শিপ্ত বড়ুয়াঃ
আইন বিষয়ে স্নাতকোত্তর শেষ করে দিকবিদিক ছুটছি কোন এক অজানা গন্তব্যে। লেখালেখির প্রতি ঝোঁক বেশ ছোটকাল থেকেই।
গেলো কদিন আগে দেখা হলো প্রাইমারি স্কুলের এক বন্ধুর সাথে। সে পেশায় মিনি টমটম চালক। হঠাৎ করে সেদিন বললো, “শিপ্ত তোর মনে আছে বইয়ের বাইরে তোর বানিয়ে লেখার জন্য স্যারেরা কত মারতো?”
হ্যাঁ আসলে ইনিয়ে বিনিয়ে পরীক্ষার খাতায় লেখাটা আমার অভ্যাসে রূপ নিয়েছিলো। এমনকি উচ্চ মাধ্যমিকে হিসাব বিজ্ঞানের উপর এমন অত্যাচার আমি চালাতে গিয়ে হুঁচট খেয়েছি।
যাক মূল কথায় আসি। ভাইলোক শুনেন। এই দেশে দুইটা পেশা আত্মঘাতী মনে হয় আমার কাছে। প্রথমটা ওকালতি (আইন পেশা, ক্রিমিনাল লইয়ারিং) আর দ্বিতীয়তা সাংবাদিকতা (অনুসন্ধানী সাংবাদিকতা)। সাগর রুনি হত্যাকান্ড কিংবা নারায়ণগঞ্জের সেভেন মার্ডার নিয়ে নিশ্চয় অনেকদিন মাথাব্যথা করেছেন।
বর্তমানে নিয়তির খেলা এবং অতিরিক্ত দুঃসাহস আমাকে এই দুই পেশায় দারুণভাবে ঠেলে দিয়েছে। বার কাউন্সিল সার্টিফাইড ওকিল এখনো হইনি কিন্তু একটি জাতীয় পত্রিকায় উপজেলা করেসপন্ডেন্ট ও স্থানীয় একটি জনপ্রিয় পোর্টালে কাজ করার সুযোগ পেয়েছি। অবশ্য শিক্ষানবিশ আইনজীবী হিসেবে জেলা দায়রা আদালতে অবজার্ভার হিসেবেও কাজ করছি।
নিঃসন্দেহে এই দুই পেশায় বন্ধুর চেয়ে আপনার শত্রুর সংখ্যা দিন দিন বাড়বে। মামলায় এক পক্ষের হয়ে লড়তে গিয়ে আরেকপক্ষ আপনার শত্রু হবে৷ কোন দাগী খুনী বা অপরাধী হলে জান খতমের আশংকা তো আছেই।
তদ্রুপ অপরাধ বিষয়ক অনুসন্ধানী সাংবাদিকতায়ও রয়েছে মারাত্মক ঝুঁকি। যাদের বিরুদ্ধে আপনার প্রতিবেদন তারা হয় বিশাল ক্ষমতাবান না হয় উচ্চ পর্যায়ের শীর্ষ সন্ত্রাসী।
সাংবাদিকতা সম্পর্কে আমার জ্ঞান-গরিমা খুবই তুচ্ছ। এই পেশায় আসার আগে নিজের মতো করে পেশাগত আচরণ ও দায়িত্বগুলো বিভিন্ন জায়গা থেকে জানার চেষ্টা করেছি। ফেসবুক ও রয়টার্সের একটা অনলাইন কোর্স করেছিলাম ডেটা জার্নালিজমের উপর। নিয়মিত গ্লোবাল নেটওয়ার্ক ফর ইনভেস্টিগেটিভ জার্নালিস্ট নেটওয়ার্ক ফলো করছি।
সাংবাদিকতায় নিজের নিরাপত্তা ও গোপনীয়তাকে গুরুত্ব দেওয়ার কথা বলেছেন নাম করা বহু সাংবাদিক। এটা সম্ভবও, কিন্তু সেটা শহর এলাকায়। যারা মফস্বলে অনুসন্ধানী সাংবাদিকতা করেন তারা চরম নিরাপত্তাহীনতার মুখোমুখি হন। আমি নিজেই এমন সব বাজে অভিজ্ঞতার শিকার।
এখানে আরেকটি বিষয় গুরুত্বপূর্ণ, সেটি হলো মফস্বলে কেউ অপরাধমূলক অনুসন্ধানী সাংবাদিকতা করেন কিনা? উত্তর হলো বেশিরভাগ মফস্বল সাংবাদিক অনুসন্ধানী প্রতিবেদন করেন না। যারা কয়েকজন করেন তার বেশিরভাগও ব্যক্তি স্বার্থে কিংবা অফিস আদেশে। তবে এমন নয় যে, এই কথাগুলো সকল মফস্বল সাংবাদিকদের একই চরিত্র নির্দেশ করে।
দয়া করে মফস্বল সাংবাদিকদের দোষ দিবেন না। তারাও অসহায়, তাদের হাত পা বাঁধা। একেতো দেশের বেশিরভাগ গণমাধ্যম তাদের মফস্বল প্রতিনিধিদের কোন প্রকার অনারিয়াম দেন না, তার উপর লোকাল অনেক পত্র-পত্রিকা পক্ষ-বিপক্ষের চক্করে ফেলে খবর প্রকাশে উল্টো টাকা নেন।
একজন ব্যক্তি সাংবাদিকতায় এসে যখন খবর সংগ্রহে গিয়ে নিজের গাড়ি ভাড়া কিংবা ইকুইপমেন্ট পায় না তখন তার সামনে দুর্নীতি ও চুপ থাকার পথ ছাড়া আর কোন পথ খোলা থাকে না। মফস্বলে বেশিরভাগ প্রশাসনিক কর্মকর্তা ও রাজনৈতিক ব্যক্তিদের পরিচিত হওয়ায় নিরাপত্তার ভয়ে মুখও খুলতে পারেন না অনেক সাংবাদিকরা।
সে কথা থাক। যে কথা আসলে বলতে চাচ্ছি তা হলো সাংবাদিকতা ও আইন এই দুই পেশা আত্মঘাতী। এই দুই পেশায় প্রতি মুহুর্তে আপনাকে নতুন চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করতে হবে। চুপও থাকতে পারবেন না আর বেশি কথা বললেও মহাবিপদ।
তার উপর বর্তমানে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন দিয়ে কলম সাংবাদিকদের কলম ভেঙে দেওয়া হয়েছে। ইলেকট্রনিক মিডিয়ার সাংবাদিকদের গলা টিপে দেওয়া হয়েছে। এই কালো আইন হওয়ার পর থেকে দেশের অসংখ্য সাংবাদিক সত্য বলায় জেল খেঁটেছেন।
আমরা যারা মফস্বলে সাংবাদিকতা করি আমাদের নীতিগত সিদ্ধান্ত নিতে আরো দৃঢ় হতে হবে। একতা বাড়াতে হবে। তেলবাজি টোটালি ফেলতে না পারলেও, ভালো মানুষদের সাথে এই মহৎ কাজটা করতে হবে।
পরিশেষে বলবো, আইন পেশা কিংবা সাংবাদিকতা সমাজের প্রতিনিধিত্বমূলক দুটি পেশা। লিগ্যাল জুরিসপ্রুডেন্সে আইনজীবীদের বলা হয়েছে সোশ্যাল ইঞ্জিনিয়ার বা সমাজ সংস্কারক। আর বড় বড় দার্শনিকদের মতে সাংবাদিকরা হলো সমাজের তৃতীয় চোখ। এই দুই পেশায় এসে কেউ চাইলে সমাজকে বদলে দিতে পারে আবার সীমাহীন দুর্নীতি করে কাঁড়ি কাঁড়ি টাকা কামাতেও পারে।
কি? সিদ্ধান্তহীনতায় ভুগছেন? একারণেই তো প্রথমেই বলেছি আইন পেশা এবং সাংবাদিকতা আত্মঘাতী পেশা। ধন্যবাদ, সবাই ভালো থাকবেন।
লেখক : রামু করেসপনডেন্ট, দৈনিক আজকের পত্রিকা।