অনলাইন ডেস্কঃ
“পুইড়া অঙ্গার হয়া রইছেরে ভাই। দেহ একেকটা এত্তটুকু হইয়া ডেবরিজের তলায় তলায় পইড়া ছিল। কী যে কষ্ট পায়্যা মরছে মানুষগুলান।”
এই ভাষ্য ফায়ার সার্ভিসের সহকারী পরিচালক মনির হোসেনের। নরককুণ্ডে পরিণত হওয়া হাসেম ফুডস কারখানায় আটকে পড়া মানুষগুলোকে উদ্ধারের জন্য ২১ ঘণ্টার বেশি সময় চেষ্টা চালিয়ে তাদের পোড়া লাশ উদ্ধারের কষ্ট ছিল তার কণ্ঠে।
কিন্তু ওই কারখানার বাইরে জড়ো হওয়া স্বজনদের বুকে যে কষ্টের তুফান তখন চলছে, তার সান্ত্বনা কোনো কিছুতেই হয় না।
ইয়াসিন রিপন নামে এক শ্রমিকের মা নাজমা বিলাপ করতে করতে বলছিলেন, “কোনো বিচার নাই, কোনো বিচার নাই গো। আমি কারো কাছে হাত পাতি নাই, ছেলেরে এসএসসি পাস করাইছি। আমার বাবার কোনো খবর নাই গো।”
নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জের ওই কারখানা থেকে শুক্রবার দুপুরে ৪৮টি বডিব্যাগে ভরে কয়লা হয়ে যাওয়া লাশগুলো পাঠানো হয় ঢাকা মেডিকেল কলেজের মর্গে। আগের রাতে মারা গিয়েছিলেন আরও তিনজন।
কিন্তু বেশিরভাগ মৃতদেহ পুড়ে এতটাই বিকৃত হয়ে গেছে যে ডিএনএ পরীক্ষা ছাড়া তাদের পরিচয় জানারও উপায় নেই। ফলে স্বজন হারানো মানুষগুলোকে লাশ বুঝে পেতেও আরও সপ্তাহ তিনেক অপেক্ষা করতে হবে।
সজীব গ্রুপের ওই কারখানায় তৈরি হতো সেজান জুস, নসিলা, ট্যাং, কুলসন ম্যাকারনি, বোর্নভিটার মত জনপ্রিয় সব খাদ্যপণ্য, সারা দেশের মানুষ যা চেনে, শিশুরা পছন্দ করে খায়।
অগ্নিকাণ্ডের পর স্বজনদের কথায় জানা গেল, বিভিন্ন বিদেশি কোম্পানির অনুমোদন নিয়ে তাদের ব্র্যান্ড নেইম ব্যবহার করে এসব পণ্য তৈরির কাজে শিশু শ্রমিকদেরও ব্যবহার করা হতো।
আর ফায়ার সার্ভিসের কর্মকর্তারা জানালেন, ৩৫ হাজার বর্গফুট আয়তনের ছয়তলা ওই কারখানা ভবনে অগ্নি নিরাপত্তার পর্যাপ্ত ব্যবস্থা তারা দেখেননি; জরুরি বের হওয়ার প্রয়োজনীয় সংখ্যক পথও সেখানে ছিল না।
ছাদে ওঠার দুটি সিঁড়ির মধ্যে একটি আবার ছিল তালা মারা, যেটি খোলা থাকলে অনেক মানুষের প্রাণ বাঁচানো যেত বলে ফায়ার সার্ভিসের উপ-পরিচালক দেবাশিষ বর্ধনের বিশ্বাস।
কদিন আগেই মগবাজারে এক বিস্ফোরণে কয়েকজনের প্রাণ গেল। একইভাবে হাজারো মানুষের প্রাণ গেছে তাজরীন ফ্যাশনস, রানা প্লাজা, নিমতলী কিংবা চুড়িহাট্টায়। প্রতিবার প্রাণহানির পর বেরিয়ে এসেছে হাজারো অনিয়ম আর অবহেলার কথা। কিন্তু স্বজনহারা মানুষের কান্না ফিরে ফিরে আসে।
সজীব গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক আবুল হাসেম অবশ্য অভিযোগ স্বীকার করতে চান না। অর্ধশত মৃত্যুর দায়ও তিনি নিতে রাজি নন।
বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, “এই কারখানা কম্পাউন্ডে আমরা ৭০০ কোটি টাকা বিনিয়োগ করেছি। দুই হাজারের বেশি শ্রমিকের সেখানে কর্মসংস্থান হয়েছে। নিয়মকানুন মেনেই আমরা ব্যবসা করছি। কিন্তু শেষ জীবনে এসে বড় পরীক্ষার মুখে ফেলে দিল এই অগ্নিকাণ্ড।”
হাসেম ফুডসে অগ্নিকাণ্ডে অর্ধশত মৃত্যু
লাফিয়ে প্রাণ বাঁচানোর চেষ্টা
ঢাকা-সিলেট হাইওয়ের পাশেই রূপগঞ্জের কর্ণগোপ এলাকায় বিশাল এলাকা জুড়ে হাসেম ফুডসের কারখানা।
সজীব গ্রুপের প্রশাসনিক কর্মকর্তা সালাহ উদ্দিনের ভাষ্য, বৃহস্পতিবার বিকাল সাড়ে ৫টার দিকে কারখানায় যখন আগুনের সূত্রপাত হলো, বিভিন্ন সেকশনে তখন ১৮০ থেকে ১৯০ জনের মতো কাজ করছিলেন।
মুহূর্তে আগুনের শিখা চারদিকে ছড়িয়ে পড়ে। ছয়তলা ওই কারখানার নিচতলা, তৃতীয় ও চতুর্থ তলায় আগুন জ্বলতে থাকে। ঘটনাস্থলে এসে আগুন নেভাতে কাজ শুরু করে ফায়ার সার্ভিসের ১৮টি ইউনিটের শতাধিক কর্মী।
ওই কারখানার ভেতরে কত শ্রমিক আটকা পড়েছিল, তখনও কেউ জানে না। রাতেই স্বপ্না রানী (৩৪) ও মিনা আক্তার (৩৩) নামে দুই শ্রমিকের মৃত্যুর কথা জানান নারায়ণগঞ্জের পুলিশ সুপার জায়েদুল আলম। ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নেওয়ার পর মোরসালিন (২৮) নামে আরেকজনের মৃত্যু হয়।
ফায়ার সার্ভিস কর্মীরা মই দিয়ে কারখানার ছাদ থেকে ২৫ জনকে নামিয়ে আনেন। কিন্তু তার আগেই বাঁচার আশায় ভবন থেকে লাফিয়ে পড়ে আহত হন বহু শ্রমিক। তাদের কেউ কেউ দগ্ধও ছিলেন।
এরকম ৩৫ জনকে উদ্ধার করে রূপগঞ্জের কর্ণগোপ ইউএস-বাংলা হাসপাতাল, ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল এবং শেখ হাসিনা জাতীয় বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটে পাঠানো হয়।
ফায়ার সার্ভিস অ্যান্ড সিভিল ডিফেন্স নারায়ণগঞ্জ অফিসের উপ-সহকারী পরিচালক আব্দুল্লাহ আল আরেফীন জানান, তাদের ১৮টি ইউনিট সারা রাত কাজ করে ভোরের দিকে আগুন প্রায় নিয়ন্ত্রণে এনেছিল। কিন্তু সকালে ভেতরে আবার আগুন বেড়ে যায়।
সকাল সোয়া ১০টার দিকে ছয়তলা কারখানা ভবনের পঞ্চম ও ষষ্ঠ তলার সামনের দিকে আগুন জ্বলতে দেখা যায়।
দুপুরের আগে আগে কারখানার নিচে হতবিহ্বল চেহারায় বসে ছিলেন বেঁচে যাওয়া শ্রমিকদের একজন রাজীব। তবে ওই কারখানায় কাজ করা নিজের স্ত্রীর খোঁজ তিনি তখনও পাননি।
রাজীব জানান, সাড়ে ৫টার দিকে তাদের শিফট ছুটি হয়, সবাই বের হবো হবো করছে। তখনই হঠাৎ আগুন লাগে কারখানায়।
“হঠাৎ শুনলাম কার্টন সেকশনে আগুন লাগছে। সেই আগুন পুরা বিল্ডিংয়ে ছড়ায়ে গেল। আর মানুষ লাফায় লাফায়া পড়তেছে। কত মানুষ লাফায় পড়ছে.., পানি দেয় নাই, কেউ পানি দেয় নাই।”
রাজীব তখন কারখানার নিচতলায়, সেখানে তখনও আগুন লাগেনি। কিন্তু তার স্ত্রী ভবনের চতুর্থ তলায়, নসিলা সেকশনে। তার খোঁজ জানতে রাজীব ফোন দেন ওই সেকশনের এক কর্মকর্তাকে।
“নসিলা সেকশনে মাহবুব স্যাররে ফোন দিছি, উনি কয়, ‘আমরা গ্যাসে কেউ কিছু দেখতে পারতাছি না, আমাদের একটু সাহয্য কর।’ আমার বউ ওইহানেই কাজ করে। আমি কই, স্যার আমার বউ কই? কয়, ‘সবাই আমরা এক জায়গায়’।
“এর পরে দিয়া এই যে ফোন বন্ধ, আর কেরো নাম্বার খোলে না, কেরো নাম্বার খোলে না…।
বলতে বলতে কান্নায় ভেঙে পড়েন রাজীব।
পাশ থেকে একজন বল্লেন উপরের ফ্লোরগুলোতে যারা ছিলেন, তাদের অনেকে লাফিয়ে নামার চেষ্টা করলেও চতুর্থ তলার সিঁড়ির কলাপসিবল গেইটে তালা মারা থাকায় সেখানে আটকে পড়া মানুষগুলো লাফও দিতে পারেননি।
ফায়ার ইঞ্জিনের শব্দ, বিক্ষুব্ধ শ্রমিক আর স্বজনদের তাড়াতে পুলিশের বাঁশি, চিৎকার আর বিলাপের শব্দ শুক্রবার দিনভর ঘুরপাক খেতে থাকে হাসেম ফুডস কারখানার প্রাঙ্গণে।
মাঝেমধ্যেই ভেসে আসে কারও কান্নার শব্দ। শব্দের উৎস খুঁজতে গিয়ে দেখা যায় পুলিশ ব্যারিকেডের ওপার থেকে নিখোঁজ ভাইয়ের জন্য কেঁদে উঠেছেন কোনো শ্রমিক।
নিখোঁজ শ্রমিকদের খোঁজে আসা স্বজনদের ভিড়ের মধ্যে দুপুরে কারখানা চত্বরে ঢুকতেও বেগ পেতে হয়। তাদের কেউ কাঁদছিলেন, কেউ ফুঁসছিলেন ক্ষোভে।
কয়েক ঘণ্টা আগেই সেখানে একচোট বিক্ষোভ-ভাঙচুর আর পুলিশের সাথে ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়া হয়েছে। কারখানা চত্বরে পড়ে থাকা কাচের টুকরো, ঢিল আর ভেঙেচুড়ে উল্টে থাকা গাড়ি সেই চিহ্ন বহন করছিল।
কারখানা চত্বরে পাশাপাশি চারটি ভবন, পাশের একটি টিনশেডে গাদা করে রাখা হয়েছে বিভিন্ন কাঁচামাল আর রাসায়নিক। জুস আর নসিলার পাশাপাশি চকলেট, সেমাই, বিস্কুট, চানাচুর, জেলিসহ বিভিন্ন পণ্য তৈরির কাজে লাগে সেসব।
যে ভবনে আগুন লেগেছে সেটি ছয়তলা। শ্রমিকদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেল, ভবনের নিচতলায় কার্টন আর প্যাকেট তৈরি হতো। দোতলায় বিস্কুট সেকশন, তিনতলায় তৈরি হত লাচ্ছি, ড্রিংক, চারতলায় নসিলা আর ললিপপ।
পঞ্চম তলার একপাশে গুদাম। আরেক পাশে সেমাই তৈরি করে ভাজা হতো। ষষ্ঠ তলায় তৈরি হতো চানাচুর, বুটসহ বিভিন্ন ভাজা খাবার।
কারখানার ফটকেই চেয়ার-টেবিল নিয়ে বসেছিলেন রূপগঞ্জ থানার এসআই মিন্টু। তিনি নিখোঁজ শ্রমিকদের তালিকা করছিলেন। বেলা পৌনে ২টার সময়ই সেই তালিকায় ৪৮ জনের নাম লেখা হয়ে গেছে। নাম লেখা শেষে কাউকে চত্বরে দাঁড়াতে দেওয়া হচ্ছিল না।
বেলা ১২টার আগেই শ্রমিকদের মধ্যে খবর ছড়িয়ে পড়ে, ভবনের ভেতরে লাশ স্তূপ হয়ে রয়েছে। তারা বিক্ষুব্ধ হয়ে উঠলে ঢাকা-সিলেট মহাসড়কে যান চলাচল বন্ধ করে দেয় পুলিশ।
বেলা দেড়টার দিকে ভবনের ওপর থেকে লাশ নামানো শুরু করেন ফায়ার সার্ভিসের কর্মীরা। তারা একটি করে বডি ব্যাগ নামাচ্ছিলেন, আর আঙুলে গুনে সাংবাদিকেরা সেই হিসাব রাখছিলেন।
ফায়ার সার্ভিসের উপ-পরিচালক দেবাশীষ বর্ধন বললেন, কার লাশ, কী তার পরিচয় সেসব জানার কোনো সুযোগই আপাতত নেই।
“পুড়ে অঙ্গার হয়ে রয়েছে, চেনার কোনো সুযোগ নেই। লাশগুলোর পরিচয় পেতে ডিএনএ টেস্টের মধ্য দিয়ে যেতে হবে।”
৪৮টি বডি ব্যাগে ভরে লাশ পাঠিয়ে ফায়ার সার্ভিসের কর্মীদের কয়েকটি দল ওপর থেকে নেমে আসেন। আগের সন্ধ্যা থেকে কাজ করেছেন তাদের কেউ কেউ। সারা শরীর ভেজা। নিচে নেমেই জুতা খুলে শুয়ে পড়লেন কয়েকজন। দীর্ঘক্ষণ ভিজে সাদা হয়ে কুঁচকে গেছে পায়ের পাতা।
তবু নেভেনি আগুন
ফায়ার সার্ভিসের বড় মইবাহী গাড়িটার ইঞ্জিন (স্নোরকেল ল্যাডার) সারাদিন ঘড়ঘড় করে চলতে চলতে বিকেলের দিকে তেলের অভাবে বন্ধ হয়ে যায়। তখনও ছয়তলা ভবনটির হাঁ করে থাকা পোড়া জানালা দিয়ে আগুনের শিখা দেখা যাচ্ছিল। ততক্ষণে ২৪ ঘণ্টা পেরিয়ে গেছে।
সেই আগুন ধিকি ধিকি জ্বলছিল রাত ১১টার পরও। ফায়ার সার্ভিস কর্মীদেরও কাজ চালিয়ে যেতে হচ্ছিল। কিন্তু পঞ্চম তলার ছাদ খসে পড়ায় ষষ্ঠ তলায় খুব সাবধানে তল্লাশি চালাতে হচ্ছে তাদের।
ফায়ার সার্ভিসের মহাপরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল সাজ্জাদ হোসেন রাত সাড়ে ১১টার দিকে টেলিফোনে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বললেন, “আগুন এখনো পুরোপুরি নেভেনি। ফ্লোরো গার্বেজ আছে অনেক, সেখানে কিছু রয়ে গেল কিনা তা দেখতে আগামীকাল পর্যন্ত লাগবে।”
এই আগুনের সূত্রপাত কীভাবে হলো, সে বিষয়ে কোনো ধারণা এখনও পাওয়া যায়নি বলে জানালেন মহাপরিচালক।
বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে তিনি বলেন, পরিচালক (অপারেশন) লেফটেন্যান্ট কর্নেল জিল্লুর রহমানকে প্রধান করে ৫ সদস্যের একটি তদন্ত কমিটি করেছেন তারা। সাত দিনের মধ্যে কমিটিকে প্রতিবেদন দিতে বলা হয়েছে।
“শনিবার কারখানা সম্পূর্ণভাবে নিয়ন্ত্রণে আসার পর আমাদের কার্যক্রমের সমাপ্তি ঘোষণা করা হবে।”
নারায়ণগঞ্জ জেলা প্রশাসনও সাত সদস্যের একটি তদন্ত কমিটি করেছে। অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (সার্বিক) শামীম বেপারীকে প্রধান করে গঠিত ওই কমিটিকেও প্রতিবেদন দিতে সাত দিন সময় দেওয়া হয়েছে।
জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে মৃতদের প্রত্যেকের পরিবারকে ২৫ হাজার টাকা এবং আহতের ১০ হাজার টাকা করে দেওয়ার সিদ্ধান্ত হয়েছে বলে শামীম বেপারী জানিয়েছেন।
ফায়ার সার্ভিসের পরিচালক (অপারেশন্স) লেফটেন্যান্ট কর্নেল জিল্লুর রহমান ঘটনাস্থলে সাংবাদিকদের বলেন, ভবনটির যে আয়তন, তাতে পাঁচটি সিঁড়ি থাকা দরকার ছিল।
“অথচ আমরা পেলাম মাত্র দুটি এক্সিট। এর মধ্যে প্রথম এক্সিট ছিল আগুনের মধ্যে। শুরুতেই সেটি বন্ধ হয়ে যায়। ফলে সেখানে কেউ যেতে পারেনি।”
ভবনটিতে ফায়ার সেইফটি ইকুইপমেন্ট কী কী দেখেছেন এবং তা পর্যাপ্ত ছিল কিনা এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, “এখন পর্যন্ত তেমন কিছু দেখতে পাইনি। সেরকম কোনো বিষয় চোখে পড়েনি।
“যখন ফাইনালি তদন্ত করব, তখন চেক করব বাংলাদেশ ন্যাশনাল বিল্ডিং কোড- বিএনবিসি অনুযায়ী ভবনটিতে অগ্নি নিরাপত্তা সরঞ্জাম ছিল কিনা কিংবা আগুন লাগলে ভবনের আয়তন অনুযায়ী এক্সিট ছিল কিনা, যা দিয়ে কর্মকর্তা-কর্মীরা নিরাপদে বের হতে পারেন।”
বড় আকারের এই ভবনের ছয়টি ফ্লোরের বিভিন্ন অংশে গুদাম ছিল জানিয়ে জিল্লুর রহমান বলেন, “টপ টু বটম কাঁচামাল জমা ছিল। ফ্লোরগুলোর কোনো অংশে ফাঁকা বা খালি স্থান রাখা হয়নি। এ কারণে পানি সব কর্নারে পোঁছাতে পারেনি।”
ফায়ার সার্ভিসের উপ-পরিচালক দেবাশিষ বর্ধন সাংবাদিকদের বলেন, “আমরা গাড়ির মই সেট করে ছাদ থেকে ২৫ জনকে উদ্ধার করেছি। বাকিরা যদি ছাদে উঠতে পারত, আমরা কিন্তু বাঁচাতে পারতাম।”
তিনি বলেন, চতুর্থ তলায় যারা ছিলেন, সেখান থেকে ছাদে যাওয়ার সিঁড়ি তালাবন্ধ ছিল। আর নিচের দিকে সিঁড়ির ল্যান্ডিংয়ে ছিল ভয়াবহ আগুন।
কারখানা প্রাঙ্গণে থাকা শ্রমিক আর স্বজনরা জানালেন, হাসেম ফুডসে শিশু শ্রমিকদেরও কাজে লাগানো হতো কম মজুরি দেওয়া যায় বলে।
১৪ হাজার টাকা বেতনে কারখানায় সিনিয়র চকলেট অপারেটর হিসেবে কাজ করেন পরিমল রায়। তার কাজ চতুর্থ তলায়, নাইট শিফটে। কারখানার পাশেই একটি ভাড়া বাসায় থাকেন তিনি। বৃহস্পতিবার বিকালে তিনি যখন কারখানায় যাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছেন, তখনি আগুন লাগে।
কারখানায় ছোটদের কী ধরনের কাজ করানো হত সেই বিবরণ দিয়ে তিনি বলেন, “এখানে অনেক খাবার মোড়কজাত করতে হয়। ছোটরা মূলত খাদ্যপণ্যগুলো মোড়কে মোড়াত। তাদের বেশিরভাগের কাজ ডে শিফটে।”
১৪ বছরের মেয়ে ফারজানার ছবি নিয়ে কারখানা প্রাঙ্গণে ঘুরছিলন ঝরণা বেগম। তিনি জানালেন, তার কিশোরী মেয়ে গত তিন বছর ধরে পাঁচ হাজার টাকায় এ কারখানায় কাজ করছিল। আগুন লাগার পর থেকে মেয়ের খোঁজ পাননি তিনি।
কিশোর-কিশোরীদের কারখানার কাজে লাগানোর বিষয়ে প্রশ্ন করলে সজীব গ্রুপের প্রশাসনিক কর্মকর্তা সালাহ উদ্দিন বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, কম বয়সী যারা কারখানায় আছে, কাজ নেওয়ার সময় তারা বয়স ‘আঠারোই বলেছে’।
“কিছু আছে হেলপারি করার জন্য। কিন্তু ওরা কাজ নেওয়ার সময় আমাদের কাছে যে ডকুমেন্টস দিয়েছে, সেখানে ১৮ বছর পূর্ণ রয়েছে। কিছু ছেলেদের দেখলে মনে হতে পারে ১৮ বছরের কম হতে পারে। কিন্তু ডকুমেন্টস দিয়ে (১৮ বছর) ভর্তি হয়েছে।”
মালিক কী বলছেন?
এক সময় আমদানি করা পণ্য বিপণনের ব্যবসায় যুক্ত থাকলেও ২০০০ সালে নারায়ণগঞ্জে কারখানা স্থাপনের মাধ্যমে নিজস্ব উৎপাদন ব্যবস্থা শুরু করে সজীব গ্রুপ। সেজান, সজিব, কুলসন, নসিলাসহ ১১টি ব্র্যান্ড নামে বিভিন্ন খাদ্যপণ্য রয়েছে তাদের। কিছু পণ্য রপ্তানিও করা হয়।
কোম্পানির চেয়ারম্যান ও এমডি হলেন মো. আবুল হাসেম। তার ছেলে হাসিব বিন হাসেম ডেপুটি ম্যানেজিং ডিরেক্টর। কোম্পানির ওয়েবসাইটে দাবি করা হয়েছে, সজীব গ্রুপ বাংলাদেশের অন্যতম শীর্ষ ব্যবসায় গোষ্ঠী।
ফুড অ্যান্ড বেভারেজ ছাড়াও, কৃষিপণ্য প্রক্রিয়াজাতকরণ, আবাসন, বীমা, তৈরি পোশাক, টেলিকম আর ইলেক্ট্রনিক মিডিয়ার ব্যবসা রয়েছে এ কোম্পানির।
রূপগঞ্জের কম্পাউন্ডে যে ভবনটিতে আগুন লেগেছে, সেটা নির্মাণ করা হয় চার বছর আগে। পুরো কম্পাউন্ডের সবগুলো ইউনিট মিলিয়ে আগে প্রতি শিফটে ৭০০ শ্রমিক কাজ করেলেও লকডাউনের মধ্যে কর্মী সংখ্যা ‘কম ছিল’ বলে চেয়ারম্যানের ভাষ্য।
বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের প্রশ্নের উত্তরে তিনি দাবি করেন, কারখানার যে সেকশনে আগুনের সূত্রপাত হয়েছিল, সেটি তখন বন্ধ ছিল। সে কারণে বুঝে ওঠার আগেই তা ছড়িয়ে পড়ে।
সব নিয়ম মেনেই ওই ভবন তৈরি করা হয়েছে দাবি করে আবুল হাসেম বলেন, “আমরা একজন খ্যাতনামা প্রকৌশলীর তত্ত্বাবধানে তার নির্দেশনা মেনে এই ভবন নির্মাণ করেছি। দুর্ভাগ্য যে, তিনি কিছুদিন আগে পরলোক গমন করেছেন। তাদের গাইডলাইন নিয়েই এটা করা হয়েছে সব নিয়মকানুন মেনে। ওখানে দুটা বড় বড় সিঁড়ি করা হয়েছে।”
অগ্নিনিরাপত্তার বিষয়ে ফায়ার সার্ভিসের সনদ নেওয়া হয়েছিল কিনা জানতে চাইলে তিনি বলেন, “ফায়ারের অনুমোদন নেওয়ার কথা। সেটা আমার ব্যবস্থাপনার লোকজন ভালো বলতে পারবে। আমি আশা করছি ফায়ারের অনুমোদন ছাড়া এতো বড় ভবন হওয়ার কথা না। অন্যান্য সব কর্তৃপক্ষের অনুমোদন নিয়েই করা হয়েছে।”
আর শ্রম প্রতিমন্ত্রী বেগম মন্নুজান সুফিয়ান শুক্রবার ঘটনাস্থল ঘুরে দেখে বলেছেন, অগ্নিকাণ্ডে কারো কোনো গাফিলতি থাকলে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। এ বিষয়ে একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হবে।
“এই কারখানায় কোনো শিশু শ্রম ছিল কিনা তা খতিয়ে দেখা হবে। যদি প্রমাণ পাওয়া যায়, তাহলে শ্রম আইন অনুযায়ী ব্যবস্থা নেয়া হবে।”
অগ্নিকাণ্ডে নিহত শ্রমিকদের পরিচয় নিশ্চিত হওয়ার পর প্রত্যেকের স্বজনকে ‘শ্রমিক কল্যাণ ফাউন্ডেশন’ তহবিল থেকে ২ লাখ টাকা এবং শনিবার আহতদের ৫০ হাজার টাকা করে চিকিৎসা সহায়তা দেওয়া হবে জানান তিনি।
সূত্রঃ বিডিনিউজ