সূত্রপিটকের মহাবর্গ কোশাম্বী স্কন্ধ মতে, গৌতম বুদ্ধ জীবদ্দশায় বুদ্ধত্ব লাভের দশম বর্ষে বর্তমান ভারতের কোশাম্বীর ঘোষিতারামে নবম বর্ষাবাস অতিবাহিত করেন। সেখানে থাকার সময় দু’জন ভিক্ষু – বিনয়ধর ও সূত্রধরের মধ্যে শৌচাগারে জল রাখা বিষয়ে বিনয় বিধান নিয়ে কলহের সৃষ্টি হয়। তথাগত বুদ্ধ তাদের বিবাদ মেটানোর জন্য নানা নির্দেশনা প্রদান করলেন। তাদের মধ্যে মিত্রতা, বুন্ধত্ব, ঐক্য এবং সংহতি সৃষ্টির জন্য নানা উদাহরণ দিয়ে বোঝাতে চেষ্টা করলেন।
কিন্তু সেই দুই ভিক্ষু মোটেই বুদ্ধের কথায় কান দিলেন না। পরে ভগবান বুদ্ধ দশম বর্ষাবাসের জন্য পারিলেয়্য বনে চলে যান। সেখানে গিয়ে বুদ্ধ দেখতে পেলেন একটা বৃদ্ধ হাতি অন্য হাতিদের দ্বারা নিগৃহীত হয়ে অখাদ্য, অপুষ্টিকর খাবার খেয়ে বেঁচে আছে। বুদ্ধ তখন তাকে সেবা-শুশ্রুষা করা শুরু করলেন। এর বিনিময়ে হাতিও বুদ্ধকে সেবা করলো নানাভাবে। বুদ্ধের থাকার জায়গা করে দিল, দিনরাত পাহারা দিত, বনের ফলাদি আহার্য এনে দিত, বুদ্ধের ব্যবহার্য জল এনে দিত। ভগবান বুদ্ধ পিণ্ডচারণের জন্য বের হলে পাত্র নিয়ে যেত। মানুষের মতো পশুর মধ্যে বোধশক্তি আছে তা-ই প্রমাণ করল এই হস্তীরাজ।
বুদ্ধ এবং হাতির এমন সম্পর্ক দেখে বনের বানরের মধ্যেও বুদ্ধকে সেবা করার ইচ্ছা জাগে। সেই বানর একটি মৌচাক সংগ্রহ করে বুদ্ধকে দান করে। মৌচাকে ছানা ও ডিম থাকায় ভগবান বুদ্ধ প্রথমে সেই মধু দান গ্রহণ করলেন না। বানর বিষয়টা বুঝতে পেরে তা পরিষ্কার করে আবার বুদ্ধকে দান করলে বুদ্ধ এবার মধু গ্রহণ করলেন এবং পান করলেন। এতে বানর অত্যন্ত খুশি হয়ে ওঠে। খুশিতে এক গাছ থেকে অন্য গাছে লাফাতে লাফাতে হঠাৎ গাছের শাখা ভেঙ্গে বানরটি গাছ থেকে পড়ে মৃত্যুবরণ করল। পরে বানরটি পুণ্যবলে তাবতিংস দেবলোকে জন্মগ্রহণ করে। বানর কর্তৃক বুদ্ধকে মধু দানের এই বিরল ঘটনাটি ঘটেছিল ভাদ্র পূর্ণিমা তিথিতে। তাই ভাদ্র পূর্ণিমা বৌদ্ধদের কাছে মধু পূর্ণিমা নামে অত্যধিক পরিচিত।
অন্যদিকে ভিক্ষুরা নিজেদের ভুল বুঝতে পেরে বর্ষাবাস শেষে তাঁরা বুদ্ধের সেবক আনন্দ স্থবিরকে সাথে নিয়ে বুদ্ধকে ফিরিয়ে নিয়ে যান। বুদ্ধ লোকালয়ে চলে আসার এ শোকে কাতর হয়ে হাতি হৃদক্রিয়া বন্ধ হয়ে মারা যায়। সেই হাতিও মৃত্যুর পর তাবতিংস দেবলোকে জন্মগ্রহণ করে।
ভগবান গৌতম বুদ্ধের সমগ্র জীবন ইতিহাস প্রকৃতির হাত ধরে। রাজকীয় পরিবারে জন্মগ্রহণ করেও রাজপ্রাসাদে জন্ম হয়নি। তাঁর জন্ম হয়েছিল হিমালয়ের পাদদেশে অবস্থিত লুম্বিনী কাননে। পরবর্তীতে তিনি বিত্তবৈভব, পরিবার-পরিজন এবং রাজপ্রাসাদ ছেড়ে নৈর্বাণিক এবং বিমুক্তির ধর্ম প্রতিষ্ঠার জন্য গৃহত্যাগ করেন।
মানবজীবনের দুঃখ দৈন্যতা দেখে দুঃখ মুক্তির জন্য বুদ্ধ কঠোর ধ্যান সাধনা করেন গভীর অরণ্যে। দীর্ঘ ছয় বছরের সাধনায় চরম সত্য উদঘাটন করেন। দীর্ঘ সময় ধরে যখন তপস্যা করেছিলেন তখন বনের সব পশু-পাখির সঙ্গে ছিল তাঁর অসীম মৈত্রীভাব। বৌদ্ধধর্মের নীতিকথা, ‘অহিংসা পরম ধর্ম ’। শুধু মানুষ নয়, যে কোনো প্রাণীর প্রতি হিংসা করা পাপ।
ধম্মপদে উল্লেখ আছে,
`নহি বেরেন বেরানি সমন্তী ধ কুদাচনং
অবেরন চ সম্মন্তি, এস ধম্মোা সনন্তনো’
অর্থ্যাৎ শত্রুতার দ্বারা কখনও শত্রুতার উপশম হয় না। মিত্রতার দ্বারাই শত্রুতা প্রশমিত হয় বা শত্রুকে জয় করতে হয় – এটিই বুদ্ধের শিক্ষা।
মহামানবের প্রতিটি বাণীই মানব জীবনের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ। বৌদ্ধরা হাতির সেবা ও বানরের এই মধুদানকে কেন্দ্র করে ভাদ্র পূর্ণিমায় মধু পূর্ণিমা উদযাপন করে থাকেন।
সম্পাদক, আমাদের রামু।