দীর্ঘ পাঁচ বছর পর অবশেষে চূড়ান্ত হচ্ছে শিক্ষা আইন। গত বুধবার আইনটির খসড়া চূড়ান্ত করেছে শিক্ষা মন্ত্রণালয়। আইনে নোট বই ও গাইড বই নিষিদ্ধ করা হলেও কোচিং সেন্টার বহাল থাকছে। আইনটি মন্ত্রিপরিষদের অনুমোদনের জন্য চলতি সপ্তাহে পাঠানো হবে বলে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের সূত্রে জানা গেছে। খবর বাংলাট্রিবিউনের।
খসড়া অনুযায়ী, প্রস্তাবিত আইনে নোট বই বা গাইড বই নিষিদ্ধ করা হলেও শাস্তির বিষয়ে উল্লেখ নেই। অন্যদিকে কোচিং সেন্টার নিষিদ্ধ করা হয়নি,উপরন্তু শিক্ষার মানোন্নয়নের সহায়ক হিসেবে বিবেচনা করা হয়েছে। কোচিং সেন্টারগুলোর শিক্ষা কার্যক্রম নিয়ন্ত্রণ ও মনিটরিং -এর জন্য নীতিমালা প্রণয়নের কথা বলা হয়েছে। রাজনৈতিক সংশ্লিষ্টতার অভিযোগ পেলে কোচিং সেন্টার বন্ধ করতে পারবে সরকার। খসড়া আইন অনুযায়ী কোনও শিক্ষক নিজ প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীদের প্রাইভেট পড়াতে পারবেন না।
ক্ষুদ্র জাতিসত্তা ও নৃগোষ্ঠীর জন্য পর্যায়ক্রমে মাতৃভাষায় প্রাথমিক শিক্ষা দেওয়ার কথা বলা হয়েছে। প্রাথমিক স্তরের বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন শিক্ষার্থীদের জন্য বিশেষ শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যসূচি চালু করা হবে। প্রাথমিক স্তরের ভর্তির ক্ষেত্রে সরকারি নির্দেশনা অমান্য করলে শাস্তির বিধান রেখে বলা হয়েছে, ‘প্রাথমিক স্তরের ভর্তির ক্ষেত্রে সরকারি নির্দেশনা অমান্য করলে দুই লাখ টাকা জরিমানা, বা ছয় মাসের কারাদণ্ড বা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত করা হবে।’
ইংরেজি মাধ্যম স্কুল ও কিন্ডারগার্টেনসহ সব ধরনের প্রতিষ্ঠানকে সরকারের নিবন্ধন নিয়ে তবেই পরিচালনা করা যাবে বলে শিক্ষা আইনে বলা হয়। বিদেশি কোনও প্রতিষ্ঠানের ‘ও’ লেভেল এবং ‘এ’ লেভেল বা সমপর্যায়ের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে বাংলা, বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের ইতিহাস, বাংলাদেশ স্টাডিজ বাধ্যতামূলক করা হয়েছে।
এসব প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীদের বেতন ও অন্যান্য ফি নির্ধারণের বিষয়ে শিক্ষা বোর্ড থেকে অনুমোদন নিতে হবে। আইন লঙ্ঘন করলে পাঁচ লাখ টাকা জরিমানা বা এক বছর কারাদণ্ড অথবা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত করা হবে বলেও আইনে অন্তর্ভুক্ত হয়েছে। বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শিক্ষক নিয়োগের জন্য একটি স্থায়ী ‘বেসরকারি শিক্ষক নির্বাচন কমিশন’ গঠন করা হবে বলেও আইনে রয়েছে।
আইনের খসড়ায় বলা হয়েছে, উচ্চশিক্ষা স্তরের সরকারি-বেসরকারি সকল প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীদের বেতন ও অন্যান্য ফি সরকার কর্তৃক নির্ধারিত হবে। এজন্য একটি ‘রেগুলেটরি কমিশন’ গঠন করা হবে। সকল বিশ্ববিদ্যালয়ের স্নাতক ও স্নাতকোত্তর পর্যায়ে মূল্যায়ন অভিন্ন গ্রেডিং পদ্ধতিতে হবে। সরকারি-বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলো অনুমোদন নিয়ে দূর শিক্ষণ এবং ই-লার্নিং পদ্ধতিতে কোর্স বা প্রোগ্রাম চালাতে পারবে। অ্যাক্রেডিটেশন কাউন্সিল সকল বিশ্ববিদ্যালয়ের মান নির্ণয় ও উন্নয়ন করবে।
জনসংখ্যার ঘনত্ব, ভৌগলিক অবস্থান ও গুরুত্ব, অনগ্রসরতা, দূরুত্ব, প্রতিকূল যোগাযোগ ব্যবস্থা, নদী ভাঙন ইত্যাদি বিবেচনা করে প্রাথমিক থেকে উচ্চ শিক্ষার স্তর পর্যন্ত একীভূত, একত্রীকরণ, স্থানান্তর, বিলুপ্ত করা যাবে না। সরকারের অনুমতি ছাড়া কোনও ধরনের শিক্ষা প্রতিষ্ঠান স্থাপন করা যাবে না। এ ক্ষেত্রে আইন ভঙ্গ করলে তিন লাখ টাকা জরিমানা বা ছয় মাসের কারাদণ্ড বা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত করা হবে। তবে প্রবাসী বাংলাদেশিরা জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ডের (এনসিটিবি) শিক্ষাক্রম ও সংশ্লিষ্ট দেশের আইন অনুযায়ী প্রাথমিক স্তরের বাংলাদেশি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান স্থাপন করতে পারবে।
আইনে শিশুবান্ধব শিক্ষার অনুকুল পরিবেশ, শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যসূচি, ভর্তি, ধর্ম, শিক্ষা, নৈতিক শিক্ষা, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবা, ১৫ বছর ও তদূর্ধ্বদের বয়স্ক শিক্ষার বিধান রাখা হয়েছে। স্কুলের পাশপাশি মাদ্রাসায় অভিন্ন পাঠ্যবই থাকবে। কওমি মাদ্রাসার শিক্ষার উন্নয়নে গুরুত্ব দেওয়ার কথা বলা হয়েছে। সব প্রতিষ্ঠানে বাধ্যতামূলক ব্যবস্থাপনা কমিটি ও শিক্ষক-অভিভাবক পরিষদ গঠন করতে হবে। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের সব আয়-ব্যয় ব্যাংক হিসাবের মাধ্যমে পরিচালনা করতে হবে। অনিয়ম, দুর্নীতি, রাষ্ট্র বা শৃঙ্খলাবিরোধী কর্মকাণ্ডে জড়িত হলে শিক্ষকদের শাস্তির বিধান রাখা হয়েছে। সর্বোপরি বৈষম্য, সাম্প্রদায়িক ও মানসম্মত শিক্ষা ব্যবস্থা নিশ্চিত করার জন্য ‘স্থায়ী শিক্ষা কমিশন’ গঠন করা হবে।
শিক্ষার্থীদের শারীরিক শাস্তি বা মানসিক নির্যাতন করলে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়া হবে। ৪৯ টি ধারা সংবলিত আইনটি থেকে বহুল আলোচিত প্রশ্ন ফাঁস সংক্রান্ত বিধান তুলে দেওয়া হয়েছে। এর আগে দ্বিতীয় খসড়ায়ও এই বিধানটি ছিল।
ওই খসড়ায় পাবলিক পরীক্ষায় প্রশ্ন ফাঁস বা এর সঙ্গে জড়িত থাকলে চার বছরের সশ্রম কারাদণ্ডের বিধান ছিল। তবে ‘পাবলিক পরীক্ষাসমূহ (অপরাধ) আইন ১৯৮০’ নামে সুনির্দিষ্ট আইন থাকায় এবার প্রশ্ন ফাঁসের বিষয়টি বাদ দেওয়া হয়েছে।
প্রসঙ্গত, জাতীয় শিক্ষানীতি-২০১০ এর আলোকে ২০১১ সালে শিক্ষা আইন প্রণয়নের উদ্যোগ নেয় সরকার। ২০১১ সালের জানুয়ারিতে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের যুগ্ম-সচিবকে (আইন ও অডিট) আহ্বায়ক করে শিক্ষানীতি প্রণয়ন কমিটির কয়েকজন সদস্যকে শিক্ষা আইনের খসড়া তৈরির দায়িত্ব দেওয়া হয়। কমিটি ২০১২ সালে এই খসড়া তৈরি করে। পরে সংযোজন-বিয়োজন শেষে ২০১৩ সালের ৫ আগস্ট জনমত যাচাইয়ের জন্য আইনের খসড়াটি মন্ত্রণালয়ের ওয়েবসাইটে প্রকাশ করা হয়। এ নিয়ে বিতর্ক সৃষ্টি হলে থমকে যায় শিক্ষা আইন প্রস্তুতের কাজ। পরে সর্বশেষ গত ৩ এপ্রিল তৃতীয়বারের মতো ২৩ পৃষ্ঠার খসড়া প্রকাশ করা হয়। ১০ এপ্রিলের মধ্যেই শিক্ষাবিদ ও বিশেষজ্ঞসহ শিক্ষা সংশ্লিষ্ট সবাইকে মতামত দেওয়ার অনুরোধ করা হয়।