খুলনা মহানগরীর শিববাড়িসহ দুটি স্থানের নাম পরিবর্তনের উদ্যোগ নিয়েছে খুলনা সিটি করপোরেশন (কেসিসি)। এর মধ্যে শিববাড়ি মোড়কে ‘বঙ্গবন্ধু চত্বর’ এবং বর্তমান বঙ্গবন্ধু চত্বরের নাম পরিবর্তন করে ‘শহীদ শেখ আবু নাসের চত্বর’ করা হবে।
এই বিষয়ে কেসিসির একটি সভার কার্যবিবরণী সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়লে অনেকেই সমালোচনা করছেন। অনেকে এই উদ্যোগের পেছনে সাম্প্রদায়িকতার গন্ধ পাচ্ছেন। কেউ কেউ মনে করছেন, মূলত শেখ আবু নাসেরের নামে একটি চত্বরের নামকরণের বৈধতা দিতেই এই উদ্যোগ নেয়া হয়েছে— বদলানো হচ্ছে খুলনা শহরের শিববাড়ির নাম। কেসিসির নামপরিবর্তন সংক্রান্ত সভার কার্যবিবরণীতেই দেখতে পাই, কেসিসি বর্তমান বঙ্গবন্ধু চত্বরের নাম পরিবর্তন করে ‘শহীদ শেখ আবু নাসের চত্বর’ রাখতে চায়। যদি এ সিদ্ধান্ত বাস্তবায়িত হয়, সম্ভবত এটিই হবে আওয়ামী লীগ শাসনামলে বঙ্গবন্ধুর নামে নামাঙ্কিত কোনো কিছুর নাম পরিবর্তনের উদাহরণ।
তবে উদ্দেশ্য যা-ই হোক, স্থানের নাম পরিবর্তন নতুন কিছু নয়। কিছু কিছু স্থানের নাম পরিবর্তন বা পরিবর্তনের উদ্যোগের পেছনে যে সাম্প্রদায়িক চেতনা কাজ করেছে, সেটিও অস্বীকার করার সুযোগ নেই। যেমন ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নাম এখনও অনেকে বি. বাড়িয়া লেখেন। অনেকে লেখার সুবিধার্থে বি. বাড়িয়া লিখলেও এর পেছনে যে একটা সাম্প্রদায়িক চিন্তা ছিল, সেটি না বোঝার কিছু নেই। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নাম রাখা হয়েছিল রহমানবাড়িয়া। স্থানের নামের মুসলমানিকরণ সবচেয়ে বেশি হয়েছে এরশাদ সরকারের আমলে, ওই সময় জয়দেবপুরের নাম গাজীপুর এবং বিক্রমপুরের নাম মুন্সিগঞ্জ করা হয়। এই নাম পরিবর্তনের পেছনেও ধর্মীয় চিন্তা কাজ করেছে বলে মনে করা হয়।
১৯৭১ সালে বেশ কয়েকটি বড় যুদ্ধ হয়েছিল ঝালকাঠি ও পিরোজপুরের সীমান্তসংলগ্ন বিভিন্ন পেয়ারাবাগানে। সেখানে পিরোজপুরের একটি উপজেলার নাম ছিল ‘স্বরূপকাঠি’। এই নামের সঙ্গে কেনো ধর্মীয় রং নেই। কিন্তু তারপরও অফিসিয়ালি স্বরূপকাঠি এখন ‘নেছারাবাদ’। এই এলাকার একটি জায়গার নাম শর্ষিনা। ১৯৭১ সালে এই শর্ষিনা দরবার শরিফের যিনি পীর ছিলেন (আবু জাফর মোহাম্মদ সালেহ), তাকে জিয়াউর রহমানের আমলে স্বাধীনতা পুরস্কার দেয়া হয়। যেটি নিয়ে পরবর্তীকালে অনেক বিতর্ক হয়েছে। কেননা অভিযোগ আছে, ১৯৭১ সালে তিনি ছিলেন পাকিস্তানি হানাদারদের দোসর। ধারণা করা হয়, এই পীর সাহেবের উত্তরসূরিদের প্রভাবেই স্বরূপকাঠির নাম পরিবর্তন করে নেছারাবাদ রাখা হয়েছে। যদিও সাধারণ মানুষ এখনও জায়গাটিকে স্বরূপকাঠি বলেই চেনেন।
অন্যদিকে যে সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের ধর্মীয় অনুভূতি কাজে লাগিয়ে জিয়াউর রহমান ক্ষমতায় টিকে থাকতে চেয়েছিলেন বলে একজন স্বাধীনতাবিরোধীকে স্বাধীনতা পুরস্কার দিয়েছিলেন বলে মনে করা হয়, দেশের প্রধান বিমানবন্দর থেকে তার নামটি মুছে দিতেও ওই ধর্মকেই অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করা হয়। অর্থাৎ জিয়া আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর এখন হজরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর। একজন সাবেক রাষ্ট্রপতির নাম বাদ দিয়ে আরেকজন রাজনীতিবিদ বা রাষ্ট্রনায়কের নামে বিমানবন্দরের নামকরণ করা হলে সেটি নিয়ে যে পরিমাণ বিতর্ক বা সমালোচনা হতো, একজন আউলিয়ার নামে নামকরণের ফলে সেই বিতর্ক এড়ানো গেছে বলে অনেকেই মনে করেন। অর্থাৎ এখানেও ধর্মের ব্যবহার রাজনীতির স্বার্থে।
সবচেয়ে বেশি নাম পরিবর্তনের ঘটনা ঘটছে পার্বত্য চট্টগ্রামে। তিন পার্বত্য জেলার একটি খাগড়াছড়ি আসলে ছিল ‘হাগারাছড়ি’। পাহাড়িরাও পরিবর্তিত নামটি মেনে নিয়েছে। চাকমা ভাষার ‘হাগারা’র অর্থ হলো ‘নলখাগড়া’। এ অঞ্চল একসময় নলখাগড়ায় ভরপুর ছিল বলেই নাম হয়েছিল হাগারাছড়ি। ‘শোং নাম হুং’ কিভাবে চন্দ্রপাহাড় হয়ে যায়, ‘তেংপ্লং চূট’ কেন নীলগিরি হয়ে গেছে, এই প্রশ্ন পাহাড়িদের।
কুয়াকাটার হুইচ্যানপাড়ার পাশে পাওয়া গিয়েছিল একটি প্রাচীন নৌকা, এমন সব নৌকাতে করেই বাংলাদেশের ওই উপকূলে ভিড়েছিল রাখাইনরা। কোনো এক রাখাইন মাতব্বর হুইচ্যানের নামে রাখা ওই গ্রামটির নাম এখন হোসেনপাড়া করার পাঁয়তারা চলছে। খোদ সংস্কৃতি মন্ত্রণালয় ও প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরের সৌজন্যে টানানো পরিচিতিমূলক লেখায় নৌকাটির প্রাপ্তিস্থান লেখা হয়েছে হোসেনপাড়া। অথচ ১৯৯১ ও ২০১১ সালের আদমশুমারিতেও গ্রামটির নাম ছিল হুইচ্যানপাড়া। সমুদ্রগামী পালতোলা যে নৌকা নিয়ে রাখাইনদের পূর্বপুরুষরা পটুয়াখালী ও বরগুনা উপকূলে এসে ভিড়েছিল, সেই নৌকাগুলোর একটি এই নৌকা উপকূলের মাটি খুঁড়ে বের করে ২০১২ সালে সংরক্ষণ করা হয় কুয়াকাটা পৌরসভার বৌদ্ধবিহার ও রাখাইন মহিলা মার্কেটের কাছে। শুধু হুইচ্যানপাড়া নয়, নামের বাঙালিকরণ ও ইসলামীকরণের আগ্রাসনে তালতলী উপজেলার ‘জোজিতংব’ অর্থাৎ ঋষিপাড়া নামের রাখাইন গ্রামটি ‘জাকির তবক’ নামে পরিবর্তিত হয়েছে, যা এখন সম্পূর্ণ রাখাইনশূন্য। ডংকপাড়ার নাম হয়েছে রসুলপুর, কালাচাঁদপাড়ার নাম আলীপুর, দোকাশীপাড়ার নাম দোভাষীপাড়া, কাথিপাড়ার নাম ফাঁসিপাড়া, পুনামাপাড়ার নাম ইসলামপুর।
রাজধানী ঢাকার রামকৃষ্ণ মিশন সড়কের নাম আর. কে মিশন রোড লেখার প্রবণতাও আছে। একটি সংবাদপত্র এটি চালু করেছিল। তারা ভাবমূর্তিকে লেখে ‘ভাবমর্যাদা’।
প্রতি বছর মঙ্গল শোভাযাত্রার ‘মঙ্গল’ শব্দটি নিয়েও কুতর্ক কম হয় না। যদিও যারা এই তর্ক করেন, তাদের মঙ্গলবার বলতে কিংবা অন্যের মঙ্গল কামনা করতে অসুবিধা নেই।
তবে এটি শুধু বাংলাদেশের নয়, বরং আঞ্চলিক রোগ।
প্রতিবেশী ভারতে বিজেপি ক্ষমতাসীন হওয়ার পর থেকে বিভিন্ন শহর, রেলস্টেশন, রাস্তা ও স্থাপত্যের নাম বদলে দেয়া হয়েছে। বিশেষ করে মুসলিম নামগুলো। যেমন এলাহাবাদ শহরের নাম বদলে হয়েছে ‘প্রয়াগরাজ’। মোগলসরাই স্টেশনের নাম করা হয়েছে ‘দীনদয়াল উপাধ্যায়’। ফৈজাবাদ জেলার নাম পাল্টে হয়েছে ‘অযোধ্যা’। গুজরাটের আহমেদাবাদ শহরের নাম বদলে ‘কর্ণাবতী’ রাখার দাবিও প্রবল। বিজেপির একাংশ তেলেঙ্গানার রাজধানী হায়দরাবাদের নাম রাখতে চায় ‘ভাগ্যনগর’। সবশেষ ভারতের রাষ্ট্রপতি ভবনের উদ্যান মোগল গার্ডেনের নাম বদলে করা হয়েছে ‘অমৃত উদ্যান’।
কথা হচ্ছে, ভারতে মুসলিম নামাঙ্কিত স্থানগুলোর নাম বদলে ফেলা হচ্ছে বলে বাংলাদেশেও একই কাজ করতে হবে? নিশ্চয়ই না। কিন্তু রাষ্ট্র ও রাজনীতিতে ধর্ম চিরকালই একটা বড় ফ্যাক্টর। সেটি অস্বীকার করার সুযোগ নেই। নেই বলে যখন গুজরাটে মুসলমানদের ওপর হামলা হয়, তার ঢেউ এসে বাংলাদেশে পড়ে। বাংলাদেশে যখন মন্দিরে আগুন ও প্রতিমা ভাঙচুর করা হয়, তার ঢেউ গিয়ে ভারতে পড়ে।
অসাম্প্রদায়িক চিন্তার মানুষেরা চিরকালই ধর্মকে রাজনীতি ও রাষ্ট্র থেকে আলাদা করার দাবি জানিয়েছেন। কিন্তু তাতে কোনো ফল হয়নি। কিন্তু দাবিটা জারি রাখতে হবে।
তবে স্থানের নাম পরিবর্তন যে সব সময় ধর্মীয় কারণে হয়েছে, তাও নয়। বরং রাষ্ট্র অনেক সময় জাতীয়তাবাদী চেতনা থেকেও নাম পরিবর্তন করতে পারে। যেমন ১৯৭১ সালের ১৭ এপ্রিল স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম সরকারের শপথ গ্রহণের স্থান মেহেরপুরের বৈদ্যনাথ তলা এখন ‘মুজিবনগর’। শপথ গ্রহণের পরে প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ উপস্থিত সাংবাদিকদের বলেছিলেন, আজ থেকে এই জায়গার নাম হলো বঙ্গবন্ধুর নামে ‘মুজিবনগর’। এখানে কোনো ধর্মীয় চেতনা ছিল না। এটি ছিল জাতীয়তাবাদী চিন্তা।
সাম্প্রতিক বছরগুলোতে রাজধানী ঢাকা শহরের অনেক সড়কের নামকরণ করা হয়েছে ভাষা শহীদদের নামে। কিছু সড়কের নামকরণ করা হয়েছে বীর মুক্তিযোদ্ধাদের নামে। কিন্তু মুশকিল হলো, লোকেরা ওই নামে চেনে না। রিকশাচালকরাও আগের নামেই চেনে। যেমন এই লেখা যিনি পড়ছেন তিনি কি বলতে পারেন বীর মুক্তিযোদ্ধা সি. আর দত্ত সড়ক কোনটি? আপনি কি জানেন শহীদ সাংবাদিক সেলিনা হোসেন সড়ক কোনটি?
কলকাতা শহরে ব্রিটিশদের রাখা অনেক নামও বদলে দেয়া হয়েছে। সম্ভবত সেখানে ধর্মীয় চেতনা নয় বরং জাতীয়তাবাদী অনুভূতি বেশি কাজ করেছে। যেমন জীবনানন্দের স্মৃতিবিজড়িত ল্যান্সডাউন রোড এখন শরৎ বসু রোড। হ্যারিসন রোডের নাম মহাত্মা গান্ধী সড়ক ইত্যাদি।
আবার দেশের বেশ কিছু এলাকার নামের উচ্চারণ বেশ বিব্রতকর। সেসব জায়গার নাম পরিবর্তনেরও দাবি আছে। কিছু কিছু নাম পরিবর্তনের উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। নীলফামারীর ‘মানুষ-মারা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়’ এখন ‘মানুষ-গড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়’। কিন্তু নেত্রকোণার ‘চোরের ভিটা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়’, ময়মনসিংহের ‘মাড়া দেওয়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়’, নরসিংদীর ‘কুকুরমারা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়’ কিংবা কুড়িগ্রামের ‘দুধ খাওয়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়’-এর নাম এখনও এরকমই আছে। প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয় দেশের প্রায় ২০০ বিদ্যালয় চিহ্নিত করেছে, যেগুলোর নাম পরিবর্তন করা হবে। প্রতিমন্ত্রী জাকির হোসেনের বক্তব্য জেনেছি এই বছরের ফেব্রুয়ারির মাঝামাঝিতে, বিভিন্ন পত্রপত্রিকায়। তিনি বলছেন, দেশের বিভিন্ন প্রান্তে ছড়িয়ে থাকা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলোর মধ্যে অনেকগুলোর নাম শ্রুতিকটু ও নেতিবাচক ভাবার্থসংবলিত, যা শিশুর রুচি, মনন, বোধ ও পরিশীলিতভাবে বেড়ে ওঠার জন্য অন্তরায়। এ জন্য প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয় এসব বিদ্যালয়ের নাম পরিবর্তন করে সুন্দর, রুচিশীল, শ্রুতিমধুর ও স্থানীয় বিশিষ্ট ব্যক্তি, বীর মুক্তিযোদ্ধাসহ স্থানীয় ইতিহাস, সংস্কৃতির সঙ্গে মানানসই নামকরণের সিদ্ধান্ত হয়েছে।
স্কুলের বাইরেও আরও অনেক স্থানের নামের উচ্চারণ নিয়ে ওইসব এলাকার মানুষেরাও বিব্রত বোধ করেন। যেমন পঞ্চগড়ের বোদা, খুলনার সোনাপোতা, রাঙ্গামাটির চুমোচুমি, ঝিনাইদহের চুলকানি বাজার, চাঁদপুরের ল্যাংটার হাট, ঢাকার কুত্তা মারা গলি ইত্যাদি। ফলে এসব এলাকার নাম যদি পরিবর্তনের উদ্যোগ নেয়া হয়, সেখানে কেউ ধর্ম ও রাজনীতির গন্ধ হয়তো খুঁজবেন না।
তবে এটিও ঠিক যে, ধর্মীয় অনুভূতি বা সাম্প্রদায়িক চিন্তা থেকেও অসংখ্য স্থানের নাম পরিবর্তন করা হয়েছে। কিন্তু যখনই কোনো স্থান বা স্থাপনার নাম সাম্প্রদায়িক চিন্তা থেকে পরিবর্তনের উদ্যোগ নেয়া হয় অর্থাৎ যখন সেখানে ধর্মের রং চড়ানো হয়, সেখানে আসলে ধর্ম নয়, বরং সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের (ভোটারের) অনুভূতি ক্যাশ করে ক্ষমতায় টিকে থাকার রাজনীতিটাই মুখ্য পালন করে।
সৌজন্যে : বিডিনিউজ