চলতি বছরের সেপ্টেম্বরেই ঢাকার সঙ্গে কক্সবাজারের রেল যোগাযোগ চালু হবে বলে আশা প্রকাশ করেছেন রেলমন্ত্রী নুরুল ইসলাম সুজন। চলমান প্রকল্পে এরইমধ্যে ৮৪ শতাংশ কাজ শেষ হয়েছে বলে জানিয়েছেন তিনি। বাকি ১৬ শতাংশ কাজ দ্রুত শেষ হবে বলেও আশা প্রকাশ করেছেন মন্ত্রী।
মঙ্গলবার (১৬ মে) কক্সবাজারের ঝিলংজায় দোহাজারি-কক্সবাজার রেললাইন প্রকল্পের কক্সবাজার আইকনিক রেলওয়ে স্টেশন নির্মাণকাজের অগ্রগতি পরিদর্শন শেষে মন্ত্রী এ কথা জানান।
রেলমন্ত্রী বলেন, কক্সবাজারে ট্রেনে করে আসার জন্য সারাদেশের মানুষ ভীষণ আগ্রহী হয়ে আছে। কাজের সুবিধার জন্য প্রকল্প দুটি ভাগে বিভক্ত। আগামী আগস্টের মধ্যে কাজ সম্পন্ন করে সেপ্টেম্বরে উদ্বোধনের জন্য সার্বিকভাবে চেষ্টা করা হচ্ছে। এটি চালু হলে দেশের পর্যটনখাতে ব্যাপক উন্নয়ন হবে। অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে রেল।
এদিকে, চট্টগ্রামের দোহাজারী-কক্সবাজার রেলপথের প্রধান আকর্ষণ দেশের প্রথম আইকনিক রেলস্টেশন। বিশাল আকৃতির একটি ঝিনুকের পেটে মুক্তার দানা, তার চারপাশে পড়ছে স্বচ্ছ জলরাশি- এ আবহের মাঝেই আসবে ট্রেন। দৃষ্টিনন্দন আধুনিক এ স্টেশন উন্নত বিশ্বের বিমানবন্দরের মতো দেখাবে। দেশের প্রথম আইকনিক রেলস্টেশনের নির্মাণকাজ এখন শেষ পর্যায়ে।
কক্সবাজারের জেলা প্রশাসক মুহম্মদ শাহীন ইমরান বলেন, কক্সবাজার অংশের ৫০ কিলোমিটার রেললাইনের কাজ শেষ হয়েছে। চট্টগ্রাম অংশের ৫০ কিলোমিটারের মধ্যে ২৫ কিলোমিটারের কাজ শেষ এবং বাকি ২৫ কিলোমিটারের কাজ আগস্টের মধ্যে শেষ হবে বলে আশা করছেন প্রকল্প কর্মকর্তারা। সবমিলিয়ে রেললাইন পুরোপুরি চালু হলে নতুন দিগন্তের সূচনা হবে দেশের পর্যটনশিল্পে।
দোহাজারী-কক্সবাজার রেলওয়ে প্রকল্পের কনস্ট্রাকশন ম্যানেজার মো. আবদুল জাবের মিলন বলেন, কক্সবাজার সৈকত তীর থেকে তিন কিলোমিটার দূরে ঝিলংজার চান্দেরপাড়ায় প্রায় ২৯ একর জায়গাজুড়ে ২১৫ কোটি টাকা ব্যয়ে আন্তর্জাতিকমানের দৃষ্টিনন্দন আইকনিক ঝিনুকাকৃতির রেলস্টেশন এখন দৃশ্যমান। এটি নির্মাণের সময় চীন, বেলজিয়াম, ইংল্যান্ড, ইতালিসহ বিশ্বের বিভিন্ন আধুনিক স্টেশনের সুযোগ-সুবিধা বিবেচনা করা হয়েছে। প্রকল্পটিতে ১১০ জন বিদেশিসহ মোট ২৫০ জন প্রকৌশলী এবং শ্রমিকসহ মোট ছয় শতাধিক লোকের চার বছরের শ্রমে আইকনিক রেলস্টেশন ভবনটি আজ দৃশ্যমান। এখন চারদিকে চলছে গ্লাস ফিটিংস, ছাদের স্টিল ক্যানোফি, আর নানা ধরনের ফিটিংস বসানোর কাজ।
তিনি বলেন, পুরো প্রকল্পের অগ্রগতি ৮৪ ভাগের বেশি। এশিয়ার প্রথম শতভাগ পর্যটনবান্ধব কেন্দ্রীয় শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত ছয়তলা বিশিষ্ট স্টেশনটির সম্পূর্ণ ফ্লোর এরিয়া ধরা হয়েছে ১ লাখ ৮৭ হাজার বর্গফুট। রাখা হয়েছে পর্যটকদের জন্য সব ধরনের সুযোগ-সুবিধা। পর্যটকরা যেন কক্সবাজারে দিনে এসে ঘুরে আবার ফিরে যেতে পারেন, সে ব্যবস্থাও রাখা হয়েছে। শুধু এই আইকনিক রেলস্টেশন নয়, এই প্রকল্পের আওতায় আরও ৯টি স্টেশন নির্মাণ করা হচ্ছে।
প্রকল্পের কনস্ট্রাকশন ম্যানেজার আরও বলেন, কক্সবাজার থেকে ফিরতি পথের প্রথম স্টেশন রামু, এরপর পর্যায়ক্রমে রয়েছে ইসলামাবাদ, ডুলাহাজারা, চকরিয়া, হারবাং, লোহাগড়া, সাতকানিয়া ও দোহাজারী রেলওয়ে স্টেশন। চট্টগ্রামের দোহাজারী-কক্সবাজার রেললাইন ছিল দেশের দক্ষিণ জেলাবাসীর জন্য স্বপ্ন-যা, এখন বাস্তবায়নের পথে।
প্রকল্প পরিচালক মুফিজুর রহমান বলেন, কক্সবাজারে অধিকাংশ পর্যটক একদিনের জন্যই আসেন। এসময় তারা নিজেদের মালপত্র রাখার নিরাপদ জায়গা পান না। বিষয়টিকে গুরুত্ব দিয়ে স্টেশনে রাখা হচ্ছে লাগেজ ও লকার সিস্টেম। এছাড়া থাকছে আধুনিক ট্রাফিক সুবিধা, বিশ্বমানের এ স্টেশনের নিচতলায় থাকছে টিকিট কাউন্টার, অভ্যর্থনাসহ নানা সুবিধা। দ্বিতীয়তলায় শপিংমল ও রেস্তোরাঁ।
তিনি আরও বলেন, তিনতলায় থাকবে তারকামানের হোটেল, যেখানে ৩৯টি রুমে থাকার সুযোগ পাবেন যাত্রীরা। থাকছে মসজিদ, শিশু যত্ন কেন্দ্র ও চলন্ত সিঁড়ি। থাকছে সাধারণ ও ভিআইপিদের জন্য ভিন্ন ভিন্ন ড্রপ এরিয়া, বাস, প্রাইভেটকার, মাইক্রোবাস এবং থ্রি হুইলারের জন্য আলাদা পার্কিং এরিয়া। থাকছে এটিএম বুথ, পোস্ট অফিস, ট্যুরিস্ট ইনফরমেশন বুথ ছাড়াও বিভিন্ন নিত্যপ্রয়োজনীয় সেবাকেন্দ্র।
২০১৮ সালের জুলাইয়ে রেলের এ মেগা প্রকল্পটির নির্মাণকাজ শুরু হয়। এই মেগাপ্রকল্পের দোহাজারী-কক্সবাজার পর্যন্ত ১০০ কিলোমিটার রেললাইন নির্মাণে ব্যয় হচ্ছে ১৮ হাজার ৩৪ কোটি ৪৭ লাখ টাকা। এর অর্থায়ন করেছে এশিয়ান উন্নয়ন ব্যাংক (এডিবি) ও বাংলাদেশ সরকার। এরমধ্যে দোহাজারী থেকে চকরিয়া পর্যন্ত চীনের ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান চায়না রেলওয়ে ইঞ্জিনিয়ারিং করপোরেশন (সিআরইসি) ও বাংলাদেশের তমা কনস্ট্রাকশন কোম্পানি কাজ করছে। অপরদিকে, চকরিয়া থেকে কক্সবাজার পর্যন্ত চায়না সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং কনস্ট্রাকশন করপোরেশন (সিসিইসিসি) ও বাংলাদেশের ম্যাক্স ইনফ্রাস্ট্রাকচার লিমিটেড দুই ভাগে রেললাইন নির্মাণ কাজটি করছে। ম্যাক্স ইনফ্রাস্ট্রাকচার লিমিটেড যে অংশে কাজ করেছে তাদের সেই অংশের কাজ খুব দ্রুত শেষ হয়েছে। এখন তমা কনস্ট্রাকশনের অংশের কাজ চলছে।
প্রকল্প সংশ্লিষ্টরা জানান, চকরিয়া থেকে কক্সবাজার অংশে ২০টি সেতুর মধ্যে ১৮টির কাজ শেষ হয়েছে। দোহাজারী-চকরিয়া অংশে ১৯টি সেতুর মধ্যে সাঙ্গু নদীর ওপর একটি, মাতামুহুরী নদীর ওপর দুটি এবং বাঁকখালী নদীর ওপর একটি বড় রেলসেতুর নির্মাণকাজ শেষ হয়েছে। বাকিগুলোর নির্মাণকাজ শেষপর্যায়ে।
মঙ্গলবার কক্সবাজারের জেলা প্রশাসন এবং সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের নিয়ে আইকনিক স্টেশনস্থল পরিদর্শন শেষে রামু থেকে মিয়ানমার সীমান্তের ঘুমধুম পর্যন্ত সিঙ্গেল লাইন ডুয়েল গেজ ট্র্যাক নির্মাণকাজের অগ্রগতি পরিদর্শন করেন রেলমন্ত্রী।
সূত্র : জাগোনিউজ