অনলাইন ডেস্ক :
কুমিল্লা পৌরসভার চেয়ারম্যান ছিলেন, সিটি কর্পোরেশন হওয়ার পর মেয়রও হন; চার দশকের রাজনৈতিক জীবনে ভোটের লড়াইয়ে নেমে আগে কখনও হারেননি মনিরুল হক সাক্কু; তাকে সেই স্বাদ দিলেন আরফানুল হক রিফাত। আর রিফাতের এই জয়ে কুমিল্লা সিটি করপোরেশন এই প্রথম পেল আওয়ামী লীগের মেয়র।
বুধবার অনুষ্ঠিত কুমিল্লা সিটি করপোরেশনের তৃতীয় নির্বাচনে হাড্ডাহাড্ডি লড়াইয়ের পর তুমুল উত্তেজনার মধ্যেই ঘোষিত ফলে নৌকার প্রার্থী রিফাতকে ৩৪৩ ভোটে বিজয়ী ঘোষণা করেন রিটার্নিং কর্মকর্তা।
আগের দুটি নির্বাচনে বড় ব্যবধানে আওয়ামী লীগের প্রার্থীকে হারিয়ে আসা সাক্কু স্বল্প ব্যবধানে এই হারকে মেনে নিতে নারাজ। তিনি অভিযোগ করেছেন, কারচুপি করে তাকে হারানো হয়েছে।
তবে নিজের এই জয়কে ‘দুর্নীতির বিরুদ্ধে’ জনরায় হিসেবে দেখছেন আওয়ামী লীগ প্রার্থী রিফাত। তার রাজনৈতিক গুরু হিসেবে পরিচিত স্থানীয় সংসদ সদস্য আ ক ম বাহাউদ্দিন বাহারও বলেছেন, দুর্নীতির বিরুদ্ধে ভোট দিয়েছে কুমিল্লাবাসী।
কুমিল্লা শহরের মনোহরপুর এলাকার বাসিন্দা এস এম আতাউল হক ও হাছিনা হক দম্পতির ছেলে রিফাতের রাজনীতির হাতেখড়ি স্বাধীনতার আগে স্কুলে থাকাকালে ছাত্রলীগের মাধ্যমে।
১৯৭৪ সালে তিনি কুমিল্লা জিলা স্কুল থেকে এসএসসি পাস করেন। পরে কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া কলেজ থেকে এইচএসসি এবং স্নাতক ডিগ্রি নেন।
১৯৭৫ সালে বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যার পর প্রতিবাদ করতে গিয়ে একটি মামলায় সাজাপ্রাপ্ত হন রিফাত। তখন পালিয়ে চলে গিয়েছিলেন বিদেশে। পরে দেশে ফিরে ১৯৮০ সালে কুমিল্লা শহর ছাত্রলীগের সভাপতি হন।
১৯৮১ সালে কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া কলেজ ছাত্র সংসদের ছাত্রলীগের প্যানেল থেকে বহিঃক্রীড়া ও ব্যায়ামাগার সম্পাদক নির্বাচিত হন রিফাত। একই বছরে জামায়াত-শিবিরের হামলার শিকার হন তিনি। তার দুই হাত ও দুই পায়ের রগ কেটে দেওয়া হয়।
১৯৮৩-৮৫ সাল পর্যন্ত তিনি সিঙ্গাপুরের মাউন্ট এলিজাবেথ হাসপাতালে চিকিৎসা নিয়ে সুস্থ হন। দেশে ফিরে সক্রিয় হন এরশাদবিরোধী আন্দোলনে।
১৯৯৬ সালে রিফাত যুবলীগের কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য নির্বাচিত হন। পরে তিনি কুমিল্লা জেলা যুবলীগের জ্যেষ্ঠ সহসভাপতির দায়িত্ব পালন করেন। ২০১৭ সালে তিনি কুমিল্লা মহানগর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদকের পদ পান। মহানগর সভাপতির দায়িত্বেই রয়েছেন এমপি বাহার।
চার দশকের বেশি সময় ধরে রাজনীতিতে যুক্ত থাকলেও রিফাতের ভোটের মাঠে আসা এবারই প্রথম, আর প্রথম বারেই করলেন বাজিমাত।
কুমিল্লা নগরে আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক ভিত্তি মজবুত হলেও জটিল রাজনৈতিক মেরুকরণে বরাবরই সুবিধা পেয়ে আসছিল তাদের রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ বিএনপি।
আফজল খান আর আ ক ম বাহারের দ্বন্দ্বে কুমিল্লা সদর আসনে জেতা আওয়ামী লীগের কাছে হয়ে উঠেছিল সোনার হরিণ। তাদের দ্বন্দ্বের সুযোগ কাজে লাগিয়ে বিএনপির আকবর হোসেন (বর্তমানে প্রয়াত) বরাবরই হয়ে যেতেন সংসদ সদস্য।
আকবরের ভাগ্নে সাক্কুও পেয়ে আসছিলেন সেই সুবিধা; ২০০৫ সালে তিনি প্রথম কুমিল্লা পৌরসভার চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন, এরপর আবার নির্বাচিত হন। কুমিল্লা সিটি করপোরেশনে উন্নীত হওয়ার পর ২০১২ সালে আফজল খানকে হারিয়ে মেয়র হন সাক্কু। ২০১৭ সালের নির্বাচনে আফজল খানের মেয়ে আঞ্জুম সুলতানা সীমাকেও হারতে হয় সাক্কুর কাছে।
২০১২ সালে দলীয় প্রতীকে সিটি নির্বাচন হয়নি; তবে ২০১৭ সালে নৌকা আর ধানের শীষের লড়াই-ই হয়েছিল। কিন্তু দুবারই হারতে হয় ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের প্রার্থীকে।
আফজল পরিবারের বিরুদ্ধে সেই লড়াইয়ে সাক্কু বরাবরই সমর্থন পেয়েছিলেন ২০০৮ সাল থেকে আওয়ামী লীগের এমপি হওয়া বাহারের। আর তা অস্বীকারও করেননি সাক্কু।
কিন্তু এবার আওয়ামী লীগ আফজল খানের পরিবারের বাইরে থেকে রিফাতকে মেয়র প্রার্থী করলে তা সাক্কুর জন্য সঙ্কট তৈরি করে। কেননা এই রিফাত আবার বাহারের অনুগত হিসেবেই পরিচিত।
আফজল খানের ছেলে ইমরান মেয়র প্রার্থী হিসেবে ভোটের মাঠে নামলেও আওয়ামী লীগের কেন্দ্রের হস্তক্ষেপে তাকে উঠিয়ে নেওয়া হলে গৃহবিবাদের সুবিধা পাওয়ার সুযোগ নষ্ট হয় সাক্কুর জন্য।
সেই সঙ্গে বিএনপিরই নেতা নিজাম উদ্দিন কায়সার আবার প্রার্থী হলে সাক্কুর পক্ষে দলের নেতা-কর্মীদের সমর্থনও বিভক্ত হয়ে পড়ে। যদিও তাদের দুজনকেই দলের সিদ্ধান্ত অমান্য করে ভোটে দাঁড়ানোয় বহিষ্কার করে বিএনপি।
এই পরিস্থিতিতে রিফাত বিজয়ী হলেও বিএনপির বহিষ্কৃত দুই নেতার ভোট (৭৯,০৬৬) নৌকার চেয়ে ২৮ হাজার ৭৫৬টি বেশি।
সাক্কু প্রথম বার আফজল খানকে হারিয়েছিলেন ২৯ হাজার ১০৬ ভোটে, দ্বিতীয়বার সীমাকে হারান ১১ হাজার ৮৫ ভোটে।
এবার স্বল্প ব্যবধানে রিফাত জয়ী হলে তাকে গুরুত্ব দিচ্ছেন না কুমিল্লা মহানগর আওয়ামী লীগের সভাপতি বাহার। তিনি বলছেন, “এখানে নৌকা কত ভোটের ব্যবধানে জয়ী হয়েছে, সেটা বড় কথা নয়। বিজয় বিজয়ই।”
শিষ্য রিফাতকে নিয়ে আশাবাদ প্রকাশ করে বাহার বলেন, “রিফাত দুর্নীতিকে প্রশ্রয় দেবেন না। তিনি দুর্নীতিমুক্ত নগর ভবন গড়বেন বলেই আমার বিশ্বাস।”
ভোটের প্রচারে দীর্ঘদিনের মেয়র সাক্কুর ‘দুর্নীতি’কেই অস্ত্র বানিয়েছিলেন রিফাত; যদিও সাক্কু তা নাকচ করে বলে আসছিলেন, তিনি দুর্নীতি করলে আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে নিশ্চয়ই রেহাই পেতেন না।
ভোটে জয়ের পর নিজের কাজের কথা বলতে গিয়েও দুর্নীতির প্রসঙ্গই টেনেছেন রিফাত। তিনি বলেন, “আমি প্রথমে প্রাধান্য দেব, আগেও বলেছি, সিটি করপোরেশনে গত ১০ বছর যারা দুর্নীতি করেছে, সব দুর্নীতির শ্বেতপত্র প্রকাশ করব আমি। এটা আমার প্রথম দায়িত্ব। আমি কুমিল্লার মানুষকে কথা দিয়েছি। আমি কথা রাখব।”
জলাবদ্ধতা ও যানজট- কুমিল্লাবাসীর এই দুই সমস্যা নিরসন এক বছরের মধ্যে করার ঘোষণা দেন তিনি।
একজন প্রাক্তন মেয়র হিসেবে সাক্কু এগিয়ে এলে তার সহযোগিতা নেওয়ার প্রতিশ্রুতিও দেন রিফাত।
তিনি বলেন, “আমি আওয়ামী লীগ করি। কিন্তু আমি নগর ভবনকে আমার দলীয় কার্যালয় বানাব না। আমি দল-মত নির্বিশেষে সব মানুষের জন্য কাজ করব। সবার জন্য আমার দরজা খুলে রাখব। এটা আমার কমিটমেন্ট।“
নৌকার এ বিজয়কে জনগণ ও দলীয় সভাপতি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বিজয় অভিহিত করে রিফাত বলেন, “এ বিজয় আমাদের প্রয়োজন ছিল। মানুষ আমাকে যেভাবে মূল্যায়ন করেছেন, আমি সারাজীবন তাদের প্রতি কৃতজ্ঞ থাকব। তাদের কাছে দেওয়া প্রতিশ্রুতি আমি জীবন দিয়ে হলেও রক্ষা করব।”
সূত্র: বিডিনিউজ