শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের গভর্নিং বডি বা ম্যানেজিং কমিটির সভাপতির মিনিমাম শিক্ষাগত যোগ্যতা এসএসসি পাসের প্রস্তাব নাকচ করে দিয়েছেন শিক্ষামন্ত্রী ডা. দীপু মনি। বুধবার (১০ আগস্ট) সংসদ ভবনে অনুষ্ঠিত শিক্ষা মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় কমিটির বৈঠকে বিষয়টি নিয়ে আলোচনা হয়।
বৈঠক সূত্রে জানা গেছে, কমিটির সভাপতিসহ বেশিরভাগ সদস্যই বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের গভর্নিং বডির সভাপতির মিনিমাম যোগ্যতা এসএসসি পাস রাখার প্রস্তাব করেন। তবে শিক্ষা মন্ত্রী তা নাকচ করে দেন। তিনি যুক্তি দিয়ে বলেন, আমরা যারা আইনপ্রণেতা তাদের অনেকেই আছেন যাদের শিক্ষাগত যোগ্যতার বালাই নেই। তাহলে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের সভাপতি হতে শিক্ষাগত যোগ্যতার প্রয়োজন পড়বে কেন? অনেকে আছেন পঞ্চম শ্রেণিও পাস না কিন্তু খুবই যোগ্য এবং ভালো মানুষ। শিক্ষিত হলেই সবকিছু হয়ে যাবে বিষয়টি তা নয়।
মন্ত্রী বলেন, শিক্ষাগত যোগ্যতা নির্ধারণ করে দিলে একটি ব্যারিয়ার সৃষ্টি হবে। আমরা শিক্ষাগত যোগ্যতার বিষয়টি দিলাম না। কিন্তু মনোনয়ন দেওয়ার সময় শিক্ষিত ব্যক্তিদের প্রাধান্য দিতে পারি। কিন্তু যোগ্যতার বিষয়টি বিধিতে নিয়ে এলে অনেকের জন্য পথ রুদ্ধ করে দেয়া হবে।
দেশের বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে আইসিটি ল্যাব স্থাপন করা হলেও তার অনেকগুলো ব্যবহার না হওয়ার অভিযোগ উঠেছে সংসদীয় কমিটিতে। শুরু থেকেই এগুলো চাদরে মুড়িয়ে রাখা হয়েছে বলেও সংসদীয় কমিটির আলোচনায় এসেছে। কিছু ক্ষেত্রে অফিসের কম্পিউটার সভাপতি বা প্রধান শিক্ষক তাদের বাড়িতে নিয়ে ব্যক্তিগত কাজে ব্যবহারের অভিযোগ এসেছে। অবশ্য শিক্ষামন্ত্রী বলেছেন, কিছু ক্ষেত্রে সমস্যা থাকলেও ঢালাওভাবে অভিযোগ করা ঠিক হবে না। আমরা মনিটরিং জোরদার করছি। যেসব সমস্যা আছে তা ঠিক হয়ে যাবে।
জানা গেছে, কমিটির সদস্য বিকল্প ধারার সংসদ সদস্য মাহী বি চৌধুরীসহ দুই/তিন জন সদস্য আইসিটি ল্যাব পড়ে থাকা ও প্রশিক্ষিত শিক্ষক না থাকার প্রশ্ন তোলেন। তারা বলেন, অনেক শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে আইসিটি ল্যাব করে দেওয়া হয়েছে। কিন্তু তার অনেকগুলোই শুরু থেকে চাদর বা টাওয়াল দিয়ে মুড়িয়ে রাখা রয়েছে। এগুলো চালু করা হয় না। আবার কিছু কম্পিউটার গভর্নিং বডির সভাপতি তার বাড়িয়ে নিয়ে গেছেন। কিছু নিয়ে গেছেন প্রধান শিক্ষক। কিছু পড়ে আছে। কাগজে কলমে আইসিটি ল্যাব দেখানো হচ্ছে। কিন্তু বাস্তবে আইসিটি দক্ষতা সম্পন্ন ছাত্রছাত্রী নেই। সরেজমিনে গিয়ে দেখা গেছে। শিক্ষার্থীরা আইসিটি সম্পর্কে পড়তে বললে কিছুটা পারে। কিন্তু কম্পিউটার চালু করতে বললে বা কোনও প্রোগ্রাম ওপেন করতে বললে পারে না। মন্ত্রণালয় বিষয়গুলো যথাযথ তদারকি করছে না বলেও তারা অভিযোগ করেন।
জবাবে শিক্ষামন্ত্রী ডা. দীপু মনি বলেন, কাগজেকলমে যতটা হওয়ার কথা আমাদের এখানে অনেক ক্ষেত্রে হয়তো সেটা হয় না। এ ক্ষেত্রে আমাদের কিছুটা সীমাবদ্ধতা আছে। এটা মেনে নিতে হবে। শিক্ষা তো এমন কোনও বিষয় নয় যে একটা ক্লিক করলাম আর কাজ হয়ে গেল। শিক্ষার ফল পেতে হয়ে কিছুটা সময় তো লাগবেই। মোটেও হচ্ছে না সেটা ঠিক নয়। অনেক ক্ষেত্রে হচ্ছে। আবার কিছু হচ্ছে না এটাও মিথ্যা নয়। আমরা মনিটরিং জোরদার করছি। পর্যায়ক্রমে সব ঠিক হয়ে যাবে।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে কমিটির সদস্য ফজলে হোসেন বাদশা বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে আইসিটি ল্যাবের বিষয়ে একটি প্রতিবেদন দেওয়া হয়েছে। এ বিষয়ে কতজন শিক্ষককে প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছে তার তথ্যও দেওয়া হয়েছে। পরে বিষয়টি নিয়ে আলোচনার সময় এগুলোতে সঠিকভাবে শিক্ষা দেওয়া হচ্ছে কী না সেই বিষয় এসেছে। বলা হয়েছে অনেক ক্ষেত্রে ল্যাব আছে কিন্তু প্রশিক্ষিত শিক্ষক নেই। সেজন্য সেটা ব্যবহার হচ্ছে না। আলোচনায় এমন বিষয়ও উঠে এসেছে যে ল্যাব চালুর পর থেকেই সেটা চাদরে মুড়িয়ে রাখা হয়েছে কোন ব্যবহার হচ্ছে না। সেটার বিষয়ে তদারকি করতে বলা হয়েছে।
সংসদীয় কমিটির বৈঠকে রাজশাহী প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (রুয়েট) ভিসির বিরুদ্ধে নিয়োগে অনিয়ম ও দুর্নীতির তদন্তসহ চরটি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের দুর্নীতি নিয়ে আলোচনা হয়। রুয়েটের দুর্নীতি নিয়ে ইউজিসি একটি প্রতিবেদন মন্ত্রণালয়কে দিয়েছে বলেও বৈঠকে জানানো হয়। পরে কমিটি ওই প্রতিবেদন চাওয়ার পাশাপাশি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর দুর্নীতি বন্ধে করনীয় বিষয়ে সংসদীয় কমিটির পক্ষ থেকে একটি সুপারিশ পাঠানোর কথা বলেছে।
অবশ্য শিক্ষামন্ত্রী দ্বিমত পোষণ করে বলেন, এগুলো বিচ্ছিন্ন ঘটনা। দুই একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের ঘটনাকে জড়িতে গোটা উচ্চশিক্ষাকে নিয়ে ঢালাও মন্তব্য করা ঠিক হবে না। আর যেসব ক্ষেত্রে অনিয়মের তথ্য আসছে ইউজিসি তা তদন্ত করছে। তদন্তে অনিয়ম পেলে সেই বিষয়ে ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে এবং হবে।
এ বিষয়ে ফজলে হোসেন বাদশা বলেন, রুয়েটের উপাচার্য দুর্নীতি করেছে সেটা তদন্ত কমিটিতে প্রমাণিত হয়েছে। তদন্ত রিপোর্টটি আমরা সংসদীয় কমিটিতে আনতে বলেছি। সেটা পর্যালোচনা করে আমরা বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে একটি সুপারিশ পাঠানোর কথা বলেছি। ক্ষমতার অপব্যবহারের বিষয়ে যদি আমরা আইনের আওতায় আনতে পারি। তাহলে ভাবমূর্তি ফিরিয়ে আনা যাবে।
এ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ১৯৭৩ এর অধ্যাদেশ অনুযায়ী বিশ্ববিদ্যালয়গুলো স্বায়ত্বশাসিত এটা ঠিক আছে। কিন্তু সংসদের তো সার্বভৌমত্ব আছে। সংসদ চাইলে তো এটা করতে পারে।
বৈঠকে শিক্ষা প্রকৌশল অধিদফতরের দুর্নীতি অনিয়ম নিয়েও কথা বলেছেন। এসময় অধিদফতরের প্রধান প্রকৌশলীকে তুলোধোনা করা হয় বলে বৈঠক সূত্রে জানা গেছে।
কমিটির বৈঠকে অভিযোগ উঠেছে- একটি সিন্ডিকেট গড়ে তুলে একই ঠিকাদার বার বার কাজ পাচ্ছে। অনেকে কার্যাদেশ পাওয়ার পর কাজ শুরু করে না। শুরু করলেও কিছুদিন পর ফেলে রাখে। বছরের পর পর ঝুলতে থাকে। প্রতিবেদনে কাজ চলমান বলা হলেও কিন্তু বাস্তবে গেলে দেখা যাবে কাজ বন্ধ রয়েছে। ঠিকাদারদের বেশিরভাগই মুক্তিযুদ্ধের বিপক্ষের শক্তি। তারা দেশের উন্নয়নকে ব্যাহত করার চেষ্টা করছে।
জানা গেছে, বিষয়টি নিয়ে ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেন কমিটির সভাপতি আফসারুল আমীন। তিনি শিক্ষা প্রকৌশল অধিদপ্তরের কাজ দুদকের মাধ্যমে তদারকির কথাও বলেন।
সংসদ সচিবালয়ের সংবাদ বিজ্ঞপ্তি জানানো হয়- কমিটি শিক্ষা প্রকৌশল অধিদফতরের মাধ্যমে বাস্তবায়নাধীন মহানগর, পৌরসভা ও জেলা পর্যায়ের স্কুল ভবনের প্রিকাস্ট পাইলিংয়ের ওপর একতলা ভবন নির্মাণের কাজ কঠোর নজরদারি করাসহ নতুন ঠিকাদার তালিকাভুক্তির সুপারিশ করে।
কমিটির সভাপতি আফছারুল আমীনের সভাপতিত্বে সংসদ ভবনে অনুষ্ঠিত বৈঠকে কমিটি সদস্য শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী ডা. দীপু মনি, উপমন্ত্রী মহিবুল হাসান চৌধুরী,মো. আব্দুল কুদ্দুস,ফজলে হোসেন বাদশা,মো. আব্দুস সোবহান মিয়া, এম এ মতিন এবং মাহী বদরুদ্দোজা চৌধুরী অংশগ্রহণ করেন।