আমার ছেলে সারা দিন টিভিতে ইংরেজি কার্টুন দেখে এখন আর বাংলায় কথা বলে না। সে মুখে অনেক কিছু বললেও হাতে কলম ধরে না। স্কুলের শুরু থেকেই তাকে নিয়ে শিক্ষকরা চিন্তিত। কারণ সে একদমই লিখতে চায় না।
এই যে এত নেতিবাচক কথা, সেটি আপনি নির্দ্বিধায় আপনার ছেলের সামনে আলাপ করছেন। একসময় দেখা গেলো, সে আরও বেশি আত্মকেন্দ্রিক হয়ে গেছে। স্কুলের শুরুর দিকে সে যতটুকু আনন্দ নিয়ে যেতো, এখন আর তার মাঝে সেই উচ্ছ্বাস নেই।
শিশুর বিকাশ নিয়ে যারা কাজ করেন, তারা বলছেন, একটি শিশু বড় হলে কেমন হবে, তার ভিত্তি তৈরির জন্য তিন থেকে আট বছর বয়স খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এই সময়ে পরিবার শিশুকে কীভাবে গড়ে তুলছে, কী শেখাচ্ছে, তার ওপরে নির্ভর করে—বড় হয়ে তার বুদ্ধিমত্তা, স্বভাব, চারিত্র্যিক বৈশিষ্ট্য, আচরণ, আত্মবিশ্বাস ইত্যাদি কেমন হবে। শিশুর পারিবারিক আবহ, শিশুর স্কুলের পরিবেশ, শিশুর আশপাশের মানুষদের পারস্পরিক সম্পর্ক তাকে পরিণত মানুষের পথে নিয়ে যেতে থাকে।
বিশ্বের সঙ্গে তাল মিলিয়ে প্রতি বছর অক্টোবর মাসের প্রথম সোমবার বাংলাদেশেও ‘বিশ্ব শিশু দিবস’ পালন করা হয়। সে অনুযায়ী এ বছর ২ অক্টোবর (সোমবার) পালিত হবে বিশ্ব শিশু দিবস। দিবসটি উদযাপনে নানা কর্মসূচির আয়োজন করেছে মহিলা ও শিশু বিষয়ক মন্ত্রণালয়। এরই ধারাবাহিকতায় শিশুর অধিকার, সুরক্ষা, উন্নয়ন ও বিকাশে সংশ্লিষ্ট সবাইকে অধিকতর উদ্যোগী ও সচেতন করার লক্ষ্যে ২ থেকে ৮ অক্টোবর পর্যন্ত পালন করা হবে শিশু অধিকার সপ্তাহ। রবিবার (১ অক্টোবর) মহিলা ও শিশু বিষয়ক মন্ত্রণালয় থেকে পাঠানো সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে এ তথ্য জানানো হয়েছে।
এতে বলা হয়, প্রতি বছরের মতো এ বছরও সারা দেশে যথাযথ মর্যাদায় বিশ্ব শিশু দিবস ও শিশু অধিকার সপ্তাহ উদযাপনের লক্ষ্যে বিভিন্ন কর্মসূচি গ্রহণ করা হয়েছে। এবারের বিশ্ব শিশু দিবসের প্রতিপাদ্য ‘শিশুর জন্য বিনিয়োগ করি, ভবিষ্যতের বিশ্ব গড়ি’।
সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে আরও বলা হয়, শিশুরাই শিক্ষা ও প্রযুক্তিতে সমৃদ্ধ হয়ে গড়ে তুলবে উন্নত-সমৃদ্ধ নতুন বিশ্ব। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান শিশুদের জন্য সমৃদ্ধ বাংলাদেশ গড়ার স্বপ্ন দেখেছিলেন। জাতির পিতা ১৯৭২ সালে সংবিধানে শিশুদের অধিকার নিশ্চিত করেন।
বিনিয়োগের ধরনগুলো যদি নির্দিষ্ট করে না দেওয়া হয়, তবে অভিভাবকের জন্যও সেটা অনেক জটিল রূপ ধারণ করে। শিশুচিকিৎসক রাকিবুল ইসলাম বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘শিশুদের জন্মের পর প্রথম এক হাজার দিন একদিক দিয়ে গুরুত্বপূর্ণ। এ সময় শিশুরা দাঁড়ানো, হাঁটা, দৌড়ানো, কথা বলা, কানে শোনা, ঘ্রাণ নেওয়া এগুলো শেখে। এই শেখাগুলোর বহিঃপ্রকাশ করার সুযোগ সে পায় এর পরের ধাপটিতে। তিন থেকে আট বছর বয়সের মধ্যেই সাধারণত একটি শিশুর ব্যক্তিত্বের মূল ভিত্তি গঠন হয়ে যায়।’
মনোচিকিৎসক মেখলা সরকার মনে করেন, শিশুর শারীরিক স্বাস্থ্যের মতোই তার মানসিক স্বাস্থ্য গুরুত্বপূর্ণ। সেটা পরিপূর্ণভাবে গঠন করা গেলে তবেই বড় হয়ে সে সমাজকে কিছু দিতে পারবে। এটাই বিনিয়োগ। এখন শিশুরা যেভাবে বড় হচ্ছে—তার কোথাও মেলামেশার সুযোগ নেই। দিনের বড় অংশজুড়ে শিশুকে ঘিরে রেখেছে প্রযুক্তি। বাবা-মা দুজনে কর্মজীবী হওয়ায় শিশুর মধ্যে আচরণগত সমস্যা বেড়ে উঠতে দেখা যাচ্ছে। ফলে শিশুর শারীরিক স্বাস্থ্য ঠিকঠাক করতে আমরা যে মনোযোগ দিই, মানসিক বিকাশে সেটা দিই না। একক পরিবারে শিশু আত্মকেন্দ্রিক ও বিচ্ছিন্নভাবে বেড়ে ওঠার কারণে জীবন-সংশ্লিষ্ট হতে পারছে না। ওই জায়গায় আমাদের মনোযোগ দেওয়া ও তার আট বছর পর্যন্ত জীবনটাকে সুন্দর করার উদ্যোগ নিতে হবে।’
ঢাকা আহসানিয়া মিশনের সিনিয়র সাইকোলজিস্ট ও অ্যাডিকশন প্রফেশনালস রাখী গাঙ্গুলি বলেন, ‘প্যারেন্টিংয়ের অসুবিধার কারণে শিশুদের মূল সমস্যা যেটা হয়, সেটি হলো—তার নীতির জায়গায়টা দুর্বল হয়। নৈতিকতার জায়গাগুলো স্পষ্ট থাকে না। একটি শিশুর ব্যক্তিত্ব গড়ে ওঠে ৫ বছর বয়সে। এর পরবর্তী বছরগুলোতে সেই গড়ে ওঠা ব্যক্তিত্ব ডালপালা মেলে। ফলে ৫ বছরের শিশুকে যদি আমরা গুরুত্ব দিয়ে বড় না করি, তাহলে এটা তার পরবর্তী জীবনে প্রভাব ফেলে। তার শিক্ষাটা সম্পূর্ণ হয় না। আচরণগত সমস্যা দেখা যায় এবং সে সামাজিক যোগাযোগে সহজ হতে পারে না। সমাজে কার সঙ্গে কীভাবে যোগাযোগ করতে হয়, সেটা সে বুঝতে শেখে না এবং একপর্যায়ে মাদকের দিকে ঝুঁকে যায়।’
‘শিশুর জন্য বিনিয়োগ করি, ভবিষ্যতের বিশ্ব গড়ি’ এবারের এই প্রতিপাদ্যের বিষয়ে জানতে চাইলে শিশু অধিকার বিশ্লেষক আব্দুল্লা আল মামুন বলেন, ‘এটা একটা আহ্বান। রাষ্ট্রীয় পর্যায় থেকে শুরু করে সামাজিক ও পারিবারিক পর্যায়ে ভবিষ্যতের জন্য শিশুদের মনে রেখে বিনিয়োগ করতে হবে। যাবতীয় পরিকল্পনা বাজেট ব্যবস্থাপনায় কাজ করবে রাষ্ট্র। পরিবারের বিনিয়োগ হলো—শিশুর বিকাশে সবচেয়ে গুরুত্ব দিয়ে যার যতটুকু সাধ্য আছে, সেটা যেন শিশুর বেড়ে ওঠার পেছনে ব্যয় করে। এবারের প্রতিপাদ্য একটু দূরবর্তী সময়ের জন্য। আমরা সবসময় বলি, আজকের শিশু আগামী দিনের ভবিষ্যৎ। এটা সত্য কথা, যদি সেই শিশুকে যথাযথ পরিবেশে বড় করা যায়। সেক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে—আমাদের বাজেটের কত শতাংশ শিশুদের বিকাশে ব্যয় হচ্ছে। আমাদের সামাজিক সুরক্ষা কর্মসূচি আছে, কিন্তু শিশুদের জন্য বিশেষ করে কোনও ব্যবস্থা কি আমরা নিতে পারছি?’
সূত্র : বাংলা ট্রিবিউন