দৈনিক শিক্ষা:
আগামী বছরের জানুয়ারি থেকে দেশের পাঁচটি ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর শিশুদের হাতে মাতৃভাষায় প্রাক্-প্রাথমিক স্তরের বই পৌঁছে দেওয়া হবে। এ জন্য মোট ২৪ হাজার ৬৪১টি (কপি) বই ছাপানো হচ্ছে। প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের চাহিদা অনুযায়ী জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড (এনসিটিবি) এই বই ছাপাচ্ছে।
অর্থাৎ আগামী বছর প্রাক্-প্রাথমিক স্তরে ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর শিক্ষার্থীর সংখ্যা হবে ২৪ হাজার ৬৪১ জন। অধিদপ্তর ও এনসিটিবির সংশ্লিষ্ট সূত্রে এ খবর জানা গেছে। এনসিটিবি সূত্র জানায়, বইগুলো লেখা, সম্পাদনা, চিত্রায়ণ প্রভৃতি কাজ শেষ হয়েছে। ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর নিজস্ব সংস্কৃতির চিত্রায়ণসহ আনুষঙ্গিক বিষয় দিয়ে বইগুলো সাজানো হয়েছে। কতগুলো বই প্রয়োজন হবে তা জানিয়ে দিয়েছে প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তর। তারা সংখ্যা জানানোর পর ছাপানোর প্রক্রিয়া শুরু করা হয়েছে।
যে পাঁচটি ভাষায় বই ছাপানো হচ্ছে সেগুলো হলো চাকমা, মারমা, ত্রিপুরা, গারো ও ওঁরাও। এর মধ্যে চাকমা ও মারমা ভাষার বইগুলো তাদের নিজস্ব লিপিতে লেখা। অন্য তিনটি নৃগোষ্ঠীর বইগুলোর কোনোটি বাংলা, কোনোটি রোমান হরফে লেখা।
এনসিটিবি সূত্র জানায়, সাঁওতাল জনগোষ্ঠী বইয়ের হরফ সম্পর্কে দ্বিধাবিভক্ত হয়ে পড়ায় এ বছর তাদের জন্য বই ছাপানো সম্ভব হচ্ছে না। সাঁওতালদেরও নিজস্ব লিপি নেই। তাদের প্রতিনিধিরা কেউ বাংলা এবং কেউ রোমান লিপিতে বই লেখার পক্ষে অবস্থান নিয়েছেন।
শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের সূত্র জানায়, আগামী বছর থেকে দেশের ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর শিশুরা মাতৃভাষায় পড়বে। প্রথমবার শুধু প্রাক্-প্রাথমিক স্তরের শিক্ষার্থীদের মাতৃভাষায় বই দেওয়া হবে। পরের বছর (২০১৮ সাল) দেওয়া হবে প্রাক্-প্রাথমিক ও প্রথম শ্রেণির বই। এর পরের বছর (২০১৯ সাল) দ্বিতীয় শ্রেণির শিক্ষার্থীদেরও মাতৃভাষায় বই দেওয়া হবে। এসব বই বিনা মূল্যে পাবে শিক্ষার্থীরা। এ জন্য অর্থসহায়তা দিচ্ছে ইউনিসেফ।
ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর শিশুরা কোন শ্রেণি পর্যন্ত মাতৃভাষায় শিক্ষার সুযোগ পাবে—জানতে চাইলে এনসিটিবির সদস্য রতন সিদ্দিকী বলেন, সাধারণভাবে বলা যায়, প্রাথমিক স্তর পর্যন্ত তারা এ সুযোগ পাবে। তবে দ্বিতীয় শ্রেণির পর তৃতীয় শ্রেণি থেকে তাদের মাতৃভাষার পাশাপাশি জাতীয় শিক্ষাক্রম অনুযায়ী বাংলা, ইংরেজি প্রভৃতি বই পড়তে হবে। তৃতীয় শ্রেণি থেকে এই দুইয়ের মধ্যে ‘ব্রিজিং’ শুরু হবে। এরপর ক্রমান্বয়ে তারা পুরোপুরি জাতীয় শিক্ষাক্রমে অন্তর্ভুক্ত হবে।
এনসিটিবির একজন শিক্ষাক্রম বিশেষজ্ঞ বলেন, কোনো শিশুকে ভবিষ্যৎ শিক্ষার জন্য প্রস্তুত করতে প্রাক্-প্রাথমিক পর্যায়ে মাতৃভাষায় শিক্ষা দেওয়া জরুরি। এরপর সে ধীরে ধীরে মাতৃভাষার সঙ্গে অন্য ভাষায় (বাংলাদেশের জন্য বাংলা) শিক্ষা নেবে। এ ক্ষেত্রে আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত সময় সাত বছর। এই সময়টাকে বলে ‘ব্রিজিং পিরিয়ড’। জাতীয় শিক্ষানীতিতেও শিশুদের মাতৃভাষায় শিক্ষা দেওয়ার কথা বলা হয়েছে।
ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর শিশুদের মাতৃভাষায় শিক্ষার জন্য বই ছাড়াও প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত শিক্ষক প্রয়োজন। এ বিষয়ে প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের সূত্র জানায়, শিক্ষক প্রশিক্ষণ শুরু করারও প্রক্রিয়া চলছে। তবে প্রাক্-প্রাথমিক পর্যায়ে পড়ানোর মতো শিক্ষক ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর মধ্যে অনেক আছে। তাই আগামী জানুয়ারির আগেই প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত শিক্ষক অপরিহার্য নয়।
এ বিষয়ে দ্বিমত পোষণ করে জাতীয় আদিবাসী ফোরামের সাধারণ সম্পাদক সঞ্জীব দ্রং বলেন, ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর মধ্যে যাঁরা শিক্ষকতায় নিয়োজিত আছেন, তাঁরা হয়তো প্রশিক্ষণ ছাড়াও প্রাক্-প্রাথমিক স্তরে শিক্ষাদান করতে পারবেন। কিন্তু তাঁদের সংখ্যা খুবই কম। সব জায়গায় তো ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর শিক্ষক নেই। বিভিন্ন সময় শিক্ষক নিয়োগের ক্ষেত্রে ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর লোকদের কোটা অনুযায়ী নিয়োগ না দেওয়ায় এ অবস্থা হয়েছে। তাই মাতৃভাষায় ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর শিশুদের শিক্ষা শুরু করতে হলে বিশেষ ব্যবস্থায় জরুরি ভিত্তিতে এই জনগোষ্ঠীর মধ্য থেকে প্রয়োজনীয় সংখ্যক শিক্ষক নিয়োগ করা দরকার।
দেশে সরকারি হিসাবে ৩৭টি এবং বেসরকারি হিসাবে ৪৫টি ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী থাকলেও চাকমা ও মারমা ছাড়া আর কারও ভাষার নিজস্ব লিপি নেই। ত্রিপুরা, গারো ও ওঁরাও নৃগোষ্ঠী বাংলা ও রোমান হরফে তাদের ভাষার বই পড়তে রাজি হয়েছে। অন্য যে নৃগোষ্ঠীগুলোর লিপি নেই, তাদের সংখ্যাও খুব কম। তারা বর্তমানের মতো জাতীয় শিক্ষাক্রমের অধীনেই পড়াশোনা করবে।