জ্ঞান ও বিদ্যার দেবী সরস্বতী আরাধনার দিন আজ। সনাতন ধর্মাবলম্বীদের অন্যতম প্রধান ধর্মীয় উৎসব সরস্বতী পূজা। সরস্বতী বৈদিক দেবী হলেও সরস্বতী পূজা বর্তমান রূপটি আধুনিককালে প্রচলিত হয়েছে। তবে প্রাচীনকালে তান্ত্রিক সাধকেরা সরস্বতী-সদৃশ দেবী বাগেশ্বরীর পূজা করতেন বলে জানা যায়। পূজা উপলক্ষে রাষ্ট্রপতি মো. সাহাবুদ্দিন ও প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের শুভেচ্ছা জানিয়েছেন।
হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের শুভেচ্ছা জানিয়ে রাষ্ট্রপতি মো. সাহাবুদ্দিন তার বাণীতে অসাম্প্রদায়িক, কল্যাণকর ও উন্নত সমাজ গঠনে দেশের মানুষকে এগিয়ে আসার আহ্বান জানান। তিনি বলেন, আবহমান কাল থেকে এ দেশের মানুষ পারস্পরিক সম্প্রীতি ও সহাবস্থানের মধ্য দিয়ে নিজ নিজ ধর্মীয় আচার, অনুষ্ঠান পালন করে আসছে। এ ঐতিহ্যকে সুসংহত রাখতে দেশবাসীকে নিজ নিজ অবস্থান থেকে অবদান রাখতে হবে।
সামাজিক সাম্য ও শান্তি প্রতিষ্ঠার পাশাপাশি অর্জিত জ্ঞানকে মানুষের কল্যাণ ও সেবায় কাজে লাগানোর ওপর জোর দিয়ে রাষ্ট্রপতি জ্ঞানভিত্তিক, সৌহার্দপূর্ণ ও বৈষম্যমুক্ত এক নতুন বাংলাদেশ বিনির্মাণের প্রত্যাশা ব্যক্ত করেন।
পৃথক বাণীতে হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের শুভেচ্ছা জানিয়ে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস বলেন, বাংলাদেশ সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির দেশ। হাজার বছর ধরে এদেশে জাতি-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সকল ধর্মের মানুষ মিলেমিশে একত্রে বসবাস করে আসছেন। ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে এদেশ সকল মানুষের নিরাপদ আবাসভূমি।
তিনি বলেন, ৫ অগাস্ট ছাত্র-শ্রমিক-জনতার অভূতপূর্ব অভ্যুত্থানের মাধ্যমে গঠিত অন্তর্বর্তীকালীন সরকার জাতি-ধর্ম-বর্ণ-গোষ্ঠী নির্বিশেষে সকলের ভাগ্য উন্নয়ন এবং সমান অধিকার সুনিশ্চিত করতে কাজ করে যাচ্ছে।
প্রধান উপদেষ্টা হিন্দু সম্প্রদায়ের সকলকে জ্ঞানার্জনে ব্রতী হয়ে দেশের উন্নয়ন ও অগ্রযাত্রায় আত্মনিয়োগের আহ্বান জানান।
তিনি বলেন, দেবী সরস্বতী সত্য, ন্যায় ও জ্ঞানালোকের প্রতীক। বিদ্যা, বাণী ও সুরের অধিষ্ঠাত্রী। আমি বাংলাদেশের সকল নাগরিকের শান্তি, কল্যাণ ও সমৃদ্ধি কামনা করি।
শাস্ত্রীয় বিধান অনুসারে, মাঘ মাসের শুক্লাপঞ্চমী তিথিতে সরস্বতী পূজা অনুষ্ঠিত হয়। এ তিথি বসন্ত পঞ্চমী নামেও পরিচিত। শ্বেত-শুভ্র বসনা স্বরসতী দেবীর এক হাতে বেদ, অন্য হাতে বীণা। এজন্য তাকে বীণাপানিও বলা হয়। সনাতন ধর্মীয় বিশ্বাস অনুযায়ী, জ্ঞান ও বিদ্যার অধিষ্ঠাত্রী দেবী তার আশীর্বাদের মাধ্যমে মানুষের চেতনাকে উদ্দীপ্ত করতে প্রতি বছর আবির্ভূত হন ভক্তদের মাঝে। সরস্বতী খুশি হলে বিদ্যা ও বুদ্ধি অর্জিত হবে। ঐশ্বর্যদায়িনী, বুদ্ধিদায়িনী, জ্ঞানদায়িনী, সিদ্ধিদায়িনী, মোক্ষদায়িনী এবং শক্তির আঁধার হিসেবে সরস্বতী দেবীর আরাধনা করা হয়। তিনি বাগদেবী, বাগদেবী অর্থে তিনি নব হৃদ পবিত্র করেন। তিনি সুন্দর ও মর্ত্যবাক্যের প্রেরণকাত্রী। তিনি মহাসমুদ্রের মতো পরমাত্মার প্রকাশ করেন। তিনি সমুদয় মানব-মানবীর হৃদয়ে জ্যোতি সঞ্চারিত করেন। পরমাত্মার মুখ থেকে তার আবির্ভাব।
এদিন সকালে বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, ছাত্রছাত্রীদের বাসা ও পূজামন্ডপে সরস্বতী পূজা হবে। পূজা শেষে ভক্তরা অঞ্জলি গ্রহণ করবেন। এদিন শিশুদের হাতেখড়িরও আয়োজন করা হয়। ঢাকেশ্বরী জাতীয় মন্দির মেলাঙ্গনে মহানগর সার্বজনীন পূজা কমিটি সনাতন ধর্মাবলম্বীদের অন্যতম ধর্মীয় উৎসব বিদ্যার দেবী শ্রী শ্রী সরস্বতী পূজার আয়োজন করেছে। সকাল ৮টায় পূজা অনুষ্ঠিত হবে।
প্রতিবারের মতো এবারও সবচেয়ে বড় পূজার আয়োজন হবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জগন্নাথ হল খেলার মাঠে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জগন্নাথ হল অভ্যন্তরে হল প্রশাসনের পূজাসহ ৭৪টি বিভাগ বা ইনস্টিটিউটের ব্যবস্থাপনায় সরস্বতী পূজা অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে। রবিবার পূজার প্রতিমা স্থাপন করা হবে। সোমবার (৩ ফেব্রুয়ারি) সরস্বতী পূজা আনুষ্ঠানিকভাবে শুরু হবে।
জগন্নাথ হলের প্রাধ্যক্ষ ও পূজা উদ্যাপন কমিটির সভাপতি অধ্যাপক দেবাশীষ পাল জানান, হল প্রশাসনের পূজা হলের উপাসনালয়ে এবং বিভাগ/ ইনস্টিটিউটগুলোর পূজা হলের মাঠে স্থাপিত নিজস্ব মণ্ডপে অনুষ্ঠিত হচ্ছে। মণ্ডপের স্থান নির্ধারণ করা হয়েছে প্রত্যেক বিভাগ/ইনস্টিটিউটের পূজা কমিটির উপস্থিতিতে লটারির মাধ্যমে। পূজার সার্বিক কার্যক্রম তত্ত্বাবধানে হল প্রশাসনের মোট ১১টি উপ-কমিটি কাজ করছে।
অধ্যাপক দেবাশীষ পাল বলেন, গত জুলাই বিপ্লবের মধ্যদিয়ে আমরা বৈষম্যহীন ও সমৃদ্ধশালী বাংলাদেশ গড়ার এক মহান প্রত্যয় গ্রহণ করেছি। এবারের সরস্বতী পূজা তাই এক ভিন্ন আঙ্গিকে আয়োজিত হতে চলেছে। ঐতিহ্যবাহী জগন্নাথ হলের উপাসনালয়ে দুদিনব্যাপী এ আয়োজনের মধ্যে পুষ্পাঞ্জলি প্রদান, প্রসাদ বিতরণ, মনোজ্ঞ সাংস্কৃতিক সন্ধ্যা, রক্তদান কর্মসূচি, ইত্যাদি রয়েছে। এছাড়াও হলের অভ্যন্তরে দর্শনার্থী শিশু-কিশোরদের চিত্তবিনোদন উপযোগী বেশ কিছু রাইড, খেলনা ও বিশুদ্ধ খাবার দোকানের ব্যবস্থাও রাখা হচ্ছে। আগত পুণ্যার্থীদের সার্বক্ষণিক সহযোগিতার জন্য বেশ কয়েকজন স্বেচ্ছাসেবী নিয়োজিত থাকবে।
জগন্নাথ হল ও পূজা মণ্ডপ এলাকার নিরাপত্তার বিষয়ে তিনি জানান, সমগ্র জগন্নাথ হল সিসি ক্যামেরার আওতাধীন থাকবে; প্রবেশমুখে মেটাল ডিটেক্টরসহ অন্যান্য প্রযুক্তির ব্যবহার থাকবে; ছোট শিশুদের দুগ্ধপানের জন্য বিশেষ নিরাপদ একটি কর্নার স্থাপন করা হয়েছে; কোনও ধরনের পটকা বা আতশবাজির ব্যবহার নিষিদ্ধ করা হয়েছে। এছাড়াও যানবাহন নিয়ন্ত্রণের জন্য হল প্রশাসনের পক্ষ থেকে বিশেষ স্টিকার সরবরাহ করা হয়েছে।
জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ে (জবি) প্রতিবছরের মতো বড় পরিসরে আয়োজিত হতে যাচ্ছে সরস্বতী পূজা। গত বছরের হিসেবে এবারে তিনটি মণ্ডপ বেড়েছে। এ বছর মোট ৩৯টি মণ্ডপে পূজার আয়োজন করা হবে। সেই সঙ্গে সকাল ৮টা থেকে রাত ৮টার মধ্যে পূজার আয়োজন শেষ করতে নির্দেশনা দিয়েছে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ।
রবিবার (২ ফেব্রুয়ারি) বিশ্ববিদ্যালয়টির কেন্দ্রীয় পূজা উদযাপন পরিষদের সভাপতি অধ্যাপক ড. রবীন্দ্রনাথ মণ্ডল সর্বশেষ প্রস্তুতির বিষয়ে এ তথ্য জানিয়েছেন।
রবীন্দ্রনাথ মণ্ডল বলেন, এ বছর আমাদের মণ্ডপ সংখ্যা বেড়েছে। ৩৭টি বিভাগ, একটি ইনস্টিটিউট ও একমাত্র ছাত্রী হলসহ মোট ৩৯টি মণ্ডপে পূজার আয়োজন হবে। ছাত্রী হলের মণ্ডপটি হলের ভেতরেই করা হবে। ইতিমধ্যে সব ধরনের প্রস্তুতি গ্রহণ করা হয়েছে। আজ রাতের মধ্যেই সব মণ্ডপ প্রস্তুতির কাজ শেষ করবে সংশ্লিষ্টরা।
বাংলা ট্রিবিউন