পার্বত্য ভূমিতে রাবার চাষ, দেশের অর্থনীতিতে বৈপ্লবিক পরিবর্তন আনতে পারে। প্রয়োজন একটি সুনির্দিষ্ট নীতিমালার বাস্তবায়ন।
আমাদের দেশের রাবার শিল্প ধীরে ধীরে সামনের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। জাতীয় অর্থনীতিতে রাবার শিল্প ইতোমধ্যে বিশেষ অবদান রাখতে শুরু করেছে। দেশের রাবার শিল্প মালিকরা এখন সমন্বিত রাবার চাষের (বনজ, ফলদ, পশু পালন, পর্যটন) দিকে ঝুঁকছেন। দেশে উৎপাদিত উন্নত মানের রাবার দেশের চাহিদা পূরণ করে বিদেশেও রফতানি করা হচ্ছে। রাবার শিল্প/চাষ মূলত বিদেশ থেকে এদেশে এসেছে।
বর্তমানে রাবার দিয়ে সারা বিশ্বে ১ লাখ ২০ হাজার ধরনের দ্রব্যসামগ্রী তৈরি হচ্ছে। রাবার দিয়ে প্রধানত গাড়ির চাকার টায়ার, টিউব, বিমানের চাকা, জুতার সোল, স্যান্ডেল, ফোম রেক্সিন, হোসপাইপ, গাম, খেলনা, শিল্প কারখানার দ্রব্যসামগ্রী চিকিৎসাশাস্ত্রের বিভিন্ন সামগ্রীসহ গৃহস্থালি কাজের ব্যবহৃত বিভিন্ন সামগ্রী তৈরি হচ্ছে।
বাংলাদেশ রাবার চাষে নবীন হলেও এর ভূ-প্রকৃতি, জলবায়ু, পরিবেশ সহায়ক ও আর্থসামাজিক প্রয়োজনে রাবার চাষের গুরুত্ব অপরিসীম। দ্রুত বনায়ন, বনায়নের মাধ্যমে বিস্তীর্ণ এলাকার ভূমিক্ষয় রোধ, বিপুল কর্মসংস্থান, বিদেশে রফতানির মাধ্যমে বৈদেশিক আয়ের ব্যবস্থাসহ প্রভূত কল্যাণ সাধন হবে এদেশের রাবার চাষের মাধ্যম।
আমাদের পার্শ্ববর্তী রাষ্ট্র ভারতে রাবার চাষিদের বিশেষ রফতানি সুযোগ, ভর্তুকি সুবিধাসহ সহজ শর্তে ঋণ প্রদান এবং রাবার চাষিদের রাবার চাষে অনুদান প্রদান করছে। ফলে হাতে কলমে শিক্ষাসহ নানা ধরনের সাহায্য সহযোগিতা করে সেখানে রাবার চাষে বৈপ্লবিক পরিবর্তন হয়েছে। যা আমাদের দেশে এখনও পর্যন্ত সম্ভব হয়নি। বর্তমানে রাবার উৎপাদনে বিশ্বের মধ্যে ইন্দোনেশিয়া সবার শীর্ষে রয়েছে। সে দেশে রাবার চাষের ব্যাপারে সরকারের পক্ষ থেকে সর্বাত্মক সাহায্য-সহযোগিতা দেওয়া হচ্ছে। এর ফলে সেখানে রাবার শিল্প দিন দিন উন্নতি লাভ করছে।
এদিকে আমাদের দেশের রাবার শিল্পে বিরাজ করছে অজস্র সমস্যা। আমাদের দেশে প্রচুর পরিমাণে রাবার উৎপন্ন হওয়া সত্ত্বেও প্রতিবছর বিদেশ থেকে রাবার আমদানি করা হচ্ছে। যে কারণে আমাদের দেশের রাবার শিল্প বাধাগ্রস্ত হচ্ছে পদে পদে। বিদেশি রাবারে বাজার সয়লাব হয়ে থাকায় দেশি রাবারের বাজার চাহিদা সৃষ্টি হচ্ছে না। দেশি রাবার অবিক্রীত থেকে নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। রাবার চাষ করে চাষিরা ন্যায্য মূল্য পায় না। বর্তমানে দেশে যে পরিমাণ রাবার উৎপন্ন হচ্ছে, তা অভ্যন্তরীণ চাহিদা পূরণ করে বিদেশে রফতানি করা সম্ভব। দেশে উৎপন্ন রাবার থেকে ভ্যাটসহ সব ধরনের কর অবিলম্বে প্রত্যাহারসহ রাবার উৎপাদন ও রফতানির সঙ্গে জড়িত চাষি, শ্রমিকদের জন্য বিশেষ রেশন ও ত্রাণ সহায়তা প্রদানের ব্যবস্থা করা প্রয়োজন। যত দ্রুত সম্ভব রাবার উৎপাদনকারী বিশ্বের অন্যান্য দেশের মতো বাংলাদেশেও রাবারকে কৃষিপণ্য ঘোষণা করা দরকার। বিদেশে বাংলাদেশে উৎপাদিত রাবার রফতানির ক্ষেত্রে বিদ্যমান সমস্যা ও জটিলতা দূর করাসহ বিশেষ প্রণোদনার ব্যবস্থা করতে হবে। বিদেশ থেকে রাবার আমদানির ওপর ৫০ শতাংশ হারে শুল্ক আরোপ করাসহ রাবার আমদানির ক্ষেত্রে বাংলাদেশ রাবার বোর্ডের অনুমোদন গ্রহণ বাধ্যতামূলক করা অপরিহার্য।
প্রতিবেশী দেশ ভারতের মতো শূন্য শতাংশ থেকে তিন শতাংশ হারে সুদে দীর্ঘমেয়াদি রাবার ঋণ প্রদানের ব্যবস্থা করতে হবে বিভিন্ন ব্যাংকের মাধ্যমে। শ্রীলঙ্কা, ভারত এবং থাইল্যান্ডে রাবার চাষে বিশেষ ভর্তুকি দেওয়ার ব্যবস্থা চালু রয়েছে। সেসব দেশের মতো আমাদের দেশেও রাবার চাষে বিশেষ ভর্তুকি দেওয়ার ব্যবস্থা করতে হবে। এ লক্ষ্যে প্রাথমিকভাবে ক্লাইমেট চেঞ্জ ট্রাস্ট ফান্ড থেকে ভর্তুকির ব্যবস্থা গ্রহণ করা যেতে পারে। কারণ একটি রাবার গাছ পরিবেশ থেকে বছরে প্রায় ১৪৪ দশমিক ৫ কেজি কার্বনডাই-অক্সাইড শোষণ করে থাকে। ফলে পরিবেশবান্ধব উপকারী এই রাবার চাষে বিশেষ ভর্তুকি সহযোগিতা প্রদানের ক্ষেত্রে বিশেষ মনোযোগ দেওয়া একান্ত প্রয়োজন।
বন্য হাতির আক্রমণ এবং পাহাড়ি সন্ত্রাসীদের উপদ্রবে বান্দরবানসহ অন্যান্য পার্বত্য এলাকায় রাবার বাগান প্রায় সময়েই মারাত্মক ক্ষতির মধ্যে পড়ে। হাতিসহ অন্যান্য বন্য প্রাণীর এবং পাহাড়ি সন্ত্রাসীদের হাত থেকে রাবার বাগান রক্ষার জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। বন্য হাতির আক্রমণে ক্ষতিগ্রস্ত রাবার বাগানসমূহের মালিক ও চাষিদের উপযুক্ত ক্ষতিপূরণের ব্যবস্থা করা দরকার। রাবারের গতানুগতিক ব্যবহারের বাইরে বহুমুখী ব্যবহার নিশ্চিত করতে হবে। যেমন, রাস্তাঘাট তৈরির কাজে ব্যবহৃত বিটুমিনের সঙ্গে রাবারের ব্যবহার বাধ্যতামূলক করাসহ অন্যান্য কাজে রাবারের ব্যবহারে উদ্ভাবনী চেষ্টা চালাতে হবে। ভূমিদস্যু কর্তৃক রাবারের বাগান দখলের অশুভ চেষ্টা বন্ধ করতে হবে। রাবার বাগানের প্লট হস্তান্তর এবং নবায়নের ক্ষেত্রে রাবার গার্ডেন ওনার্স অ্যাসোসিয়েশন কর্তৃক প্রদত্ত সনদ ও মতামত গ্রহণ বাধ্যতামূলক করতে হবে।
রাবান বাগান এলাকার অবকাঠামো উন্নয়ন, বিদ্যুৎ সংযোগের ব্যবস্থা গ্রহণ এবং বাগান এলাকায় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাসহ সামাজিক পরিবেশ উন্নয়নের যথাযথ ব্যবস্থা করতে হবে। করোনা মহামারির প্রকোপে ক্ষতিগ্রস্ত রাবার বাগান মালিক, শ্রমিক, কর্মচারীদের জন্য বিশেষ প্রণোদনাসহ রাবার চাষিদের পৃষ্ঠপোষকতা ও সহায়তার জন্য সরকারের আলাদা প্রণোদনার ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে হবে। বাংলাদেশে দারুণ সম্ভাবনাময় পরিবেশবান্ধব রাবার চাষ খাতটিকে ধ্বংসের হাত থেকে রক্ষা করতে সরকারি সংশ্লিষ্ট মহলের সুদৃষ্টি প্রদান এখন সময়ের দাবি হয়ে উঠেছে।