রামু ট্র্যাজেডির দশ বছর আজ। ২০১২ সালের ২৯ সেপ্টেম্বর রাতে সা¤প্রদায়িক সম্প্রীতি ও পুরাকীর্তির শহর রামুর বৌদ্ধ বিহার ও বৌদ্ধ বসতিতে হামলা, অগ্নিসংযোগ, ভাংচুর ও লুটপাট চালায় দূর্বৃত্তরা। উত্তম বড়ুয়া নামের এক বৌদ্ধ যুবক তার ফেসবুক পেইজে পবিত্র কোরআন অবমাননার ছবি পোষ্ট করেছে, এমন অভিযোগে এক রাতের কয়েকশত বছরের পুরনো ১২টি বৌদ্ধ বিহার ও ২৬টি বসত ঘর পুড়িয়ে দেয়া হয়। একই অভিযোগে পরের দিন ৩০ সেপ্টেম্বর উখিয়া, টেকনাফ ও পটিয়ার বিভিন্ন বৌদ্ধমন্দিরে অগ্নিসংযোগ ও হামলা চালায় দূর্বৃত্তরা। এ ঘটনায় পুলিশ বাদি হয়ে এজাহারভুক্ত ৩৭৫ জনসহ অজ্ঞাত ১৫/১৬ হাজার জনকে অভিযুক্ত করে ১৯টি মামলা করে পুলিশ। রামুতে একটি মামলা আপস মীমাংসায় খারিজ হয়।
কয়েক শত বছরের প্রাচীন প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন পুড়ে যাওয়ার ঘটনার পরপরই পোড়া মন্দিরে তৈরী হয়েছে নান্দনিক স্থাপনা। কিন্তু বিচারাধীন মামলার সাক্ষীর জন্য সমন জারি করা হলেও সাক্ষী দিতে আসছেনা কেউ। সাক্ষির অভাবে মামলার বিচারপ্রক্রিয়া প্রাথমিক পর্যায়ে থমকে আছে।
২০১২ সালের ২৯ সেপ্টেম্বর রামুতে বুদ্ধমুর্তি, বৌদ্ধ বিহার ও বৌদ্ধ বসতিতে ভাংচুর, লুটপাট ও অগ্নিসংযোগসহ উগ্র সাম্প্রদায়িক হামলার দশ বছর স্মরণে মানবতা ও শান্তি কামনায় দিনব্যাপী কর্মসূচীর আয়োজন করেছে, রামু কেন্দ্রীয় বৌদ্ধ যুব পরিষদ। রামুর লাল চিং ও মৈত্রী বিহারে আয়োজিত সেই বিভীষিকাময় দিন স্মরণ অনুষ্ঠানে দমদমা-নবাবপুর ধর্মকীর্তি বৌদ্ধ বিহারের আজীবন অধ্যক্ষ ড. ধর্মকীর্তি মহাথের প্রধান ধর্মদেশক ও রামু পানের ছড়া বৌদ্ধ বিহারের অধ্যক্ষ সুচারিতা মহাথের সভাপতিত্ব করবেন। ভোরে বুদ্ধপূজা, সকালে জাতীয় ও ধর্মীয় পতাকা উত্তোলন, অষ্ট পরিষ্কার দানসহ মহাসংঘদান, দুপুরে শান্তিপুর্ণ মানববন্ধন, অতিথি ভোজন, বিকালে হাজার প্রদীপ প্রজ্জ্বলন ও সন্ধ্যায় বিশ^শান্তি কামনায় সমবেত প্রার্থনার মাধ্যমে রামু সহিংসতার দশ বছর স্মরণানুষ্ঠানে মানবতা ও শান্তি কামনা করা হবে বলে জানান, রামু কেন্দ্রীয় বৌদ্ধ যুব পরিষদের সভাপতি কেতন বড়ুয়া ও সাধারণ সম্পাদক বিপুল বড়ুয়া আব্বু।
জানা গেছে, রামু থানার আট মামলার এজাহারে মোট আসামি সাত হাজার ৮৭৫। এর মধ্যে ১১১ জনের নাম-ঠিকানা থাকলেও পুলিশ গ্রেফতার করতে পেরেছিল মাত্র ৭৪ জনকে। সন্দেহভাজন আটক হয় ১৩২ জন। উখিয়া থানার সাত মামলায় পাঁচ হাজার ৬২৪ আসামির মধ্যে ১১৬ জন, টেকনাফ থানার দুটি মামলায় ৬৫৩ আসামির মধ্যে ৬৩ জন, কক্সবাজার সদর মডেল থানায় দুই মামলায় এক হাজার ৩০ আসামির মধ্যে ৯৮ জন গ্রেফতার হয়। পুলিশ মামলার অভিযোগপত্র আদালাতে জমা দেয়ার পরও দশ বছরে একটি মামলাও নিষ্পত্তি হয়নি। মামলার বিচারপ্রক্রিয়া প্রাথমিক পর্যায়ে থমকে আছে। এসব মামলায় গ্রেফতার হওয়া সবাই এখন জামিনে।
মামলা দায়ের করা হলেও দশ বছরেও বিচারপ্রক্রিয়া শেষ হয়নি। সাক্ষীর অভাবে এ বিচার প্রক্রিয়া থমকে আছে বলে জানিয়েছেন, কক্সবাজার জেলা ও দায়রা জজ আদালতের পাবলিক প্রসিকিউটর (পি. পি) অ্যাডভোকেট ফরিদুল আলম। রাষ্ট্রপক্ষের এ আইনজীবী বলেন, ১৮টা মামলার মধ্যে প্রায় ৯০০ জন আসামী ও ১৬০ জনের মতো সাক্ষী আছে। মামলাগুলো বিভিন্ন আদালতে বিচারাধীন এবং কিছু মামলা বিশেষ তদন্তাধীন আছে। এ সব মামলার সাক্ষীদের সমন জারি করা হয়েছে। কিন্তু কেউ সাক্ষী দিতে আসেননা। অধিকাংশ সাক্ষী বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের লোক। কিন্তু তারা সাক্ষ্য দিতে অনিহা প্রকাশ করছেন। প্রয়োজনে সাক্ষীকে পুলিশ প্রটেকশন দেয়া হবে বলেও তিনি জানান।
সাক্ষীর অভাবে মামলা ধামাচাপায় পড়ে যাবে কিনা, মামলার ভবিষ্যৎ কি হবে? এ বিষয়ে তিনি বলেন, মামলা ধামাচাপা দেয়ার কোন সুযোগ নেই। আইনে সেই সুযোগ রাখে নাই। আইন সাক্ষীকে সমন দেবে। প্রয়োজনে গ্রেফতার করে নিয়ে আসবে। কিন্তু সাক্ষীরা যদি অনিহা প্রকাশ করে, বেঁধে এনেও সাক্ষী দেয়াতে পারবো না। আমরা চেষ্টা করছি, অন্তত একটা মামলারও যেন সাক্ষী হয়। সাক্ষীর সহযোগীতায় বিচারকার্য তরান্বিত হবে। তিনি জানান, সা¤প্রদায়িক সম্প্রীতি বজায় রাখতে সবরকম পদক্ষেপ নিয়েছে সরকার।
দশ বছরে বৌদ্ধদের মাঝে ফিরেছে সম্প্রীতি। দৃষ্টিনন্দন স্থাপনাশৈলীতে পূণ্যার্থীদের পাশাপাশি বেড়েছে পর্যটক আকর্ষণ। ক্ষতিগ্রস্থরা পেয়েছেন নতুন ঘর। এখনও বিভিন্ন বিহারগুলোতে নিরাপত্তায় সতর্ক রয়েছে পুলিশ বাহিনী। সেনাবাহিনী সহ স্থানীয় প্রশাসন ও গোয়েন্দা সংস্থার সদস্যরা সার্বক্ষণিক নজরদারী রেখেছে সকল বৌদ্ধ বিহারে। পুজাপার্বন, ধর্মীয় উৎসবে অন্যধর্মালম্বীর সরব উপস্থিতে মুখরিত হয় এখন বিহার প্রাঙ্গন। সম্প্রীতিতে ফিরতে পারায় খুশি বৌদ্ধরা। তবে বিচারপ্রক্রিয়ার অচলাবস্থা নিয়ে বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের মাঝে রয়েছে এখনও অসন্তোষ। অপরাধীরা আইনের আওতায় না আসায় তাদের শংকা কাটছেনা।
রামু সহিংসতার রাতের ঘটনা স্মরণ করে রামু কেন্দ্রীয় সীমা মহাবিহারের পরিচালক শীলপ্রিয় থের বলেন, ২০১২ সালের ২৯ সেপ্টেম্বর বৌদ্ধ বিহারগুলো ধ্বংস করা সেই সম্পদ ফিরে পাওয়া সম্ভব নয়। ঘটনাটি স্মরণ করলে এখনও চোখ দিয়ে জল বাহির হয়ে যায়। দূর্বৃত্তরা আমাদের বৌদ্ধ বিহার ও বৌদ্ধ পল্লী পুড়িয়ে দিয়ে অনেক ক্ষতি করেছে। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার তড়িৎ সিদ্ধান্তে আমাদের নিরাপত্তা বৃদ্ধি করা হয়। বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর মাধ্যমে পুণঃনির্মাণ করে দেয়া হয় বৌদ্ধ বিহারগুলো। তিনি বলেন, আমরা হারিয়ে যাওয়া দিনের চেয়ে, বর্তমানে অনেক সম্প্রীতি ভোগ করছি। এখন আমাদের সম্প্রীতি অনেক বৃদ্ধি হয়েছে। আমরা রামুবাসিরা সম্প্রীতিতে আছি। আগামী দিনেও আমাদের এ সম্প্রীতি ধরে রাখতে হবে।
রামুর সহিংসতার পরে বর্তমান পরিস্থিতি সম্পর্কে জানতে চাইলে কক্সবাজার জেলা বৌদ্ধ সুরক্ষা পরিষদের সভাপতি প্রজ্ঞানন্দ ভিক্ষু বলেন, ঘটনার দশ বছরের ব্যবধানে পরিস্থিতি ঠিক আগের জায়গায় আটকে নেই। এলাকার সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতিতে যে ঘোর আঘাত এসেছিল, সেটা সামলে বর্তমান সবাই শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানের চেষ্টা করছেন। আশা করি আমরা সবাই মিলে আমাদের সম্প্রীতির বন্ধনকে আরো সুদৃঢ় করে তুলতে পারবো।
মামলার বিষয়ে তিনি বলেন, বর্তমান আটারটি মামলা বিচারাধীন আছে। বিচারিক কার্যক্রমের অংশ হিসেবে সাক্ষীদের সাক্ষ্য প্রদানের একটা বিষয় জড়িয়ে আছে। আমরা জেনেছি, সাক্ষীর অভাবে বিচারিক কার্যক্রম থেমে আছে। আমি ক্ষতিগ্রস্ত এবং প্রত্যক্ষদর্শীদের এই অনুরোধ করবো যে, আমরা সবাই যেন যার যার জায়গা থেকে মাননীয় আদালতকে সাহায্য করি। আমরা যেন হতাশ হয়ে না পড়ি। আমাদের সবাইকে আরো ধৈর্য্য ধারণ করতে হবে।
বৌদ্ধদের অভিযোগ, ন্যাক্কারজনক এ ঘটনায় দায়ীরা কেউ শাস্তি পায়নি এখনও। এ ঘটনায় আটকরা সবাই এখন জামিনে। অনেকেই বিদেশে পাড়ি দিয়েছে। এই ঘটনা কেন ঘটেছিল পেছনের সে কথা ঘটনার দশ বছরেও উন্মোচিত হয়নি। রাজনৈতিক বা দলীয় কোন মনোভাব থেকে এই ঘটনা ঘটেনি। এটি একটি ধর্মীয় বিদ্বেষ প্রসূত ঘটনা। এ ঘটনায় কম বেশি দলমত নির্বিশেষে অংশগ্রহণ করে ছিল। বিভিন্ন স্থিরচিত্র, ভিড়িও ফুটেজ এবং তদন্ত প্রতিবেদনেও তার প্রমাণ মিলেছে।
কিন্তু যাকে নিয়ে ঘটনার শুরু, ফেইসবুকে কোরআন অবমাননার ছবি ট্যাগকারী সেই উত্তম বড়ুয়া কোথায়? কি অবস্থানে আছে, জানেনা আইনশৃংখলা বাহিনী। সেই উত্তম বড়ুয়ার খোঁজ মেলনি ১০ বছরেও। উত্তম বড়ুয়া রামু উপজেলার ফতেখাঁরকুল ইউনিয়নের হাইটুপি গ্রামের সুদত্ত বড়ুয়া ও মাধবী বড়ুয়ার ছেলে। উপার্জনকারী একমাত্র ছেলেকে হারিয়ে উত্তমের বাবা-মা এখন চরম দূরাবস্থায় দিন কাটাচ্ছেন। তারা এখনো আশায় বুক বেঁধে আছেন একদিন তাদের ছেলে উত্তম ঘরে ফিরে আসবে।
যে উত্তম বড়ুয়াকে কেন্দ্র করে লঙ্কাকান্ড ঘটে গেছে রামু, টেকনাফ, উখিয়া ও পটিয়ায়। সেই উত্তম কোথায় আছে সেই বিষয়েও নিশ্চিত কোন তথ্য জানা নেই পুলিশের কাছে। অথচ ঘটনার প্রকৃত কারণ জানতে দরকার উত্তমকে। কে. কিভাবে তার ফেইসবুকে এই ছবি ট্যাগ করলো সেটি জানতেও দরকার উত্তম বড়ুয়ার স্বীকারোক্তি। কিন্তু ঘটনার আট বছরেও পুলিশ তার অবস্থান সর্ম্পকে নিশ্চিত হতে না পারায় ক্ষুব্দ রামুর সাধারণ মানুষ। রামুতে বৌদ্ধ বিহার পোড়ানোর ঘটনার রাতেই পালিয়ে যায় উত্তম বড়ুয়া।