ক্রীড়া ডেস্কঃ
কখনও শঙ্কার কালো ছায়া, কখনও সম্ভাবনার আলোর রেখা। রোমাঞ্চ-উত্তেজনার নানা দোলাচল। কত অনুভূতির খেলাই না হয়ে গেল বাংলাদেশের রান তাড়ায়! ১২২ রানের লক্ষ্য ছুঁতেই দেখা গেল ক্রিকেটের নানা রঙ। শেষটা আলো ঝলমলে হয়ে উঠল আফিফ হোসেন ও নুরুল হাসান সোহানের পরিণত ব্যাটিংয়ে। বাংলাদেশ ক্রিকেটে নতুন দিনের বিজ্ঞাপন দেখিয়ে দুজন দলকে জেতালেন অসাধারণ এক জুটিতে।
অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে টি-টোয়েন্টিতে প্রথম জয়ের পরদিন ধরা দিল আরেকটি জয়। ৫ উইকেটের জয়ে বাংলাদেশ সিরিজে এগিয়ে গেল ২-০ ব্যবধানে।
জয়ের ব্যবধান বেশ বড় মনে হলেও ভীষণ কঠিন পথ পেরিয়ে তবেই দেখা মেলে ঠিকানার। মিরপুর শের-ই-বাংলা স্টেডিয়ামে বুধবার আরেকটি মন্থর উইকেটে অস্ট্রেলিয়াকে ১২১ রানেই আটকে রাখে বাংলাদেশের বোলাররা। কিন্তু ব্যাটিংয়ে ৬৭ রানে হারাতে হয় ৫ উইকেট। জয় তখনও বেশ দূরে।
প্রচণ্ড স্নায়ুর চাপ আর অস্ট্রেলিয়ার বোলিংয়ের চ্যালেঞ্জ সামলে সেই পথ পাড়ি দেন তরুণ আফিফ ও দলে জায়গা পাকা করার লড়াইয়ে থাকা সোহান। ষষ্ঠ উইকেটে দুজনের ৪৪ বলে ৫৬ রানের ম্যাচ জেতানো অবিচ্ছিন্ন জুটিতে জয় ধরা দেয় ৮ বল আগেই।
৩১ বলে ৩৭ রানের অপরাজিত ইনিংস খেলে ম্যাচের সেরা আফিফ। সোহান অপরাজিত থাকেন ২১ বলে ২২ রান করে।
এই দুজনের জুটির আগে বাংলাদেশের ব্যাটিংয়ে বারবার ছিল আশা-হতাশার পালাবদল। মিচেল স্টার্কের ফুল লেংথ বলে বাজেভাবে ব্যাট চালিয়ে বোল্ড হন সৌম্য সরকার। জশ হেইজেলউডের বলে দুর্বল পায়ের কাজে ডিগবাজি খায় আরেক ওপেনার মোহাম্মদ নাঈম শেখের স্টাম্প।
সাকিব আল হাসান উইকেটে গিয়ে স্টার্কের বলে টানা তিন বাউন্ডারিতে চেষ্টা করেন চাপটা সরিয়ে দিতে। বাংলাদেশ পাশে পায় ভাগ্যকেও। চারে নামা মেহেদি হাসান কতবার আউট হতে হতেও অল্পের জন্য বেঁচে যান, তিনি নিজেও হয়তো গুনে শেষ করতে পারবেন না!
অস্ট্রেলিয়ানরা তবু হাল ছাড়ে না। অ্যান্ড্রু টাইয়ের নাকল বলে লাইন মিস করে সাকিব বোল্ড ২৬ রান করে (১৭ বলে)। অধিনায়ক মাহমুদউল্লাহ শুন্য রানে ফেরেন অ্যাশটন অ্যাগারের বলে আলগা শটে বল স্টাম্পে টেনে এনে। ছটফট করতে থাকা মেহেদি শেষ পর্যন্ত অ্যাডাম জ্যাম্পার বলে স্টাম্পড ২৩ রানে (২৪ বলে)।
ইনিংসের সেটি দ্বাদশ ওভার, জয় তখনও ৫৬ রান দূরে। ব্যাটিং প্রতিকূল উইকেটে তখন বন্ধুর পথ দুই অনভিজ্ঞ আফিফ ও সোহানের সামনে। কী দুর্দান্তভাবেই না তারা জিতলেন সেই চ্যালেঞ্জ!
চোখধাঁধানো রানিং বিটুউন দা উইকেট, চাপে নুয়ে না পড়া আর প্রয়োজনের সময় বাউন্ডারি আদায়, সব মিলিয়ে ব্যাটসম্যানশিপের উজ্জ্বল নজির মেলে ধরেন দুজন। জ্যাম্পার টার্ন ও গুগলি, টাইয়ের নাকল বল আর স্টার্কের গতির জবাব দেন দুজন দারুণ ব্যাটিংয়ে।
রান-বলের সমীকরণ কখনোই কঠিন হতে দেননি দুজন। হেইজেলউডের বলে দৃষ্টিনন্দন র্যাম্প শটে বাউন্ডারিতে ম্যাচ শেষ করে দেন আফিফ।
অথচ ম্যাচের শুরুটায় ছিল ভিন্ন কিছুর ইঙ্গিত। আগের ম্যাচে টস জিতে বোলিং নিলেও এবার ব্যাটিংয়ে নামে অস্ট্রেলিয়া। প্রথম ম্যাচের ব্যর্থতার পর অধিনায়ক ম্যাথু ওয়েড বলেছিলেন, বাংলাদেশের স্পিন সামলাতে প্রয়োজন সাহসী ও স্মার্ট ব্যাটিং। অ্যালেক্স কেয়ারি সেই চেষ্টাই করেন। প্রথম ম্যাচের নায়ক নাসুম আহমেদকে রিভার্স সুইপে দুটি বাউন্ডারি মারেন ম্যাচের দ্বিতীয় ওভারেই।
তবে সেই আভাস রূপ পায়নি পূর্ণতায়। তৃতীয় ওভারেই অফ স্পিনার মেহেদি হাসানকে উড়িয়ে মেরে মিড অনে ধরা পড়েন কেয়ারি (১১ বলে ১১)।
আরেক ওপেনার জশ ফিলিপি কোনোরকমে স্পিন সামলে নিলেও বিভ্রান্ত হন মুস্তাফিজের দুর্দান্ত এক স্লোয়ারে। পায়ের পেছন দিয়ে বোল্ড হয়ে তাকিয়ে থাকেন হতভম্ব চেহারায় (১৪ বলে ১০)।
পাওয়ার প্লেতে অস্ট্রেলিয়া ৩২ রান তোলে ওই দুই উইকেট হারিয়ে। মার্শ ও মোইজেস হেনরিকেস সেখান থেকে এগিয়ে নেন দলকে।
উইকেট ধরে রেখে ভিত গড়ায় মনোযোগী হন দুজন। এক-দুই করে এগোনোর ফাঁকে টুকটাক বাউন্ডারিও আদায় করেন তারা। জুটির ফিফটি আসে ৪৭ বলে।
শেষ দিকে ঝড় তোলার মঞ্চ গড়ে দেন দুজন। ১৪ ওভার শেষে অস্ট্রেলিয়ার রান দাঁড়ায় ২ উইকেটে ৮৭।
সেখান থেকে তাদের উল্টোযাত্রার শুরু। সাকিবের ফ্লাইটেড বলে সুইপ করতে গিয়ে গড়বড় করে বসেন হেনরিকেস। ২৫ বলে ৩০ রানে থামে তার সম্ভাবনাময় ইনিংস।
কাজ শেষ করে ফিরতে ব্যর্থ হন মার্শও। শরিফুলের বলে বিদায় নেন তিনি আগের ম্যাচের মতোই ঠিক ৪৫ রানে (৪২ বলে)।
অস্ট্রেলিয়ার বড় রান তোলার সম্ভাবনায় পরের ওভারেই বড় চোট দেন মুস্তাফিজ। অসাধারণ দুটি কাটারে পরপর দুই বলে ফেরান ম্যাথু ওয়েড ও অ্যাশটন অ্যাগারকে। কিছু করতে পারেননি অ্যাশটন টার্নারও।
শেষ ৪ ওভারে অস্ট্রেলিয়া তুলতে পারে কেবল ২২ রান। বাউন্ডারি আসে মোটে ১টি। ইনিংস থমকে যায় তাই প্রত্যাশার চেয়ে কম রানে।
ম্যাচ যদিও জমে ওঠে ওই পুঁজিতেই। কিন্তু আফিফ আর সোহানের জয়ের তাড়নায় পিষ্ট হয় অস্ট্রেলিয়ানদের সব চেষ্টা।
সংক্ষিপ্ত স্কোর:
অস্ট্রেলিয়া: ২০ ওভারে ১২১/৭ (ফিলিপি ১০, কেয়ারি ১১, মার্শ ৪৫, হেনরিকেস ৩০, ওয়েড ৪, টার্নার ৩, অ্যাগার ০, স্টার্ক ১৩*, টাই ৩*; মেহেদি ৩-০-১২-১, নাসুম ৪-০-২৯-০, সাকিব ৪-০-২২-১, মুস্তাফিজ ৪-০-২৩-৩, শরিফুল ৪-০-২৭-২, সৌম্য ১-০-৭-০)।
বাংলাদেশ: ১৮.৪ ওভারে ১২৩/৫ (নাঈম ৯, সৌম্য ০, সাকিব ২৬, মেহেদি ২৩, মাহমুদউল্লাহ ০, আফিফ ৩৭*, সোহান ২২*; স্টার্ক ৩-০-২৮-১, হেইজেলউড ৩.৪-০-২১-১, অ্যাগার ৪-০-১৭-১, জ্যাম্পা ৪-০-২৪-১, টাই ৩-০-২৭-১, মার্শ ১-০-৬-০)।
ফল: বাংলাদেশ ৫ উইকেটে জয়ী।
সিরিজ: ৫ ম্যাচ সিরিজে বাংলাদেশ ২-০তে এগিয়ে।
ম্যান অব দা ম্যাচ: আফিফ হোসেন।
সূত্রঃ বিডিনিউজ