পাঁচ হাজার বছরের প্রাচীন সভ্যতার দেশ চীনের সাহিত্য ভাণ্ডারে রয়েছে অজস্র মণিমুক্তা। চীনা কবিতার ইতিহাসও চার পাঁচ হাজার বছরের। কাব্যের ধারাবিকাশে এখানে অনেক রকম কাব্যরীতি গড়ে উঠেছে।
সাহিত্যের একজন পাঠক হিসেবে প্রাচীন ও মধ্যযুগের চীনা কবিতা আমার বেশি পছন্দ। বিশেষ করে থাং রাজবংশের সময়কার কবিদের কবিতা। চীনা কবিতায় বাকসংযম, আভাস, ইঙ্গিত আমাকে মুগ্ধ করে। বিশাল দেশ চীনের বিচিত্র, মোহন প্রকৃতির বর্ণনা তাদের কবিতাকে ঋদ্ধ করেছে। সেইসঙ্গে তাও দর্শন, কনফুসিয়াসের জীবনচেতনা এবং আধুনিক যুগে সমাজতন্ত্রের মানবিক বোধ চীনা কবিতায় প্রতিফলিত হয়েছে। চীনা কবিতার জগতে আমার দুজন প্রিয় কবি হলেন লি পাই এবং তু ফু।
চীনা সাহিত্যের অন্যতম সেরা কবি লি পাই যুগ যুগ ধরে বিশ্বের বিভিন্ন সাহিত্যিককে প্রভাবিত করেছেন। ইংরেজিতে তার নাম লেখা হয় Li Bai. চীনের সাহিত্যকে লি পাই পৌঁছে দেন নতুন উচ্চতায়। থাং রাজবংশের সময়কে বলা হয় চীনা কবিতার স্বর্ণযুগ। আর সেই স্বর্ণযুগের অন্যতম প্রধান কবি হলেন লি পাই।
লি পাইয়ের জন্ম আনুমানিক ৭০১ খ্রিস্টাব্দে থাং রাজবংশের শাসনামলে প্রাচীন চীনা মধ্য এশিয়ায় বর্তমানের কিরগিজস্তানে। লি পাই যখন পাঁচ বছরের শিশু তখন তার বাবা পরিবারের সকলকে নিয়ে চলে আসেন চীনের সিচুয়ান প্রদেশের আধুনিক ছাংদু শহরের কাছে। তিনি তার তারুণ্যের অনেকটা সময় ছিংলিয়ান শহরে কাটান। শৈশব থেকেই তিনি প্রতিভাবান হিসেবে খ্যাতি পান এবং দশ বছর বয়স হওয়ার আগেই কবিতা লেখা শুরু করেন।
তিনি কনফুসিয়াস ও তাও দর্শনে জ্ঞান অর্জন করেন। পাশাপাশি তিনি তলোয়ার চালনা, ঘোড়ায় চড়া, শিকার ও ভ্রমণে দক্ষ হয়ে ওঠেন। তিনি বীর হিসেবে খ্যাতি পান এবং দরিদ্র ও অসহায় মানুষের আশ্রয়স্থল হয়ে ওঠেন। তিনি চীনের অনেক প্রদেশে ঘুরে বেড়ান এবং গরীবদের মধ্যে নিজের ধন সম্পদ দান করেন। একসময় তিনি চাংআন রাজদরবারে সম্রাট সুয়ানচোংকে কবিতায় মুগ্ধ করেন।
লি পাইয়ের কবিতা থাং রাজবংশের সময়কার শ্রেষ্ঠ কবিতার সংকলনে গ্রন্থভুক্ত হয়। এই সংকলনটি ৭৫৩ সালে তৈরি হয়েছিল। ১৮শ শতকে ইউরোপে প্রকাশিত ‘তিনশ থাং কবিতা’ শিরোনামের সংকলনে লি পাইয়ের ৩৪টি কবিতা স্থান পায়। এজরা পাউন্ডসহ অনেক কবিই লিপাইয়ের কবিতায় প্রভাবিত হয়েছেন।
লি পাইয়ের কবিতায় বন্ধুত্বের আনন্দ, চাঁদের রূপ, প্রকৃতির সৌন্দর্য ও গভীরতা, শান্তি, একাকীত্ব, নীরবতা ও সুরাপানের আনন্দ প্রতিফলিত হয়েছে। ‘নীরব রাতের চিন্তা’, ‘বসন্তদিনে নেশা থেকে জেগে ওঠা’ ইত্যাদি তাঁর বিখ্যাত কবিতা।
৭৬২ সালে লি পাই মৃত্যুবরণ করেন। বলা হয়ে থাকে নৌকা থেকে তিনি হাত বাড়িয়ে জলের বুকে প্রতিফলিত চাঁদের ছায়া ধরতে গিয়ে জলে পড়ে যান। চীনা সাহিত্যের অন্যতম সেরা কবি লি পাই হাজার বছর ধরে চীনের প্রকৃতির অপরিসীম সৌন্দর্য, শান্ত ও আনন্দময় জীবনের জয়গান গেয়েছেন। এখানে লি পাইয়ের দুটি কবিতার অনুবাদ দিচ্ছি।
বসন্তদিনে নেশা থেকে জেগে ওঠা
কবি: লি পাই
এ বিশ্বে জীবন একটি সুদীর্ঘ স্বপ্ন মাত্র
শ্রমে বা দুঃশ্চিন্তায় একে বিনষ্ট করতে রাজি নই আমি
তাই আমি সারাদিন ডুবে থাকি আনন্দ সুরায়
ঘরের দাওয়ায় বসে স্বাদ নেই জীবনের।
জেগে উঠে সামনে দেখি পুষ্পিত বাগান
নিঃসঙ্গ পাখি এক গান গায় ফুলের মাঝারে
নিজেকেই প্রশ্ন করি দিন তো কেটেছে ভালো?
বসন্ত বাতাস কথা বলে পাখিটির কানে।
গান শুনে দীর্ঘশ্বাস জমা হয় মনে।
মদিরা যেহেতু আছে, পাত্রখানি ভরে নেই আমি
উল্লাসে গান গেয়ে চন্দ্রোদয়ের অপেক্ষায় থাকি
সংগীতের অবসানে প্রশান্তির নিদ্রা নামে দেহজুড়ে ।
অনুবাদ: শান্তা মারিয়া
নীরব রাতের ভাবনা
কবি: লি পাই
আমার খাটের পাশে আলোর সাগর
মেঝেতে কি তবে জমেছে তুষার?
চোখ তুলে দেখি আমি চাঁদের বাহার
অবনত মুখে ভাবি গৃহের স্মৃতি।
অনুবাদ: শান্তা মারিয়া
চীনা সাহিত্যের অন্যতম শ্রেষ্ঠ কবি বলা হয় তু ফুকে। তু ফুর নামের ইংরেজি বানান হলো Du Fu. লি পাই এবং তু ফু এই দুজনের কবিতাতেই চীনা জীবন, প্রকৃতি, প্রেম ও দর্শনের সর্বশ্রেষ্ঠ শিল্পসম্মত প্রকাশ ঘটেছে বলা চলে। পশ্চিমা বিশ্বে তু ফু কে বলা হয় চীনের ভার্জিল বা চীনের মিল্টন।
তু ফুর জন্ম ৭১২ খ্রিস্টাব্দে। তার প্রকৃত জন্মস্থান কোথায় সেটি জানা যায় না। তবে এটুকু বলা যায় তার জন্মস্থান হনান প্রদেশের লুইয়াংয়ের কাছে। তার পিতামহ ছিলেন সম্রাজ্ঞী উ চেথিয়ানের সময়কার একজন রাজনীতিক ও কবি।
তুফু শৈশবেই মাকে হারিয়ে খালার কাছে বড় হন। বাবা ছিলেন মাঝারি স্তরের কর্মকর্তা। তু ফুও সরকারি চাকরির জন্য ছোটবেলা থেকেই তৈরি হন। তিনি কনফুসিয়াসের দর্শন, ইতিহাস ও কবিতা বিষয়ে পাঠ গ্রহণ করেন। ৭৩০ এর দশকের প্রথমদিকে তিনি চিয়াংসু ও চেচিয়ান প্রদেশে ভ্রমণ করেন। সেসময়ই তার কাব্য রচনা শুরু হয়। ৭৩৫ সালে তিনি সরকারি চাকরির জন্য পরীক্ষা দেন। কিন্তু অকৃতকার্য হন।
ঐতিহাসিকদের ধারণা তু ফুর গদ্য রচনা ছিল সমসাময়িকদের তুলনায় অনেক বেশি গভীর ও উন্নত। সে কারণে পরীক্ষকরা তার মূল্যায়নই করতে পারেনি। ৭৪০ সালের দিকে বাবার মৃত্যু হলে তু ফু তার জায়গায় কর্মকর্তা হিসেবে যোগদানের একটা সুযোগ পান কিন্তু সেই সুযোগ তিনি গ্রহণ না করে তার সৎভাইকে দিয়ে দেন।
৭৪৪ সালের শরৎকালে কবি লি পাইয়ের সঙ্গে তার দেখা হয়। তাদের মধ্যে বন্ধুত্ব জমে ওঠে এবং তু ফুর জীবনে এই বন্ধুত্বের প্রভাব অসীম। তু ফু তার চেয়ে বয়োজ্যেষ্ঠ লি পাইয়ের রচনাভঙ্গী ও জীবন দর্শনে দারুণভাবে অনুপ্রাণিত হন।
৭৫৫ সালে তু ফু যুবরাজের অফিসে একটি সাধারণ চাকরি পান। কিন্তু নিশ্চিন্ত জীবন তার ভাগ্যে ছিল না। ৭৫৫ সালে রাজ্যে বিদ্রোহ দেখা দেয়। অরাজকতা, দুর্ভিক্ষ, হত্যাকান্ড সব মিলিয়ে তু ফুর জীবন বিপন্ন হয়ে পড়ে। বিদ্রোহীদের হাতে তিনি বন্দীও হয়েছিলেন। অভাব অনটনে প্রত্যন্ত এলাকায় তিনি পরিবার নিয়ে ছিলেন। তার স্বাস্থ্যও ভেঙে পড়ে।
তবে এ সময়েই কিন্তু তার লেখায় গতি আসে। তিনি অসাধারণ সব কবিতা লিখতে থাকেন যা চীনা সাহিত্যের চিরায়ত সম্পদে পরিণত হয়। কবি হিসেবে তার নামও ছড়িয়ে পড়তে থাকে। তিনি চারপাশের মানুষের কষ্ট, বেদনা সংগ্রাম সেই সঙ্গে চীনা প্রকৃতির বিশালতা নিয়ে লিখতে থাকেন।
বিদ্রোহ শান্ত হওয়ার পর একেবারে শেষ জীবনে তু ফু অবশ্য কিছুটা আর্থিক স্বচ্ছলতা পেয়েছিলেন কারণ প্রদেশের গভর্নর তার কবিতা পছন্দ করতেন এবং তাকে সরকারি সহায়তা দেন। কিন্তু ভগ্নস্বাস্থ্য, রোগ, শোক প্রভৃতিতে ভেঙে পড়েছিলেন কবি। অথচ এ সময়ে তিনি ৪০০ কবিতা লেখেন যা প্রাণশক্তি ও শৈল্পিক সৌন্দর্যে অনন্য। তার লেখায় চীনা ইতিহাসেরও অনেক তথ্য পাওয়া যায়। ৭৭০ খ্রিস্টাব্দে ৫৭/ ৫৮ বছর বয়সে মৃত্যুবরণ করেন তু ফু। থাং রাজবংশের সময়কার সেরা কবিদের অন্যতম তুফু চীনের সাহিত্যে অমরতা পেয়েছেন তার সৃষ্টিকর্মের জন্য। তার প্রভাব রয়েছে জাপানি সাহিত্যেও। এখানে তু ফুর একটি কবিতার অনুবাদ দিচ্ছি। এটি তু ফুর একটি বিখ্যাত কবিতা। এর বিষয়বস্তু হলো অনেক বছর পরে তারুণ্যের এক বন্ধুর সঙ্গে তু ফুর দেখা হয়। তিনি তার বাড়িতে বসন্ত উৎসবের ভোজে অংশ নেন। পরদিনই তাকে আবার চলে যেতে হবে অন্য জায়গায়। হয়তো জীবনে আর কোনদিন দেখা হবে না। এমন একটি মধুর ও বিষাদের দ্যেতনার আবহে কবিতাটি লেখা। এখানে বলে রাখা ভালো, চীনা কবিতায় বন্ধুত্ব, দুই বন্ধুর মধ্যে দীর্ঘদিন দেখা না হওয়া এবং ক্ষণিকের জন্য আবার কথোপকথনের আনন্দ এগুলো বেশ প্রিয় বিষয়।
আমার অবসরপ্রাপ্ত বন্ধু ওয়েইর প্রতি
কবি: তু ফু
দুই বন্ধুর দেখা হওয়া কঠিন
দুই নক্ষত্রের মিলনের মতোই
আজ একটি বিরল ঘটনা
মোমবাতির আলোয় আমাদের আবার দেখা হলো
দুজন মানুষ, কিছুকাল আগেও যারা ছিল তরুণ
এখন চুলে লেগেছে রুপালি ছোঁয়া।
আমাদের বন্ধুরা অনেকেই মৃত
বিস্ময়ে, শোকে ভরে ওঠে হৃদয়।
ভাবতে অবাক লাগে
বিশ বছর হয়নি দেখা তোমার আমার।
যখন বিচ্ছেদ হয় তুমি তখনও কুমার
আর এখন, ছেলে মেয়েরা বসে আছে সারিবদ্ধ হয়ে।
সহৃদয় চোখে দেখছে তারা বাবার পুরনো বন্ধুকে ।
জানতে চায় কোথায় ছিলাম আমি অভিযানে, পাড়ি দিয়েছি কত পথ
আমাদের কথার ফাঁকে ওরা পরিবেশন করছে খাদ্য পানীয়।
রাতের বৃষ্টি ছুঁয়ে ভেসে আসছে বসন্তের বাতাস
রান্না হয়েছে ভাত উৎসবের আমেজে।
গৃহকর্তা মনে করিয়ে দিচ্ছেন এখন উৎসব-কাল।
অনুরোধ করছেন যেন পান করি দশ পেয়ালা সুরা
ওগুলো কি পারবে আমায় মাতাল করতে?
যেমন তোমার বন্ধুত্বে পূর্ণ ছিল আমার হৃদয়?
আগামিকাল আবার আমাদের মাঝে থাকবে দুস্তর পর্বত
তারপরের দিন, কে বলতে পারে কি হবে?
অনুবাদ: শান্তা মারিয়া
সূত্র : বিডিনিউজ