দৈনিকশিক্ষা:
জীবনযুদ্ধে হার না মানা এক মেধাবী ছাত্র এনামুল হক। কখনো বাদাম কখনো আখ বিক্রি করে নিজের লেখাপড়ার খরচ চালাতেন। এখন খুলনা মহানগরীতে রিকশা চালিয়ে সরকারি বিএল বিশ্ববিদ্যালয় কলেজে রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিষয়ে অনার্স শেষ করে মাস্টার্স করছেন।
পাশাপাশি নিজের ও ছোট ভাইয়ের পড়াশোনা, জটিলরোগে আক্রান্ত গর্ভধারিণী মায়ের চিকিৎসার খরচ যোগাচ্ছেন।পিতামাতার অভাব অনটনের সংসারে এনামুল হকের জন্ম। ১৯৯৮ সালে কেশবপুর উপজেলার মঙ্গলকোট শহীদ খালেক সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে দ্বিতীয় শ্রেণিতে পড়াকালেই তার জীবনযুদ্ধ শুরু।
জীবন সংগ্রামী এনামুল হকের রিকশায় উঠে এ প্রতিবেদকের সঙ্গে কথা হয়। কথার ফাঁকে ফাঁকে শোনায় তার সংগ্রামী জীবনের গল্প। এরপর আবেগ-আপ্লুুত হয়ে তার কষ্টেগাঁথা ঘটনার বর্ণনা করেন।
কীভাবে না খেয়ে, অন্যের বাড়ি কাজ করে দরিদ্রতার সঙ্গে সংগ্রাম করে টিকে আছেন তা শুনালেন। নীরবে তার কষ্টের কথা বলে চোখের পানি ফেললেন। তবে জীবনযুদ্ধে পরাজিত হতে চায় না এনামুল হক। তার বিশ্বাস এ লড়াইয়ে সে বিজয়ী হবে। তবে এখন চরম প্রতিকূলতার মাঝে দিন কাটাচ্ছে।
যশোর জেলার কেশবপুর উপজেলার মঙ্গলকোট গ্রামের দিনমজুর মো. ফজলুর রহমানের দুই ছেলে ও এক মেয়ের মধ্যে এনামুল হক সবার বড়। স্ত্রী, দুই ছেলে ও এক মেয়েকে নিয়ে ফজলুর রহমানের সংসার চালানোই ছিল দায়। তারপরে লেখাপড়ার খরচ চালানো তো দুঃসাধ্যের ব্যাপার।
কিন্তু শিশু এনামুল হক লেখাপড়ার প্রতি ছিল খুবই মনোযোগী। অভাবের কাছে হার না মেনে দ্বিতীয় শ্রেণির ছাত্র থাকাবস্থায় লেখাপড়ার ফাঁকে ফাঁকে সে বাদাম বিক্রি করে যে টাকা আয় হতো তা দিয়ে স্কুলের বই-খাতা-কলম কিনতো। এভাবে নিজের লেখাপড়ার খরচ নিজেই বহন করতো।
২০০৫ সালে অষ্টম শ্রেণিতে পড়া অবস্থায় গ্রামের রাস্তায় মাটির কাজ করে যে টাকা আয় করতো তা দিয়েই নিজের বই-খাতা-কলম ও স্কুলের খরচ বহন করতো। তখন তার পিতা বলেন-এভাবে শুধু লেখাপড়া করলেই চলবে না সংসারেরও খরচ চালাতে হবে।
তখন সে অভিমান করে গ্রাম থেকে খুলনা শহরে চলে আসে। শুরু করে রিকশা চালানোর কাজ। রিকশা চালিয়ে নিজের খরচ বহন করে। এভাবেই তার জীবন চলতে থাকে। ২০০৮ সালে মঙ্গলকোট মাধ্যমিক বিদ্যালয় থেকে এসএসসি ও ২০১০ সালে কেশবপুর শহীদ লে. মাসুদ কলেজ থেকে এইচএসসি পাস করে।
রিকশা চালিয়ে নিজের খরচ বহন করলেও মনোবল হারায়নি এনামুল। ২০১১ সালে খুলনার সরকারি বিএল বিশ্ববিদ্যালয় কলেজে রাষ্ট্রবিজ্ঞানে অনার্সে ভর্তি হয়। তখন পরিচয় হয় ইসলামী ব্যাংক খুলনা শাখার কর্মকর্তা ইফতেখার হোসেন, স্কুল শিক্ষিকা শামছুন নাহারের সঙ্গে।
তাদের সহযোগিতায় রিকশা কেনে এনামুল। এ সময় তাকে মঙ্গলকোট ইউপি চেয়ারম্যান মনোয়ার হোসেনও কিছু আর্থিক সহযোগিতা করেন। তার অনার্স পরীক্ষার সময় চরম অর্থ সংকটে পড়েন, তখন খুলনা চেম্বার অব কমার্সের পরিচালক শেখ আসাদুর রহমান সহযোগিতা করেন।
২০১৫ সালে অনার্স শেষ করে সে এখন রাষ্ট্রবিজ্ঞানের মাস্টার্সের ছাত্র। তার কলেজ রোল-১৪৮১, বিশ্ববিদ্যালয়ের-৯৭৪৩৮৫৬।
সে এখন শুধু নিজের লেখাপড়ার খরচ নয়; তার ছোট ভাই আশরাফুল আলমেরও লেখাপড়ার খরচও বহন করতে হয়।
আশরাফুলকেও সরকারি বিএল বিশ্ববিদ্যালয় কলেজে বিবিএ প্রথম বর্ষে ভর্তি করেছে। ইতিমধ্যে তার মা শিউলী বেগম ডায়বেটিকস ও কিডনি রোগে আক্রান্ত হয়েছেন। গত তিন বছরে তিনদফা খুলনার শহীদ শেখ আবু নাসের বিশেষায়িত হাসপাতালে চিকিৎসা নিয়েছেন।
কিডনি রোগ বিষেজ্ঞ প্রফেসর ডা. এনামুল কবিরের অধীনে তিনি চিকিৎসা নিচ্ছেন। জটিলরোগে আক্রান্ত মায়ের ওষুধের জন্য প্রতিমাসে এখন পাঁচ হাজার টাকার মতো খরচ হয়।
লেখাপড়ার শেষ প্রান্তে এসে নিজের এবং ভাইয়ের লেখাপড়ার খরচ এবং মায়ের চিকিৎসার ব্যয় বহন করতে গিয়ে রিকশাচালক এই মেধাবী ছাত্র এনামুল হিমশিম খাচ্ছে। মায়ের চিকিৎসা নিয়ে মানসিকভাবে ভেঙ্গে পড়েছে।
এনামুলের বৃদ্ধ পিতা-মাতা গ্রামে বসবাস করলেও সে নগরীর বয়রা বাজার মসজিদ রোডে ও ছোট ভাই আশরাফুল দৌলতপুর থেকে লেখাপড়া করছে। আর একমাত্র বোন মোসাম্মদ জান্নাতুল ফেরদৌসকে অস্টম শ্রেণি পর্যন্ত লেখাপড়া করিয়ে এলাকায় বিয়ে দিয়েছে।
মেধাবী এই ছাত্রের পরিবারে সহযোগিতার জন্য সমাজের বিত্তবানদের সুদৃষ্টি কামনা করা হয়েছে। এনামুল হকের মোবাইল নং-০১৯৯৩-৫০৪৫১৬।
দরিদ্র মেধাবী ছাত্র এনামুল হক প্রসঙ্গে সরকারি বিএল বিশ্ববিদ্যালয় কলেজের উপ-অধ্যক্ষ ও রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের সাবেক বিভাগীয় প্রধান প্রফেসর শিকদার মনিরুজ্জামান বলেন এনামুল খুব পরিশ্রমী ও মেধাবী ছাত্র। জন্মের পর থেকেই কষ্ট ও ত্যাগের মধ্যে দিয়ে এই পর্যন্ত আসতে সক্ষম হয়েছে।
রিকশা কেনার সময় কলেজের পক্ষ থেকে আমরা তাকে সহযোগিতা করেছি। সমাজে সচ্ছল ব্যক্তিদের উচিত দরিদ্র এই মেধাবী ছাত্রের পরিবারকে