দালালচক্রের খপ্পরে পড়ে ভারতে পাচার হয়ে দীর্ঘদিন কারাভোগ করা রামুর ৫ যুবককে দেশে ফিরিয়ে এনেছে বেসরকারি সংস্থা ‘পালস বাংলাদেশ’। এছাড়া মনজুর আলম নামের আরো এক যুবক ৩ বছর পূর্বে মারা গেছেন ভারতের কারাগারেই। দীর্ঘদিন তারা ছিলেন- পরিবারের সাথে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন। নির্যাতনের বিভীষিকা থেকে মুক্ত হয়ে স্বজনদের ফিরে পেয়ে সবার চোখে গড়িয়েছে আনন্দাশ্রু। শুক্রবার, ১২ আগস্ট দুপুরে পালস বাংলাদেশ কর্তৃপক্ষ আনুষ্ঠানিকভাবে দেশে ফিরিয়ে আনা ৫ যুবককে স্বজনদের কাছে হস্তান্তর করেন।
ফিরে আসা যুবকরা হলেন- রামু উপজেলার কচ্ছপিয়া ইউনিয়নের ১নং ওয়ার্ডের দক্ষিণ পাড়ার আবু তাহেরের ছেলে সোহেল রানা, মৃত রশিদ আহমদের ছেলে মো. ইসমাইল, উত্তরপাড়ার মো. সুলতানের ছেলে আবদুল হামিদ, আলী আহমদের ছেলে শফি আলম এবং একই ইউনিয়নের ৩ নং ওয়ার্ডের পূর্ব তিতারপাড়ার মৃত রশিদ আহমদের ছেলে নুরুল আমিন।
শুক্রবার দুপুরে গাড়িযোগে এসব যুবক কক্সবাজার শহরের ঝিলংজা বিজিবি ক্যাম্প সংলগ্ন পালস বাংলাদেশ এর প্রধান কার্যালয়ে পৌঁছান। এসময় অনিশ্চিত গন্তব্য থেকে ফেরা ৫ যুবক এবং তাদের স্বজনরা কান্নায় ভেঙ্গে পড়েন। এসময় সেখানে হৃদয় বিদারক দৃশ্যের অবতারনা হয়।
পরে পালস বাংলাদেশ কার্যালয়ে ফুলেল শুভেচ্ছা জানিয়ে এসব যুবকদের বরণ এবং স্বজনদের কাছে হস্তান্তর করা হয়। এ উপলক্ষ্যে আয়োজিত অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির বক্তব্য রাখেন- এনজিও বিষয়ক ব্যুরোর মহাপরিচালক তরিকুল ইসলাম। স্বাগত বক্তব্য রাখেন- পালস বাংলাদেশ এর প্রধান নির্বাহী সাইফুল ইসলাম কলিম।
অনুষ্ঠানে বিশেষ অতিথির বক্তব্য রাখেন- অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (মানবসম্পদ ও ব্যবস্থাপনা) নাসিম আহমেদ, কক্সবাজার প্রেস ক্লাবের সাধারণ সম্পাদক ও দৈনিক কক্সবাজার সম্পাদক মোহাম্মদ মুজিবুল ইসলাম। অনুষ্ঠানে নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট নওশের ইবনে হালিম, বাংলাদেশ জাতীয় মহিলা আইনজীবি সমিতির কেইচ ম্যানেজমেন্ট কো-অর্ডিনেটর সেফাত জাহান, পাল্স বাংলাদেশ এর পরিচালক (প্রশাসন) আবদুল হামিদ, হেড অব প্রোগ্রাম আবুল আশার, সমন্বয়কারি মাহবুবুল আলম উপস্থিত ছিলেন।
অনুষ্ঠানে এনজিও বিষয়ক ব্যুরোর মহাপরিচালক বলেন- প্রতিটি দেশে সীমান্ত আইন রয়েছে। সীমান্ত পাড়ি দিয়ে অন্যদেশে প্রবেশ করা আইনের লংঘন। কিন্তু রামুর এসব যুবকরা যেভাবে হয়রানির শিকার হয়েছে, তা মেনে নেয়ার মতো না। তারা সেখানে হয়রানির শিকার হলেও কোন আইনী সহায়তা পায়নি। এমনকি দেশের দূতাবাসও হয়তো এ বিষয়ে সুনজর দেয়নি। সেখানকার আইনী সহায়তা পেলে তারা অনেক আগেই মুক্তি পেয়ে দেশে ফেরার সুযোগ পেত। মানবিক এ কাজে ভূমিকা রাখায় তিনি পালস বাংলাদেশ কর্তৃপক্ষকে ধন্যবাদ জানান।
অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (মানবসম্পদ ও ব্যবস্থাপনা) নাসিম আহমেদ বলেন- মানবপাচার রোধে সবাইকে সচেতন হতে হবে। কেউ যদি কাউকে বিদেশে নেয়ার প্রস্তাব দেয়, তাহলে সেটা যাচাইবাছাই করে যেতে হবে। প্রয়োজনে স্থানীয় ইউনিয়ন পরিষদ, পুলিশ প্রশাসন, সাংবাদিক বা সচেতন কোন ব্যক্তির কাছ থেকে বিদেশ গমনের বিষয়ে পরামর্শ নিতে হবে। এতে মানবপাচার কমে যাবে। মানুষ হয়রানির কবল থেকে মুক্তি পাবে।
কক্সবাজার প্রেস ক্লাবের সাধারণ সম্পাদক মোহাম্মদ মুজিবুল ইসলাম বলেন- ভারতের কাগারারে রামুর এসব যুবকদের কারাভোগ ও নির্যাতনের বিষয়টি খুবই হৃদয় বিদারক। পুরো জেলাজুড়ে এখন দালালচক্র সক্রিয়। ইতিপূর্বে থাইল্যান্ডে গণকবরের সন্ধান মিলেছিলো। মানবপাচার এখনো থেমে নেই। সবাইকে মানবপাচার রোধে সচেতন হয়ে একযোগে কাজ করতে হবে।
পালস বাংলাদেশ এর প্রধান নির্বাহী সাইফুল ইসলাম কলিম বলেন- রামুর ৬ জন যুবক দালাল চক্রের মাধ্যমে ভারতে পাচার হন। পাচার হওয়ার পর থেকে তাদের সাথে পরিবারের সদস্যদের যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে। পরবর্তীতে পাচার হওয়া যুবকরা সেখানে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর হাতে আটক করে জম্মু কাশ্মীর, হরিয়ানা সহ বিভিন্ন স্থানে কারাগারে আটক হয়ে মানববেতর সময় পার করছিলো। কয়েকবছর পূর্বে বিষয়টি জানতে পেরে পালস বাংলাদেশ তাদের দেশে ফিরিয়ে আনার উদ্যোগ নেয়। দীর্ঘদিন পর হলেও মানবিক এ প্রচেষ্টা সফল হয়েছে। এজন্য তিনি স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়, বাংলাদেশ জাতীয় মহিলা আইনজীবি সমিতি সহ বিভিন্ন সংগঠন ও সহায়তাকারি ব্যক্তিবর্গের কাছে কৃতজ্ঞতা জানিয়েছেন। তিনি আরো জানান- ৫ যুবককে ফিরিয়ে আনতে সকল প্রক্রিয়া সম্পন্ন করতে ব্যয়ভার বহন করেছে পালস বাংলাদেশ। এমনকি সংস্থার খরচেই তাদের বাড়িতে পৌঁছে দেয়া হবে।
ভারতের বন্দিদশা থেকে স্বজনদের কাছে ফেরা সোহেল রানা জানান- ভারতীয় পুলিশ তাদের সাথে পশুর চেয়েও নিকৃষ্ট আচরণ করেছে। অনেক সময় না খেয়ে থাকতে হয়েছে। পরিবারের কাছে ফেরার আশা তারা অনেক আগেই ছেড়ে দিয়েছিলেন। কিন্তু পালস বাংলাদেশ এর আন্তরিক প্রচেষ্টায় এখন তারা আবারো নতুন জীবনে ফিরেছেন।