অনলাইন ডেস্কঃ
করোনাভাইরাসের প্রতিরোধক টিকা দেওয়ার পরিকল্পনায় পরিবর্তন আনার কথা ভাবছে সরকার। সরকারি হাসপাতাল থেকে টিকাকেন্দ্র অন্যত্র স্থানান্তর করা হবে। হাসপাতালগুলোর ওপর চাপ কমিয়ে চিকিৎসাসেবা স্বাভাবিক রাখতে এ সিদ্ধান্ত নেওয়া হচ্ছে বলে স্বাস্থ্য বিভাগ সূত্র সমকালকে নিশ্চিত করেছে। সেক্ষেত্রে রাজধানী ঢাকায় কেন্দ্র স্থানান্তর করা হবে মেডিকেল কলেজগুলোতে। দেশের অন্যান্য সিটি করপোরেশন এলাকায় মেডিকেল কলেজে সংকুলান না হলে স্কুল, কলেজ ও কমিউনিটি সেন্টারে টিকাকেন্দ্র স্থাপন করা হবে। গ্রাম ও ইউনিয়ন পর্যায়ে স্কুল, ইউনিয়ন পরিষদ কার্যালয়, কমিউনিটি ক্লিনিক কার্যালয়ে টিকাদান করা হবে।
স্বাস্থ্য বিভাগের একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা সমকালকে বলেন, বর্তমানে সারাদেশে সরকারি হাসপাতালগুলোতে করোনাভাইরাসের প্রতিরোধক টিকাদান কার্যক্রম চলছে। এর মধ্যে অনেক হাসপাতাল কভিড-১৯ ডেডিকেটেড। বাকি হাসপাতালে অন্যান্য রোগী চিকিৎসা নেন। পাশাপাশি হাসপাতালে টিকা গ্রহণকারী ব্যক্তিরা ভিড় করেন। ফলে চাপ সামলাতে হিমশিম খাচ্ছেন চিকিৎসক, নার্স ও স্বাস্থ্যকর্মীরা। হাসপাতালে চিকিৎসার স্বাভাবিক পরিবেশ বজায় রাখা কষ্টসাধ্য হয়ে পড়েছে। এর মধ্যে বড় পরিসরে টিকাদান কার্যক্রম শুরু হলে চাপ আরও বাড়বে। তখন চিকিৎসাসেবা দেওয়া মারাত্মক বিঘ্নিত হতে পারে।
সম্প্রতি কয়েকটি হাসপাতালের পরিচালক এসব সমস্যার কথা স্বাস্থ্য বিভাগের নজরে আনেন। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক রাজধানীর তিনটি হাসপাতালের পরিচালক সমকালকে জানান, টিকাদান কার্যক্রমে চিকিৎসক ও নার্সদের পাশাপাশি স্বেচ্ছাসেবকরা কাজ করছেন। চিকিৎসক ও নার্সদের একটি অংশ টিকাদান কার্যক্রমে যুক্ত থাকায় রোগীর চিকিৎসায় সমস্যা হচ্ছে। টিকা গ্রহীতা এবং রোগীর চাপ একসঙ্গে সামাল দিতে গিয়ে হিমশিম খেতে হচ্ছে। মোবাইল ফোনে এসএমএস না পেয়েও অনেকে টিকাকেন্দ্রে ভিড় করেন। আবার অনেকে সিরিয়াল সামনে আনার জন্য তদবির করেন। টিকাদানে যুক্ত কর্মীদের সঙ্গে অনেক সময় অপ্রীতিকর ঘটনাও ঘটছে। ওই ঘটনা সামাল দিতে গিয়ে রোগীর চিকিৎসায় বিঘ্ন ঘটে। এ কারণে হাসপাতাল থেকে টিকাদান কেন্দ্র সরিয়ে নিলে নির্বিঘ্নে রোগী চিকিৎসা দেওয়া সম্ভব হবে।
এ পরামর্শ আমলে নিয়ে টিকাদান কেন্দ্র স্থানান্তরের বিষয়টি নিয়ে কাজ শুরু করেছে স্বাস্থ্য বিভাগ। এরই মধ্যে একটি রূপরেখা চূড়ান্ত করা হয়েছে। সেটি অনুমোদন পেলে হাসপাতাল থেকে স্থানান্তরের কাজ শুরু হবে। এ কার্যক্রমের সঙ্গে যুক্ত এক কর্মকর্তা সমকালকে জানান, শুরুতে টিকার পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া নিয়ে এক ধরনের আশঙ্কা ছিল। তখন জরুরি প্রয়োজন হলে যাতে পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ার শিকার ব্যক্তিকে দ্রুত চিকিৎসার আওতায় আনা যায়, সে লক্ষ্যে হাসপাতালগুলোতে টিকাদান কেন্দ্র স্থাপন করা হয়েছিল। কিন্তু প্রায় দেড় কোটি ডোজ টিকা দেওয়ার পর দেখা গেছে, টিকা গ্রহীতাদের মধ্যে অল্প কিছু মানুষের শরীরে পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া হলেও তাদের হাসপাতালে ভর্তির প্রয়োজন হয়নি। কিছু মানুষের সামান্য শরীর ব্যথা ও জ্বর হয়েছিল। প্যারাসিটামল ওষুধ সেবনের পর তা কমে যায়। আবার অনেকের ওষুধ সেবনেরও প্রয়োজন হয়নি। সুতরাং হাসপাতাল থেকে অন্যত্র টিকাকেন্দ্র স্থানান্তর করা হলেও তাতে সমস্যার কিছু নেই। বরং হাসপাতালের ওপর চাপ কম পড়বে এবং রোগীর চিকিৎসার পরিবেশ আরও উন্নত করা যাবে।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক অধ্যাপক ডা. আবুল বাসার মোহাম্মদ খুরশীদ আলম সমকালকে বলেন, হাসপাতাল থেকে টিকাকেন্দ্র অন্যত্র স্থানান্তরের একটি পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়েছে। হাসপাতালে টিকাকেন্দ্র থাকায় বাড়তি ভিড় হয় এবং এতে রোগীর চিকিৎসায় বিঘ্ন ঘটছে। এর মধ্যে বড় পরিসরে টিকাদান কার্যক্রম চালানো হলে তখন ভিড় আরও বাড়বে। এতে রোগীর চিকিৎসা কার্যক্রম ব্যাহত হতে পারে।
তিনি বলেন, বর্তমানে মেডিকেল কলেজগুলোতে ক্লাস হয় না। পুরোপুরি ফাঁকা রয়েছে। সেগুলোর প্রত্যেকটিতে ১০ থেকে ১২টি করে বুথ স্থাপন করা যাবে। তখন অধিক মানুষকে টিকার আওতায় আনা যাবে। মেডিকেল কলেজের জনবলের সঙ্গে স্বেচ্ছাসেবী ও সম্প্রসারিত টিকাদান কর্মসূচির কর্মীরা মিলে টিকা কার্যক্রম পরিচালনা করতে পারবেন। তখন হাসপাতালের চিকিৎসক, নার্স ও স্বাস্থ্যকর্মীরা রোগী চিকিৎসায় শতভাগ মনোযোগ দিতে পারবেন।
মহাপরিচালক বলেন, ঢাকার মেডিকেল কলেজগুলো এবং ঢাকার বাইরে যেখানে মেডিকেল কলেজ রয়েছে সেখানে টিকাকেন্দ্র স্থাপন করা হবে। তবে এখনও চূড়ান্ত করা হয়নি। উচ্চপর্যায়ে আলোচনা করার পর এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হবে।
গ্রামাঞ্চলে টিকাদানের পরিকল্পনার বিষয়ে ডা. খুরশীদ আলম বলেন, গ্রামাঞ্চলে টিকাদানের লক্ষ্যে এরই মধ্যে মাইক্রোপ্ল্যান করা হয়েছে। এখন প্রশিক্ষণ চলছে। প্রশিক্ষণ শেষে আগামী ৭ আগস্ট থেকে শহরের পাশাপাশি গ্রামাঞ্চলেও টিকাদান কার্যক্রম শুরু হবে।
স্বাস্থ্য বিভাগ সূত্রে জানা গেছে, চলতি বছরের ৭ ফেব্রুয়ারি থেকে দেশব্যাপী গণটিকাদান কার্যক্রম শুরু হয়। তখন থেকে সারাদেশে এক হাজার পাঁচটি কেন্দ্রের মাধ্যমে টিকাদান কার্যক্রম পরিচালিত হয়ে আসছে। কিন্তু এখন গ্রামাঞ্চলে টিকাদান কার্যক্রম শুরু করায় কেন্দ্রের সংখ্যা কয়েকগুণ বাড়বে। নতুন পরিকল্পনায় প্রত্যেকটি ওয়ার্ডে একটি করে টিম, সিটি করপোরেশন এলাকার প্রতিটি ওয়ার্ডে তিনটি এবং পৌরসভার ওয়ার্ডে একটি করে টিম কাজ করবে। সব মিলিয়ে ১৫ হাজার ২৮৭টি ওয়ার্ডে ১৬ হাজার ১৫৩টি টিম কাজ করবে। প্রতি টিমে ছয়জন করে কর্মী থাকবেন। স্বাস্থ্যকর্মী ও স্বেচ্ছাসেবক মিলে দুই লাখের বেশি কর্মী এ প্রক্রিয়ায় যুক্ত হবেন।
টিকাদানে গতি আসবে, মত বিশেষজ্ঞদের : হাসপাতাল থেকে টিকাকেন্দ্র অন্যত্র স্থানান্তরে সরকারের পরিকল্পনাকে স্বাগত জানিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক ডা. নজরুল ইসলাম সমকালকে বলেন, স্বাভাবিক সময়েও সরকারি হাসপাতালে রোগীর উপচে পড়া ভিড় দেখা যায়। করোনাকালে সেই ভিড় আরও বেড়েছে। কয়েক দিন ধরে হাসপাতালে শয্যা পাওয়াও দুস্কর হয়ে পড়েছে। রোগীর চাপ সামলাতে চিকিৎসক, নার্স ও স্বাস্থ্যকর্মীরা হিমশিম খাচ্ছেন। এর ওপরে টিকাগ্রহীতার ভিড় সামলাতে হচ্ছে। বড় পরিসরে টিকাদান কার্যক্রম পরিচালনা করা শুরু হলে সেই ভিড় আরও বাড়বে। তখন পরিস্থিতি খারাপ হবে। এ অবস্থায় মেডিকেল কলেজ ভবন, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, কমিউনিটি সেন্টারে টিকাদান কার্যক্রম পরিচালনা করলে হাসপাতালে রোগী চিকিৎসায় গতি আসবে। সুতরাং এটি ভালো সিদ্ধান্ত। কিন্তু এটি করতে যাতে সমন্বয়হীনতা না হয়, সেদিকে লক্ষ্য রাখতে হবে।
চিকিৎসকদের শীর্ষ সংগঠন বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যাসোসিয়েশনের (বিএমএ) সাবেক সভাপতি অধ্যাপক ডা. রশিদ-ই মাহবুব সমকালকে বলেন, প্রতিবছর শিশুদের টিকাদানের যে ক্যাম্পেইন পরিচালনা করা হয়, সেগুলো কোনো হাসপাতালে হয় না। সুতরাং স্বাস্থ্য প্রতিষ্ঠানের বাইরে টিকাদান কেন্দ্র স্থাপন করা হলে কোনো অসুবিধা নেই। বরং হাসপাতালে বাড়তি ভিড় কমবে। এতে রোগীরা নির্বিঘ্নে সেবা পাবেন।
সূত্রঃ সমকাল