নির্বাচনকে ঘিরে অনেক ষড়যন্ত্র-চক্রান্ত আছে উল্লেখ করে আওয়ামী লীগ সভাপতি ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, যারা আমাদের মুক্তিযুদ্ধে সমর্থন দেয়নি, পরাজিত শক্তি, তাদের চক্রান্ত থেমে যায়নি। আর যেহেতু তারা জানে কারও কাছে আমরা মাথা নত করি না, সেজন্য চক্রান্ত আরও বেশি। আমি জাতির পিতার কন্যা, কারও কাছে মাথা নত করি না, কারও কাছে মাথা নত করবো না।
মঙ্গলবার (২ জানুয়ারি) বিকালে ফরিদপুর সরকারি রাজেন্দ্র কলেজ মাঠে আয়োজিত এক নির্বাচনি জনসভায় তিনি এ কথা বলেন। আওয়ামী লীগের শাসনামলে দেশের উন্নয়ন-অগ্রযাত্রার চিত্র তুলে ধরে দলের নির্বাচনি প্রতীক নৌকায় ভোট দিতে জনগণের প্রতি আহ্বান পুনর্ব্যক্ত করেন তিনি। শেখ হাসিনা বলেন, একমাত্র নৌকা ক্ষমতায় থাকলেই দেশের মানুষের ভাগ্যের পরিবর্তন হয়। আর অবৈধভাবে সংবিধান লঙ্ঘন করে ক্ষমতা দখলকারীরা দেশকে কিছুই দিতে পারেনি।
আওয়ামী লীগ সভাপতি বলেন, নূহ নবী একদা নৌকায় করে মহাপ্লাবনের সময় মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামিনের ইশারায় মানব জাতিকে রক্ষা করেছিলেন। আপনারা এই নৌকা মার্কায় ভোট দিয়ে স্বাধীনতা পেয়েছেন। এই নৌকা মার্কা ক্ষমতায় আসলেই দেশের মানুষের উন্নতি হয়। অস্ত্র হাতে অবৈধভাবে সংবিধান লঙ্ঘন করে ক্ষমতা দখলকারীরা দেশের কোন উন্নতি করে না। তাদের সময় দেশের কোনও উন্নতি হয় নাই। উন্নতি হয়েছে একমাত্র আওয়ামী লীগ যখন ক্ষমতায় এসেছে।
তিনি বলেন, আজ বাংলাদেশের মানুষের আর্থসামাজিক উন্নতি হয়েছে। আমরা দারিদ্র্যের হার ৪১ ভাগ থেকে ১৮ দশমিক ৭ ভাগে নামিয়ে এনেছি। হতদরিদ্র যেখানে ২৫ ভাগ ছিল সেখানে আজ হতদরিদ্রের হার মাত্র ৫ দশমিক ৬ ভাগ। ইনশাআল্লাহ বাংলাদেশের মাটিতে কেউ হতদরিদ্র থাকবে না।
দরিদ্র ও ভূমিহীন সব শ্রেণি-পেশার মানুষ এবং অনগ্রসর জনগোষ্ঠীকে বিনামূল্যে ঘর করে জীবন-জীবিকার ব্যবস্থা করে দেওয়ার আওয়ামী লীগ সরকারের পদক্ষেপের কথা উল্লেখ করে তিনি বলেন, বাংলাদেশের মানুষ খেয়ে পরে সুখে শান্তিতে বসবাস করবে, সে ব্যবস্থা আমরা করে দেবো। আর একমাত্র নৌকা ক্ষমতায় থাকলে এটা সম্ভব।
তিনি বলেন, আমরা ডিজিটাল বাংলাদেশ করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলাম, ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়েছি। আর ২০৪১ সালের বাংলাদেশ হবে উন্নত, সমৃদ্ধ, প্রযুক্তিজ্ঞানসম্পন্ন, তারুণ্যে সমৃদ্ধ স্মার্ট বাংলাদেশ। এটা হবে সেই সোনার বাংলা যে বাংলাদেশ গড়ার স্বপ্ন জাতির পিতা একদিন দেখেছিলেন। আমাদের জনগণ প্রযুক্তি শিক্ষায় দক্ষ হয়ে স্মার্ট জনশক্তি হবে, এর অর্থনীতি স্মার্ট হবে এবং আমাদের সমাজ ব্যবস্থা স্মার্ট হয়ে গড়ে উঠবে।
শেখ হাসিনা বলেন, আজ তরুণ ও যুবকেরা এবং যে শিশুটা আজ জন্মগ্রহণ করলো সেও যেন একটি সুন্দর জীবন পায় তার জন্য আমরা প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি। পাশাপাশি, জলবায়ুর অভিঘাত থেকে বাংলাদেশ যেন মুক্ত থাকতে পারে এর জন্য শতবর্ষ মেয়াদি ‘ডেল্টা পরিকল্পনা-২১০০’ আমরা প্রণয়ন ও বাস্তবায়নের উদ্যোগ নিয়েছি। অর্থাৎ ২১০০ সালের বাংলাদেশের উন্নয়ন কীভাবে হবে সেই পরিকল্পনাও আমরা প্রণয়ন করেছি, যাতে বাংলাদেশ এগিয়ে যেতে পারে।
তারুণ্যের শক্তি বাংলাদেশের অগ্রগতি– উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী নৌকার প্রার্থীদের বিজয়ী করার জন্য সমাবেশস্থলে আসা ব্যক্তিদের ওয়াদা চান। জনতা তখন সমস্বরে দুই হাত তুলে প্রধানমন্ত্রীকে সমর্থন জানায়। প্রধানমন্ত্রী জনসভায় ফরিদপুর, রাজবাড়ী এবং মাগুরার নির্বাচনি আসনের প্রার্থীদের সঙ্গে জনগণকে পরিচয় করিয়ে দেন এবং এবং তাদের জন্য ভোট প্রত্যাশা করেন।
আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য ও ফরিদপুর-১ আসনে আওয়ামী লীগ মনোনীত প্রার্থী আবদুর রহমান, মাগুরা-১ আসনে আওয়ামী লীগ মনোনীত প্রার্থী ক্রিকেটার সাকিব আল হাসান এবং ফরিদপুর-৩ আসনে আওয়ামী লীগ মনোনীত প্রার্থী শামীম হক সভায় বক্তব্য রাখেন।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, আওয়ামী লীগ দুর্নীতি করতে আসেনি, নিজেদের ভাগ্য পরিবর্তন করতে আসেনি, এসেছে মানুষের ভাগ্য পরিবর্তন করতে। বিশ্বব্যাংক যখন পদ্মা সেতু নিয়ে দুর্নীতির অভিযোগ দিয়েছিল, তখন আমি চ্যালেঞ্জ দিয়েছিলাম। কিন্তু তারা দুর্নীতি প্রমাণ করতে পারেনি। আমি বঙ্গবন্ধুর মেয়ে, চ্যালেঞ্জ নিয়েছিলাম নিজেদের টাকায় পদ্মা সেতু করবো, করেছি। বাঙালি কারও কাছে মাথা নত করবে না।
তিনি বলেন, একমাত্র নৌকা মার্কায় ভোট দিলেই আমি ক্ষমতায় আসতে পারবো, উন্নয়নশীল দেশ হিসেবে বাংলাদেশকে গড়ে তুলতে পারবো। এ মাটি (ফরিদপুর) জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের মাটি, এই মাটি আওয়ামী লীগের ঘাঁটি, নৌকার ঘাঁটি।
শেখ হাসিনা বলেন, বর্তমান সরকারের আমলে শিক্ষার হার অনেক বৃদ্ধি পেয়েছে। এই শিক্ষার পেছনে বর্তমান সরকার অনেক টাকা খরচ করে যাচ্ছে। জাতির পিতা বলেছিলেন, শিক্ষার পেছনে যেটা খরচ হয় সেটা খরচ নয়, বিনিয়োগ। আমাদের লক্ষ্যই দেশের মানুষের উন্নয়ন করা, সেই লক্ষ্যে আমরা কাজ করে যাচ্ছি। বঙ্গবন্ধুর বাংলায় কোনও মানুষ ক্ষুধার্ত থাকবে না। দারিদ্র্য থাকবে না, গৃহহীন থাকবে না- সেই লক্ষ্য নিয়ে সরকার কাজ করে যাচ্ছে। প্রত্যেকটা মানুষের জীবন উন্নত করাই আমাদের লক্ষ্য।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, বয়স্ক ভাতা আওয়ামী লীগ প্রথম চালু করে। একুশ বছর পর সরকার গঠন করার পর দেশের মানুষের মধ্যে স্বস্তি ফিরিয়ে আনে আওয়ামী লীগ। আর ২০০১ সালে খালেদা জিয়া বিদেশিদের কাছে গ্যাস বিক্রির মুচলেকা দিয়ে ক্ষমতায় আসে। বিএনপি-জামায়াত ক্ষমতায় এসেই সন্ত্রাস, জঙ্গিবাদ, দুর্নীতি, মানুষ হত্যা, গুম ও খুনের রাজনীতি এবং আওয়ামী লীগের হাজার হাজার নেতাকর্মীকে অত্যাচার, নির্যাতন, গ্রেফতার করে জনজীবন বিপর্যস্ত করে তোলে। ফলে দেশে ইমার্জেন্সি আসে। ২০০৮ সালের নির্বাচনে আওয়ামী ২৩৩টি আসনে এককভাবে জয়লাভ করে, আর বিএনপি- যারা আজ বড় বড় কথা বলে, লম্ফঝম্ফ করে, তারা পেয়েছিল ৩০টি আসন। যে কারণে ২০১৪ সালে তারা নির্বাচন করেনি। ২০১৮ সালের নির্বাচনে অংশ নেওয়ার নামে তারা মনোনয়ন বাণিজ্য করে ভরাডুবির শিকার হয়। ২০০৯ থেকে ২০২৩ এই ১৫ বছর টানা জনগণের ভোটে নির্বাচিত হয়ে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আছে বলেই দেশটার উন্নয়ন হয়েছে।
তিনি বলেন, জাতির পিতা যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশ গড়ে তুলে যে দেশকে স্বল্পোন্নত দেশ করে গিয়েছিলেন, আমরা সে দেশকে আজ উন্নয়নশীল দেশের মর্যাদায় এনে দিয়েছি। ঘরে ঘরে বিদ্যুৎ, ব্রডব্যান্ড-ইন্টারনেট, বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট, কম্পিউটার ও প্রযুক্তি শিক্ষার মাধ্যমে ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়েছি। আমরা পরমাণু বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ করছি। পদ্মা সেতুসহ হাজার-হাজার কিলোমিটার রাস্তাঘাট, পুল, ব্রিজ অবকাঠামো ও প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলে মানুষের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করেছি। দেশের তৃণমূল, পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীসহ তরুণ প্রজন্মকে আত্মনির্ভরশীল করতে সরকার কাজ করছে।
এসময় তার সরকারের বেসরকারি খাতকে উন্মুক্ত করে দেওয়া, নানা সুযোগ-সুবিধা এবং অবাধ তথ্যপ্রবাহের সুযোগ নিয়ে গুটিকতক ব্যবসায়ী, মিডিয়া মালিকদের বিভিন্ন কারসাজি এবং টাকা ছাড়ানোর কঠোর সমালোচনা করেন। টাকা দিয়ে জনগণকে কেনা যায় না বলেও অভিমত ব্যক্ত করেন তিনি।
শেখ হাসিনা প্রশ্ন করেন, আমাদের আরও কাজ বাকি, এখন উন্নয়নশীল দেশ হিসেবে নিজেদের গড়ে তুলতে হবে, কে ক্ষমতায় থাকলে বাংলাদেশ উন্নয়নশীল দেশ হিসেবে গড়ে উঠবে?– তার এই প্রশ্নের উত্তরে জনগণ ‘নৌকা, নৌকা’ বলে উত্তর দেয়। তিনি বলেন, একমাত্র নৌকা মার্কা যদি ভোট পায়, শুধু নৌকা মার্কা ভোট পেলেই আমি সরকারে আসতে পারবো। আর উন্নয়নশীল দেশ হিসেবে বাংলাদেশকে গড়তে পারবো। নৌকা মার্কাই দিতে পারবে এর সমাধান।
উল্লেখ্য, গত ২০ ডিসেম্বর সিলেটে হজরত শাহজালাল (রহ.) ও হজরত শাহপরান (রহ.)-এর মাজার জিয়ারত এবং এরপর সিলেটের আলিয়া মাদ্রাসা মাঠে নির্বাচনি জনসভার মধ্য দিয়ে আনুষ্ঠানিকভাবে নির্বাচনি প্রচারণা শুরু করেন আওয়ামী লীগ প্রধান।
এরপর ৩০ ডিসেম্বর শেখ হাসিনা টুঙ্গিপাড়া ও কোটালীপাড়ায় জনসভায় ভাষণ দেন, যেটি তার নির্বাচনি এলাকাও। পরে ঢাকায় ফেরার পথে মাদারীপুরের কালকিনিতে আরেকটি জনসভায় ভাষণ দেন। আগের দিন তিনি বরিশালের বঙ্গবন্ধু উদ্যানে নির্বাচনি সভায় ভাষণ দেন।
২৬ ডিসেম্বর রংপুর সফর করেন এবং তারাগঞ্জ, মিঠাপুকুর ও পীরগঞ্জ উপজেলায় নির্বাচনি জনসভায় ভাষণ দেন। এছাড়া আওয়ামী লীগের তেজগাঁও কার্যালয় থেকে তিনি বেশ কয়েক দফায় বিভিন্ন জেলার নির্বাচনি সভায় ভার্চুয়ালি বক্তব্য দিয়েছেন।
সোমবার ইংরেজি নববর্ষের প্রথম দিনে (১ জানুয়ারি) তিনি রাজধানীর কলাবাগান ক্রীড়া চক্র মাঠে নির্বাচনি জনসভায় ভাষণ দেন। আওয়ামী লীগ সূত্র জানায়, আগামী ৪ জানুয়ারি নারায়ণগঞ্জে জনসভার মধ্য দিয়ে দলীয় প্রধানের নির্বাচনি প্রচারণা শেষ করার কথা রয়েছে। সূত্র: বাসস।
সূত্র : বাংলা ট্রিবিউন