মুখপাত্র একদিন আগেই বলেছিলেন যে, শেখ মুজিব ব্রিটিশ সরকারের অতিথি নন; কিন্তু তবুও ব্রিটিশ সরকার তার প্রতি আতিথেয়তা দেখিয়েছেন এবং প্রধানমন্ত্রী হিথ তার ব্যবহারের জন্য রাজকীয় বিমানবাহিনীর একটি বিমান দিয়েছেন। বঙ্গবন্ধুকে প্রশ্ন করা হয়েছিল, ইয়াহিয়া খানের কাছে তিনি ধরা দিলেন কেন- অনেকে জিজ্ঞাসা করেছিলেন। কেন তিনি অজ্ঞাতবাসে গেলেন না- সে প্রশ্নও উঠেছিল।
জবাবে বঙ্গবন্ধু জানান, “আমি তাও অস্বীকার করেছি।” তিনি বলেছিলেন, যখন তার দেশবাসীরা বুলেটের আঘাতে প্রাণ দিচ্ছে তখন ভারতে পালিয়ে যাওয়াও তার কাছে ‘কাপুরুষতা’ বলে মনে হয়েছে।
এ প্রসঙ্গে একটা গুরুত্বপূর্ণ তথ্য প্রখ্যাত লোক গবেষক বাংলা একাডেমির চেয়ারম্যান অধ্যাপক শামসুজ্জামান খানের বই ‘বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে আলাপ এবং প্রাসঙ্গিক কথকতা’ থেকে জানতে পারি। ১৯৭৪ সালের দিকে বাংলা একাডেমির তৎকালীন মহাপরিচালক ড. মযহারুল ইসলাম, লেখক সাংবাদিক রাহাত খান, শামসুজ্জামান খান এবং বাংলা একাডেমির তৎকালীন সংস্কৃতি বিভাগের ম. জিল্লুর রহমান বঙ্গবন্ধুর সাথে দেখা করতে গিয়েছিলেন। সেখানে কথা প্রসঙ্গে বঙ্গবন্ধু যা বলেছিলেন তা খুবই প্রণিধানযোগ্য
“২৫শে মার্চ (১৯৭১) রাতে আমি গ্রেফতার হবার আগে স্বাধীনতার ঘোষণা দেই। পুলিশ হেডকোর্য়াটার্সের মাধ্যমে ওয়্যারলেসে সে ঘোষণা সব জেলা সদরে পাঠানো হয়। আমি বিভিন্ন চ্যানেলে ভারতের সঙ্গেও যোগাযোগ করে যাই। তা না হলে তোমরা অত সহজে অস্ত্র ও সাহায্য সহযোগিতা পেতে না।”
আমরা প্রশ্ন করলাম- কিন্তু আপনি কেন ওদের হাতে ধরা দিলেন। তিনি বললেন,
এ ব্যাপারে আমার বেশ ক’টি চিন্তা কাজ করেছে। এক. আমাকে ধরতে না পারলে ওরা আরও বেশি লোককে খুন করত; দুই. আন্তর্জাতিকভাবে আমরা বিচ্ছিন্নতাবাদী ও ভারতের ক্রীড়নক বলে প্রমাণিত হতাম এবং এতে আন্তর্জাতিক সহমর্মিতা কমতো এবং আরও বেশি দেশ আমাদের আন্দোলন সম্পর্কে সন্দেহ পোষণ করতো। আর একটা কথা বলি, তোমরা কীভাবে নেবে জানি না, প্রফেসর সাহেব আমার সঙ্গে একমত হবেন কি না তাও বলতে পারি না- তবে আমার সুদৃঢ় বিশ্বাস আমি পাকিস্তানিদের হাতে বন্দি থাকায় আমার দুঃখী বাঙালিদের মধ্যে দুশ্চিন্তা, উদ্বেগ যেমন বেড়েছে তেমনি মানুষ আমার অনুপস্থিতিতে আমার একটা বিশাল প্রতীক মনে মনে তৈরি করে নিয়েছে। এটা ছিল মুক্তিযুদ্ধের খুব বড়ো একটা শক্তি। আমি প্রবাসী সরকারে থাকলে শুধু প্রমাণ সাইজের মুজিবই থাকতাম। ওদের হাতে বন্দি থাকায় আমি এক মহাশক্তিধর ও বাংলাদেশের সকল মানুষের প্রাণপ্রিয় নেতার ভূমিকায় স্থান পাই। মানুষ আমার নাম নিয়ে হেলায় হেসে প্রাণ বিসর্জন দিয়েছে। কি অমোঘ অস্ত্র ছিল, ‘জয় বাংলা’ স্লোগান। ওরা যদি আমাকে মেরে ফেলতো, তাহলে আমি আরও বড়ো প্রতীকে পরিণত হতাম। বাংলার মানুষ আরও লড়াকু হয়ে যুদ্ধ করত।
বঙ্গবন্ধু আত্মমর্যাদার প্রশ্নে কখনই আপস করেননি। শেখ মুজিব স্পষ্ট করে বলেছিলেন যে, ভারতীয় সৈন্য বাংলাদেশে থাক বা না থাক, সেটা কারও দেখার দরকার নেই। সেটা শুধু তার দেশ আর ভারতের মধ্যকার ব্যাপার। কেউ যেন তাকে এ বলে হুমকি দেওয়ার সাহস না করে যে, তার দেশ থেকে ভারতীয় সৈন্য সরিয়ে না নিলে আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি দেওয়া হবে না। ব্ল্যাকমেলের কাছে নতিস্বীকার করার বদলে তিনি এইরকম স্বীকৃতি ছাড়াই থাকবেন। চীন বহু বছর স্বীকৃতি পায়নি। তাতে সেদেশের অবলুপ্তি ঘটেনি। বাংলাদেশ এখন একটা জীবন্ত শক্তি। গণতন্ত্র, ধর্মনিরপেক্ষতা ও সমাজতন্ত্রের আদর্শে বিশ্বাসী।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব লন্ডনে ১৫ ঘণ্টারও বেশি সময় ছিলেন। এর মধ্যে তিনি এতটুকু ঘুমোতে পারেননি, বিশ্রাম নিতে পারেননি। দেশের পরিস্থিতি নিরপেক্ষ তৃতীয় পক্ষের কাছ থেকে শোনার জন্য তিনি লন্ডনে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেন। ১৯৭২ সালের ৯ জানুয়ারি দৈনিক বাংলার সংবাদ বলছে-
বঙ্গবন্ধু বিমানবন্দরে সাংবাদিকদের বলেন, “আপনারা দেখতেই পাচ্ছেন আমি সুস্থ আছি, বেঁচে আছি। এ মুহূর্তে আপনারা শুধু আমাকে দেখুন, কিছু শোনার আশা করবেন না। আমি আর বেশি কিছু বলতে চাই না। সম্ভবত আজকের পরে একটা বিবৃতি দিতে পারি।”
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান রাওয়ালপিন্ডি থেকে পাকিস্তান সরকারের চার্টার করা পিআইএ-র একটি বিশেষ বিমানে লন্ডনের উদ্দেশ্যে রওনা হয়েছিলেন। রাওয়ালপিন্ডি ত্যাগের ১০ ঘণ্টা পর ৮ জানুয়ারি গ্রিনিচ সময় ৬টা ৩৬ মিনিট (বাংলাদেশ সময় ১২টা ৩৬ মিনিট) হিথ্রো বিমানবন্দরে পৌঁছে যান। লন্ডনের উদ্দেশ্যে রওনা হওয়ার সাত ঘণ্টা পর বিষয়টি জানাজানি হয় বলে সেই সময়ের পত্রিকাগুলো সংবাদ প্রকাশ করে। বঙ্গবন্ধু লন্ডনের পৌঁছে তিন ঘণ্টা বিমানবন্দরে অবস্থান করেন। তিন ঘণ্টা পর বঙ্গবন্ধু বিমানবন্দর থেকে ওয়েস্ট অ্যান্ড এর ক্লারিজস হোটেলের উদ্দেশে রওনা দিয়েছিলেন। গাড়িতে ওঠার সময় তিনি সামনে বসতে পারেন কি না জিজ্ঞেস করলে কর্মকর্তারা বলেন,“ অবশ্যই।” এ সময় তিনি সাংবাদিকদের সঙ্গে কোনো কথা বলেননি। পরবর্তীতে হোটেলে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সাংবাদিকদের মুখোমুখি হন।
তিনি বলেন, “আমি এখানে আর এক মুহূর্ত থাকতে রাজি নই, আমি আমার জনগণের কাছে ফিরে যেতে চাই।” বঙ্গবন্ধু সাংবাদিকদের জানান, তিনি আগামীকাল বা পরের দিন ঢাকা ফিরবেন আশা করছেন। বাংলাদেশ শিগগির জাতিসংঘে সদস্যপদের জন্য অনুরোধ করবেন। বাংলাদেশের দাবিকে সমর্থনের জন্য ভারত, সোভিয়েত ইউনিয়ন, পোল্যান্ড, ফ্রান্সকে ধন্যবাদ জানান। তিনি বলেছিলেন, “বাংলাদেশ এখন অবিসংবাদিত সত্য এবং এদেশকে বিশ্বের স্বীকৃতি দিতে হবে।”
বঙ্গবন্ধু দুঃখ করে বলেছিলেন, “যখন তার জনগণ তাকে প্রেসিডেন্ট হিসেবে ঘোষণা করেছে, তখন আমি ‘রাষ্ট্রদ্রোহের’ দায়ে মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত আসামি হিসেবে কারাগারে বন্দি জীবন কাটাচ্ছি। এই ট্রাইব্যুনালের বিচারের রায় কখনও প্রকাশ করা হয়নি। একটি খুব খারাপ স্থানে কল্পনাতীত একাকিত্বে বন্দিজীবন কাটাতে হয়েছে। কোনো রেডিও না, চিঠি না, বাইরের জগতের সঙ্গে কোনো যোগাযোগই ছিল না। মরার জন্য মনের দিক থেকে আমি প্রস্তুত ছিলাম। যেদিন জেলে নেওয়া হলো তখন আমি বাঁচবো কি না ধারণা ছিল না। তবে এটা জানতাম বাংলাদেশ মুক্ত হবেই। আমার দেশের লাখ লাখ লোককে হত্যা করা হয়েছে, নিষ্ঠুর অত্যাচার চালিয়েছে। বেঁচে থাকলে হিটলারও লজ্জা পেতো।”
১৯৭২ সালের ৮ জানুয়ারি লন্ডন থেকে টেলিফোনে বেগম ফজিলাতুন্নেছা মুজিবের প্রতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের প্রথম প্রশ্ন ছিল- “বেঁচে আছো তো?” ২৫ মার্চের দুর্বিষহ কালরাতের পর ৮ তারিখ (১৯৭২) প্রথমবারের মতো বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কথা শুরু করেন এইভাবে, “তোমরা সবাই বেঁচে আছো তো?”
সেই শনিবার সন্ধ্যার একটু আগে হোটেল থেকে পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে আধাঘণ্টা কথা বলেন। প্রথমে বড় ছেলে শেখ কামাল, পরে ক্রমান্বয়ে বেগম মুজিব, শেখ হাসিনা, শেখ রেহানা ও ছোট ছেলের সঙ্গে কথা বলেন। ঘটনাবহুল ও দুর্বিষহ ৯ মাস পর পরিবারের সদস্যরা পরস্পরের কণ্ঠ শুনতে পেয়েছিলেন। বেগম মুজিব আবেগঘন কণ্ঠে শুভেচ্ছা বিনিময় করেন। এনা পরিবেশিত খবর থেকে আমরা জানতে পারি-
বেগম মুজিব সাংবাদিকদের জানান, তিনি আবেগে এত অভিভূত হয়ে গিয়েছিলেন যে প্রথমবার কথা বলতে পারেননি।
দ্বিতীয়বার কল আসলে বঙ্গবন্ধু জানতে চান- “আমি কেমন আছি।” আমি বললাম, “আমরা ভালো আছি, আপনি কেমন আছেন?”
লন্ডনে থাকাকালেই ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের সঙ্গে কথা বলেছিলেন এবং নয়াদিল্লি সফরের আমন্ত্রণ জানান। ইন্দিরা গান্ধী শেখ মুজিবুর রহমানের কুশল জানতে চেয়ে বলেন, “আমরা খুবই খুশি আপনি মুক্তি পেয়েছেন।” শেখ মুজিবুর রহমান ইন্দিরা গান্ধীর মাধ্যমে ভারতের জনগণকে অভিনন্দন জানান। এরপর ইন্দিরা গান্ধী জানতে চান, “কেমন আছেন?” জবাবে বঙ্গবন্ধু বলেন, “আমি ভালো আছি। আমি আপনাদের কাছে খুবই কৃতজ্ঞ।” ৮ তারিখে তার কথা হয়েছিল সহযোদ্ধা তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদের সঙ্গে। বঙ্গবন্ধু টেলিফোনে যুক্ত হয়ে বলেন, “হ্যালো তাজউদ্দীন, আমি সাংবাদিক পরিবৃত আছি, তাদের কী বলবো? দেশের মানুষ কেমন আছে? বর্বর পাকিস্তানি বাহিনী কর্তৃক বাংলাদেশে যে অগণিত নারী-পুরুষ ও শিশু নিহত হয়েছেন, এই মুহূর্তে তাদের কথা আমার জানতে খুব ইচ্ছে করছে।”
দুই
ভারতের বাংলা ইংরেজি পত্রিকায় ১১ জানুয়ারি পত্রিকার পাতাজুড়ে ছিল বঙ্গবন্ধু স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের সংবাদ ও প্রতিবেদন। দিল্লির সংবর্ধনার আয়োজন ছিল আবেগ উচ্ছ্বাসের পরিপূর্ণতায় ভরপুর। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব ১০ জানুয়ারিতে লন্ডন থেকে নয়াদিল্লিতে এসে পৌঁছলেন। সে এক অভাবনীয় দৃশ্য। দিল্লিতে এমন সংবর্ধনা বঙ্গবন্ধুর পূর্বে আর কেউ পাননি বলে সংবাদপত্রের মত। দিল্লি থেকে ‘যুগান্তর’ জানিয়েছিল,
পাকিস্তানের অন্ধকার কারাগৃহে ৯ মাসের অধিককাল যাপনের পর স্বাধীন সার্বভৌম প্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি শেখ মুজিবুর রহমান আজ সকালে লন্ডন থেকে ব্রিটিশ বিমানবাহিনীর একটি কমেট বিমানে এখানে এসে পৌঁছুলে তাঁকে সর্বোচ্চ রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় বিপুল সংবর্ধনা জানানো হয়। স্বাধীনতার পর গত ২৫ বৎসর বহু রাষ্ট্রপ্রধানকে সংবর্ধনা জানানো হয়েছে, কিন্তু এমনটি আর কখনও দেখা যায়নি। এ যেন যুদ্ধজয়ের পর স্বদেশ প্রত্যাগত বীরের প্রতি সংবর্ধনা। অভ্যর্থনার স্বতঃস্ফূর্ততা ও আন্তরিকতার জন্য আজ দিনটি স্মরণীয়।… ২১ বার তোপধ্বনি করে তাঁকে অভ্যর্থনা জানানো হয়। মুজিব বিমান থেকে বেরিয়ে এলে সমবেত জনতার ‘জয় বাংলা’ ধ্বনিতে আকাশ-বাতাস মুখরিত হয়ে ওঠে। শেখ মুজিবের বিমানটি যখন অবতরণ করে তখন বিমানঘাঁটিতে ভারতের ত্রিবর্ণরক্ষিত জাতীয় পতাকা ও বাংলাদেশের সবুজ পটভূমিকায় লাল ও সবুজ রঙের জাতীয় পতাকা উড়ছিল। সেনাবাহিনীর ব্যান্ডে দুই দেশের জাতীয় সংগীত ‘জনগণ মন’ ও ‘সোনার বাংলা’ বাজতে থাকে। শেখ মুজিবের আগমনের পরে ভারতীয় স্থল, নৌ ও বিমানবাহিনীর ১৫০ জনের সম্মিলিত গার্ড অব অনার পরিদর্শন করে। বঙ্গবন্ধু ‘জয় বাংলা’, ‘জয় হিন্দ’ ধ্বনি দিয়ে তার প্রীতিভাষণ শেষ করেন। কূটনৈতিক প্রতিনিধিদের সঙ্গে পরিচয়পর্ব শেষ হওয়ার পর শেখ মুজিব ও ইন্দিরা গান্ধী ক্যান্টনমেন্ট এলাকায় প্যারেড গ্রাউন্ড অভিমুখে যাত্রা করেন। প্রচণ্ড শীতের মধ্যেও হাজার হাজার নর-নারী পথের দুপাশে দাঁড়িয়ে থেকে ‘জয় বাংলা’ ও ‘শেখ মুজিব জিন্দাবাদ’ ধ্বনিতে বঙ্গবন্ধুকে সংবর্ধনা জানান। বিমানঘাঁটি থেকে ২ কিলোমিটার দূরে প্যারেড গ্রাউন্ডে যখন প্রধানমন্ত্রী শ্রীমতী গান্ধীর সঙ্গে শেখ মুজিব এসে পৌঁছান তখন মুহুর্মুহু ‘জয় বাংলা’ ধ্বনিতে আকাশ-বাতাস মুখরিত হতে থাকে। বাংলাদেশের স্রষ্টার ভাষণ শোনার জন্য সমবেত হাজার হাজার নর-নারীর কণ্ঠে শুধু ‘মুুজিবুর রহমান জিন্দাবাদ’, ‘ইন্দিরা গান্ধী জিন্দাবাদ’ ধ্বনি শোনা যায়। বিমানঘাঁটিতে সোভিয়েত ইউনিয়ন, বুলগেরিয়া, চেকোস্লোভাকিয়া, মঙ্গোলিয়া, পূর্ব জার্মানি, ভুটানসহ বেশ কয়েকটি দেশের প্রতিনিধি উপস্থিত ছিলেন। বঙ্গবন্ধু তাঁর ভাষণ ইংরেজিতে শুরু করেন। তিনি ‘ম্যাডাম প্রাইম মিনিস্টার শ্রীমতী ইন্দিরা গান্ধী, লেডিস অ্যান্ড জেন্টলম্যান’ বলে তার বক্তৃতা শুরু করতেই জনতা শেখ মুজিবকে বাংলায় ভাষণ দেওয়ার অনুরোধ জানান। জনগণের ইচ্ছা অনুযায়ী তিনি তখন বাংলায় তাঁর ভাষণ দেন। এতে জনসাধারণ তাকে চিৎকার করে অভিনন্দন জানান। শেখ মুজিব ঘোষণা করেন, ভারত ও বাংলাদেশের মৈত্রী চিরস্থায়ী হবে। বাংলাদেশে পশ্চিম পাকিস্তানিরা যে পৈশাচিক ও কাপুরুষোচিত অত্যাচার চালিয়েছে ইতিহাসে কোনো শাসকের এরূপ জঘন্য অত্যাচারের কথা জানা যায়নি। তিনি আবেগরুদ্ধ কণ্ঠে বলেন, “বাংলাদেশ বলতে গেলে এক নারকীয় তা-বের মধ্য দিয়ে এগিয়ে গেছে।… এক কোটির বেশি মানুষ ভারতে আশ্রয় নিতে বাধ্য হয়েছে। ত্রিশ লক্ষ মানুষকে হত্যা করা হয়েছে। পুরুষদের সামনেই মা-বোনদের ওপর পাশবিক অত্যাচার চালানো হয়। কী অন্যায় করেছিল বাঙালিরা? তারা সম্মানের সঙ্গে বাঁচতে চেয়েছিল- এটাই ছিল তাদের অন্যায়। বাঙালিরা বাঁচতে চেয়েছিল কিন্তু তার জবাবে তারা পেয়েছে বুলেট। বাংলাদেশ এখন একটা স্বাধীন রাষ্ট্র এবং বাংলাদেশ ও ভারত চিরস্থায়ী বন্ধুত্বের বন্ধনে আবদ্ধ। এই দুটি দেশ চিরদিন শান্তি ও বন্ধুত্বের মধ্যে বসবাস করবে।”
শেখ মুজিব বলেন, “আমি জানি, ভারতের জনগণ খুব ধনী নন। কিন্তু তা সত্ত্বে তারা আমাদের লক্ষ লক্ষ মানুষকে আশ্রয়, আহার, বস্ত্র, চিকিৎসা দিয়েছেন।
কলকাতার একটি পত্রিকা বঙ্গবন্ধুর দিল্লিতে পৌঁছানোর সংবাদ ছাপালো। ‘অন্ধকার থেকে আলোকে, ভারতকে কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন’ শীর্ষক শিরোনামের সংবাদে বলা হয়,
বিশ্বের কনিষ্ঠতম স্বাধীন সার্বভৌম জাতির রাষ্ট্রপতি শ্রেষ্ঠতর বাঙালি শেখ মুজিবুর রহমানকে ভারত আজ জানিয়েছে অভূতপূর্ব রাজকীয় অভ্যর্থনা আর প্রতিশ্রুতি দিয়েছে ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যে অক্ষয় মৈত্রীবন্ধনের। ইতিহাসের বহু জয়-পরাজয় ও বহু উত্থান-পতনের সাক্ষী প্রাচীন দিল্লি নগরী বাংলাদেশের হৃদয়ের রাজা শেখ মুজিবুর রহমানকে যিনি আনুষ্ঠানিকভাবে এখনও রাষ্ট্রপতির আসন গ্রহণ করেননি- স্বাগত জানাতে গিয়ে আজও এক নতুন ইতিহাস সৃষ্টি করল। মানব-সভ্যতার দীর্ঘ ইতিহাসে সম্ভবত এই প্রথম বিদেশে মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিত এক চিরবিদ্রোহী জননেতা মুক্ত স্বদেশে ফেরার আগেই এক মিত্ররাষ্ট্রে পদার্পণ করলেন এবং তাদের হৃদয়ের সবটুকু উত্তাপ আপন হৃদয়ে তুলে নিয়ে স্বদেশের পথে যাত্রা করলেন। ব্রিটিশ রাজকীয় বিমানবাহিনীর একটি কমেট জেট বিমানে শেখ সাহেব আজ সকাল ৮টা বেজে ২ মিনিটে পালাম বিমানবন্দরে অবতরণ করলে রাষ্ট্রপতি শ্রী ভি.ভি. গিরি, প্রধানমন্ত্রী শ্রীমতী ইন্দিরা গান্ধী ও বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী আবদুস সামাদ আজাদ তাঁকে স্বাগত জানাতে এগিয়ে যান। সহস্র কণ্ঠে ‘জয় বাংলা’, ‘জয় হিন্দ’ ধ্বনিতে শীতের আকাশ…।
তিন
কেমন ছিল ১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারির দিনটি? বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের স্বদেশ প্রত্যাবর্তন প্রতিক্ষণের ধারা বর্ণনা দিয়েছিলেন আকাশবাণী’র দেবদুলাল বন্দ্যোপাধ্যায়, অসাধারণ আবেগময় কণ্ঠে গান গেয়েছিলেন গীতশ্রী সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়। সুধীন দাশগুপ্তের সুরে, আবিদুর রহমানের লেখা গান এখন ইউটিউবে পাওয়া যাচ্ছে।
“বঙ্গবন্ধু ফিরে এলে তোমার স্বপ্নের স্বাধীন বাংলায় তুমি আজ
ঘরে ঘরে এত খুশি তাই।
কী ভালো তোমাকে বাসি আমরা, বলো কী করে বোঝাই।
এদেশকে বলো তুমি বলো কেন এত ভালোবাসলে,
সাত কোটি মানুষের হৃদয়ের এত কাছে কেন আসলে,
এমন আপন আজ বাংলায়… তুমি ছাড়া কেউ আর নাই
বলো, কী করে বোঝাই।
সারাটি জীবন তুমি নিজে শুধু জেলে জেলে থাকলে
আর তবু স্বপ্নের সুখী এক বাংলার ছবি শুধু আঁকলে
তোমার নিজের সুখ-সম্ভার কিছু আর দেখলে না তাই
বলো কী করে বোঝাই।”
জেএন দীক্ষিত ছিলেন বাংলাদেশে নিযুক্ত ভারতের প্রথম কূটনৈতিক প্রতিনিধি এবং ডেপুটি হাইকমিশনার। পরবর্তীকালে নব্বইয়ের দশকের শুরুতে তিনি ভারতের পররাষ্ট্র সচিব নিযুক্ত হন। বাংলাদেশের স্বাধীনতার প্রথম তিন বছর ঢাকা থাকাকালীন তিনি বঙ্গবন্ধুকে কাছে থেকে দেখার সুযোগ পেয়েছিলেন। তিনি বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্কের ওপর ‘Liberation and Beyond’ শীর্ষক একটি বই রচনা করেছেন, যাতে তিনি বঙ্গবন্ধু ও বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্কের ওপর আগ্রহ-উদ্দীপক কিছু মন্তব্য করেছেন, যাতে দুই দেশের দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক সম্বন্ধে বঙ্গবন্ধুর অবস্থান ও মনোভাবের পরিচয় পাওয়া যায়।
দীক্ষিত তার বইয়ে লিখেছেন, “ঢাকায় বাংলাদেশ সরকার প্রতিষ্ঠার পরপরই ভারত বাংলাদেশকে দুটি সমুদ্রগামী জাহাজ এবং দুটি ফকার ফ্রেন্ডশিপ উড়োজাহাজ অনুদান হিসেবে দিতে চেয়েছিল। কিন্তু বাংলাদেশকে নিয়ে শেখ মুজিবের আত্মসম্মান এতই প্রবল ছিল যে তিনি এই বাহনগুলো অনুদান হিসেবে গ্রহণ না করে দীর্ঘমেয়াদি ঋণ নিয়ে ক্রয় করার ইচ্ছা প্রকাশ করেন।”
দীক্ষিত লিখেছেন, “বাংলাদেশ-ভারত দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কের সূচনাতেই শেখ মুজিব গঙ্গার পানি বণ্টন এবং ছিটমহল হস্তান্তরের প্রশ্নগুলো উত্থাপন করেন এবং ভারতের দখলিকৃত পাকিস্তানি সমরাস্ত্র এবং গোলাবারুদ বাংলাদেশকে ফেরত দেওয়ার কথাটি তোলেন এই যুক্তিতে যে সেগুলো বাংলাদেশের প্রাপ্য। তাছাড়া মুজিব এই যুক্তিও তুলে ধরেন যে বাংলাদেশ সামরিক বাহিনী পাকিস্তানি অস্ত্র ব্যবহারে অভ্যস্ত এবং তাই সেগুলো বাংলাদেশের সেই সময়কার অনিশ্চিত অভ্যন্তরীণ অবস্থা মোকাবিলায় সহায়ক হবে।”
দীক্ষিতের কথায়, যদিও শেখ মুজিব জানতেন যে বাংলাদেশের অস্তিত্বের সূচনার সেই দিনগুলোতে বাংলাদেশের ভারতীয় সাহায্য-সহায়তার প্রয়োজন, তবু তিনি চাইতেন না যে বাংলাদেশ ভারতের ওপর অতিরিক্ত মাত্রায় নির্ভরশীল হোক। ইতিহাসের পাঠকরা ভালো করেই জানেন বঙ্গবন্ধু ১৯৭২ সালের ৮ জানুয়ারি লন্ডনে আসার আগে জুলফিকার আলী ভুট্টো নানারকম আপস ফর্মুলা নিয়ে বৈঠকে করার চেষ্টা করেছিলেন। কোনোরকম একটা সম্পর্ক রাখা যায় কি না সেই চেষ্টাও করেছিল। কিন্তু বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের এ ব্যাপারে অবস্থান ছিল একেবারেই স্পষ্ট। ১১ জানুয়ারি ১৯৭২, দৈনিক পূর্বদেশ-এর প্রতিবেদনে স্পষ্ট উল্লেখ আছে, “জাতির জনক ও গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে বহন করেছিল ব্রিটিশ রাজকীয় বিমান বাহিনীর কমেট জেট বিমানটি। বাংলাদেশ সময় ১টা ৪১ মিনিটে বিমানটি ঢাকা বিমানবন্দরের ভূমি স্পর্শ করে।”
অনলাইন ইউটিউবে ‘বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান রেয়ার ফুটেজ’ শীর্ষক যুক্তরাষ্ট্রের আমেরিকান ব্রডকাস্টিং কর্পোরেশন বা এবিসি নিউজের ১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি সম্প্রচারিত ভিডিও ক্লিপটি রয়েছে (http://www.youtube.com/watch?v=vy3yYzeFOrA)। সেখানে টাইম টানেলে ক্রিস্টায়েন ক্লায়েন উপস্থাপিত ‘এবিসি ট্রাভেলস ব্যাক টু দিস ডে ইন হিস্ট্রি’ অর্থাৎ ইতিহাসের এ দিনের এবিসির ফিরে দেখা অংশ দেখানো হয়েছে। এতে দুই প্রখ্যাত সংবাদ পাঠক যথাক্রমে ওয়াশিংটন ডিসি থেকে হাওয়ার্ড কে স্মিথ ও নিউ ইয়র্ক থেকে হ্যারি রিজনার যুগপৎ ওই ঐতিহাসিক সংবাদ পরিবেশন করেছেন। তাতে সংবাদ শিরোনামে হ্যারি রিজনারের কণ্ঠে উচ্চারিত “মুজিবুর রহমান রিটার্নস হোম অ্যান্ড টেলস হিজ কান্ট্রিম্যান দ্যাট বাংলাদেশ উইল রিমেইন ইন্ডিপেনডেন্ট ফ্রম পাকিস্তান।”
অর্থাৎ “মুজিবুর রহমান দেশে ফিরে গেছেন এবং দেশবাসীকে জানিয়েছেন পাকিস্তান থেকে বাংলাদেশ স্বাধীন থাকবে।” এরপরই বিস্তারিত সংবাদ পরিবেশনায় হ্যারি রিজনার পড়েছেন, শেখ মুজিবুর রহমান আজ প্রেসিডেন্ট হিসেবে তার স্বদেশে ফিরে গেছেন। প্রতিবেদনে বলা হয়, পাকিস্তানের বন্দিত্ব থেকে মুক্তির পর শেখকে একটি ব্রিটিশ জেট লন্ডন থেকে দিল্লি হয়ে ঢাকা নিয়ে যায়। এবিসির রন মিলার সেই প্রত্যাবর্তন রিপোর্টটি পাঠিয়েছেন।
চার
১৯৬৯-৭২ সময়ে আমেরিকায় ডেভিড ফ্রস্ট শো বিভিন্ন টেলিভিশন স্টেশন থেকে প্রচারিত হতো। ডেভিড ফ্রস্ট (পরবর্তীতে স্যার উপাধি পান) তখন একইসঙ্গে লন্ডনে বিবিসিতে ও আমেরিকায় আকর্ষণীয় প্রোগ্রাম করতেন। ১৯৭২ সালে পাকিস্তান থেকে মুক্তি পেয়ে বঙ্গবন্ধু ঢাকা প্রত্যাবর্তন করে স্বাধীন বাংলার প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব নিলে ডেভিট ফ্রস্ট ঢাকায় এসে তার সাক্ষাৎকার নেন। ডেভিড ফ্রস্ট ‘প্রোগ্রাম ইন বাংলাদেশ’ শীর্ষক এক ঘণ্টাব্যাপী অনুষ্ঠানে এ সাক্ষাৎকার আমেরিকার অনেক টেলিভিশন স্টেশনে যথা WNEW নিউইয়র্ক বা WTTG ওয়াশিংটনে ১৮ জানুয়ারি প্রদর্শিত হয়। পুরো সাক্ষাৎকারটি ভারত সরকার প্রকাশিত বাংলাদেশ ডকুমেন্টস দ্বিতীয় খণ্ড সংকলনে আছে।
চুম্বক অংশ এখানে দেওয়া হলো-
শেখ মুজিব: ৪ঠা ডিসেম্বর (’৭১) ওরা আদালতের কাজ শেষ করে। সাথে সাথে ইয়াহিয়া খান সব বিচারক, যথা লেফটেন্যান্ট কর্নেল, ব্রিগেডিয়ার- এদের সব রাওয়ালপিন্ডি ডেকে পাঠালো রায় তৈরি করার জন্য। সেখানে ঠিক করল, ওরা আমাকে ফাঁসি দেবে।
ফ্রস্ট: আর তাই সেলের পাশে কবর খোঁড়া দেখে আপনি বুঝতে পেরেছিলেন, ওরা ওখানেই আপনাকে কবর দেবে?
শেখ মুজিব: হ্যাঁ, আমার সেলের পাশেই ওরা কবর খুঁড়ল। আমার চোখের সামনে।
ফ্রস্ট: আপনি নিজের চোখে তাই দেখলেন?
শেখ মুজিব: হ্যাঁ, আমি আমার নিজের চোখে দেখলাম, ওরা কবর খুঁড়ছে। আমি নিজের কাছে নিজে বললাম, ‘আমি জানি, এ কবর আমার কবর। ঠিক আছে। কোনো পরোয়া নেই। আমি তৈরি আছি।
ফ্রস্ট: ওরা কী আপনাকে বলেছিল, এ তো তোমার কবর?
শেখ মুজিব: না, ওরা তা বলেনি।
ফ্রস্ট: কী বলেছিল ওরা?
শেখ মুজিব: ওরা বলল, ‘না, না। তোমার কবর নয়। ধরো যদি বোম্বিং হয়, তাহলে তুমি এখানে শেল্টার নিতে পারবে।’
ফ্রস্ট: আপনি যখন দেখলেন, ওরা কবর খনন করেছে, তখন আপনার মনে কার কথা আগে জাগলো? আপনার দেশের কথা? না, আপনার স্ত্রী-পুত্র-পরিজনের কথা?
শেখ মুজিব: আমার প্রথম চিন্তা আমার দেশের জন্য। আমার আত্মীয়-স্বজনদের চাইতেও আমার ভালোবাসা আমার দেশের জন্য। আমার যা কিছু দুঃখ ভোগ, সে তো আমার দেশেরই জন্য। আপনি তো দেখেছেন, আমাকে তারা কি গভীরভাবে ভালোবাসে।
ফ্রস্ট: হ্যাঁ, এ কথা আমি বুঝি। স্বাধীনতার জন্য যুদ্ধরত বাংলাদেশের আপনি নেতা। আপনার প্রথম চিন্তা অবশ্যই আপনার দেশের চিন্তা। পারিবারিক চিন্তা পরের চিন্তা।
শেখ মুজিব: হ্যাঁ, জনতার প্রতিই আমার প্রথম ভালোবাসা। আমি তো জানি, আমি অমর নই। আজ কিংবা কাল, কিংবা পরশু আমাকে মরতে হবে। মানুষ মাত্রই মরতে হয়। কাজেই আমার বিশ্বাস, মানুষ মৃত্যুবরণ করবে সাহসের সঙ্গে।
ফ্রস্ট: কিন্তু ওরা তো আপনাকে কবর দিতে পারেনি। কে আপনাকে রক্ষা করেছিল সেদিন- আপনার ভবিতব্য থেকে।
শেখ মুজিব: আমার বিশ্বাস সর্বশক্তিমান আল্লাহই আমাকে রক্ষা করেছেন।
ফ্রস্ট: এমনকি শেষ মুহূর্তে ইয়াহিয়া খান যখন ভুট্টোর হাতে ক্ষমতা তুলে দেয়, তখনও না-কি সে ভুট্টোর কাছে আপনার ফাঁসির কথা বলেছিল? এটা কি ঠিক?
শেখ মুজিব: হ্যাঁ, ঠিক। ভুট্টো আমাকে সে কাহিনিটা বলেছিল। ভুট্টোর হাতে ক্ষমতা তুলে দেবার সময়ে ইয়াহিয়া বলেছিল, ‘মিস্টার ভুট্টো, আমার জীবনের সব চাইতে বড় ভুল হয়েছে, শেখ মুজিবুর রহমানকে ফাঁসি না দেওয়া।’
ফ্রস্ট: ইয়াহিয়া এমন কথা বলেছিল?
শেখ মুজিব: হ্যাঁ, ভুট্টো এ কথা আমায় বলে তার পরে বলেছিল, ‘ইয়াহিয়ার দাবি ছিল, ক্ষমতা হস্তান্তরের পূর্বে সে পেছনের তারিখ দিয়ে আমাকে ফাঁসি দেবে।’ কিন্তু ভুট্টো তার এ প্রস্তাবে রাজি হয়নি।
ফ্রস্ট: ভুট্টো কী জবাব দিয়েছিল? তার জবাবের কথা কি ভুট্টো আপনাকে কিছু বলেছিল?
শেখ মুজিব: হ্যাঁ, বলেছিল।
ফ্রস্ট: কী বলেছিল ভুট্টো?
শেখ মুজিব: ভুট্টো, ইয়াহিয়াকে বলেছিল : ‘না, আমি তা হতে দিতে পারি না। তাহলে তার মারাত্মক প্রতিক্রিয়া ঘটবে। এখন আমাদের ১ লাখ ৩ হাজার সামরিক বাহিনীর লোক আর বেসামরিক লোক বাংলাদেশ আর ভারতীয় বাহিনীর হাতে বন্দি রয়েছে। তাছাড়া ৫ থেকে ১০ লাখ অবাঙালি বাংলাদেশে আছে। মিস্টার ইয়াহিয়া, এমন অবস্থায় আপনি যদি শেখ মুজিবকে হত্যা করেন আর আমি ক্ষমতা গ্রহণ করি, তাহলে একটি লোকও আর জীবিত অবস্থায় বাংলাদেশ থেকে পশ্চিম পাকিস্তানে ফেরত আসতে সক্ষম হবে না। তার প্রতিক্রিয়া পশ্চিমা পাকিস্তানেও ঘটবে। তখন আমার অবস্থা হবে সংকটজনক।’ ভুট্টো এ কথা আমাকে বলেছিল। ভুট্টোর নিকট আমি অবশ্যই এ জন্যে কৃতজ্ঞ।
ফ্রস্ট: এটা একটি ক্ষুধার্ত নগরী; কিন্তু সুখী। আপনি কি জানেন আপনার কত টাকা প্রয়োজন?
শেখ মুজিব: এ-মুহূর্তে আমি বলতে পারব না। আমি কিছু বলতে পারব না। এখান থেকে চলে যাওয়ার সময় তারা ব্যাংক নোটগুলোও পুড়িয়ে দিয়ে যায়। ব্যাংকের টাকা নিয়ে নেয় এবং আত্মসমর্পণের আগে পুড়িয়ে দেয়।
সূত্রঃ বিডিনিউজ