প্রজ্ঞানন্দ ভিক্ষু:
ফেসবুক সম্পর্কে আমার ইতিবাচক ধারণা ছিল না। তাই লেখালেখির তাগিদে ইমেইল ব্যবহার করলেও ফেসবুক নিয়ে আমার কোনো আগ্রহও ছিল না। সত্যি বলতে কি ফেসবুক সম্পর্কে লোকমুখে যা শুনেছিলাম তাতে ধরে নিয়েছিলাম যে, একজন ভিক্ষু হিসেবে ফেসবুকে আমার কোনো কাজ নেই। ২০১২ সালের রামু সহিংসতায় ফেসবুক প্রসঙ্গ আমার সামনে এল আমাদের নিঃস্ব হওয়ার কারণ হয়ে।
ঘটনা-পরবর্তী সময়ে জানতে পারলাম, রামুর উত্তম কুমার বড়ুয়া নামে এক যুবক তার ফেসবুক অ্যাকাউন্টে পবিত্র কোরআন অবমাননা করে ছবি প্রকাশ করেছে। কেউ বলছে লাইক দিয়েছে, কেউ বলেছে তাকে ট্যাগ করে দেওয়া হয়েছে। এসবের কিছুই তখন আমি বুঝতাম না। ফেসবুক সম্পর্কে জানা শুরু করলাম। আমি এটুকু নিশ্চিত হলাম যে, ফেসবুকের ইতিবাচক দিক অনেক। কিন্তু বিভিন্ন কারণে আমরা সেই ইতিবাচক দিকগুলো গ্রহণ না করে ঝুঁকছি নেতিবাচকের দিকে।
২০১৪ সালে আমি আমার নামে ফেসবুক অ্যাকাউন্ট খুললাম। ট্যাগ কী এখন আমি হাড়েহাড়ে বুঝতে পারছি! ডিজিটাল জালিয়াতি ফটোশপ করে কিভাবে মিথ্যাকে সত্য রূপ দেওয়ার চেষ্টা হয় সেটাও দেখতে পাচ্ছি। এখন ভাবতে বাধ্য হচ্ছি যে, সেদিন উত্তমের মতো যে কেউ নিশানা হতে পারত। ফেসবুককে কেন্দ্র করে সংগঠিত এসব অপরাধ মোকাবেলা করতে হলে ফেসবুক সম্পর্কে ব্যাপক প্রচারণা চালানোর বিকল্প নেই। কেবল তথ্যপ্রযুক্তি আইন দিয়ে এ সমস্যার স্থায়ী সমাধান হবে না।
গত ৩০ অক্টোবর ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নাসিরনগরে হিন্দু মন্দির ও পল্লীতে হামলা, লুটপাট, ভাংচুরের ঘটনার কারণ এবং রামুর বৌদ্ধ বিহার ও পল্লীতে হামলার কারণ এক ও অভিন্ন। শুধু স্থান, হামলাকারী ও হামলার শিকার মানুষগুলো ভিন্ন। ২৮ অক্টোবর রসরাজ দাস নামে এক হিন্দু যুবকের ফেসবুকে পবিত্র কাবা শরীফ অবমাননার অভিযোগ তোলা হয়। এই অভিযোগে ৩০ অক্টোবর দিবালোকে সহিংসতা চালানো হয়েছে। খবরে প্রকাশ, এই যুবক সবাইকে বোঝানোর চেষ্টা করেছে যে, এ কাজ সে করেনি এবং এমন কাজ করার সাহসও তার নেই। এরপরও অভিযোগ ওঠায় ২৯ অক্টোবর পুলিশ যুবকটিকে গ্রেপ্তার করে আদালতের মাধ্যমে কারাগারে পাঠায়। এর দুদিন পর তাণ্ডব চালানো হয়েছে।
যদি সে ধর্ম অবমাননাকর অপরাধ করেও থাকে তাহলে তার এই বিকৃত এবং ঘৃণ্য অপরাধের জন্য রাষ্ট্রীয় আইনে তার বিচার এবং সাজা হবে। পুলিশ তো তাকে গ্রেপ্তার করেছে। কেউ যদি অপরাধ করে থাকে তাহলে এর মাশুল তার পুরো সম্প্রদায় এবং ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানগুলোকে দিতে হবে কেন? এমন অবিচার ইসলাম এবং রাষ্ট্রীয় আইনি ব্যবস্থার কোনোটার সঙ্গে যায় না।
বিক্ষোভ সভা-সমাবেশ করে রীতিমতো সাধারণ মানুষকে খেপিয়ে সহিংসতার ক্ষেত্র তৈরি করে সহিংসতা চালানো হয়। ৩০ অক্টোবরের বিক্ষোভ সমাবেশে স্থানীয় উপজেলা চেয়ারম্যান, উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা এবং ওসি উপস্থিত ছিলেন। তাঁরা এখন যে অজুহাতই দেখান না কেন আসলে তাঁদের পেশাগত এবং রাষ্ট্রীয় কর্তব্য কি এটা ছিল?
সংবিধানে বলা আছে, আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির বিঘ্ন ঘটাতে পারে এখন বেআইনি সভা-সমাবেশ করতে দেওয়া যাবে না। প্রয়োজনে এমন সভা-সমাবেশ ছত্রভঙ্গ করে দিতে হবে। সংবিধানে সমাবেশের স্বাধীনতা বলতে বলা হয়েছে–
“জনশৃঙ্খলা বা জনস্বাস্থ্যের স্বার্থে আইনের দ্বারা আরোপিত যুক্তিসঙ্গত বাধা-নিষেধ সাপেক্ষে শান্তিপূর্ণভাবে ও নিরস্ত্র অবস্থায় সমবেত হইবার এবং জনসভা ও শোভাযাত্রায় যোগদান করিবার অধিকার প্রত্যেক নাগরিকের থাকিবে।”
একটা উপজেলার ভালো-মন্দ দেখার দায়দায়িত্ব যাদের উপর ন্যস্ত এবং যারা রাষ্ট্র ও জনগনের কাছে দায়বদ্ধ এবং সরকারের ক্ষমতাপ্রাপ্ত তারাই তাদের কর্তব্য পালন করলেন না! আমাদের রামু সহিংসতার সময়ও তৎকালীন ইউএনও ছিলেন বিদায়ী জেলা প্রশাসকের বিদায়োত্তর সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে। সাংসদ, উপজেলা চেয়ারম্যান এবং ওসি সাহেব ছিলেন বিক্ষোভ সমাবেশে। অন্যান্য বাহিনীর প্রতিনিধিরা উপরের নির্দেশ না পাওয়ায় আপদকালীন সময়ে ঘটনাস্থলে আসতে পারেননি বলে শুনেছিলাম।
এলাকায় ২৮ অক্টোবর থেকে টান টান উত্তেজনা বিরাজ করার খবর ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় এসপি, জেলা প্রশাসক কি জানতেন না? জানবেন না-ই বা কেন? তাঁরা কি আগাম কোনো ব্যবস্থা নিয়েছেন? তাঁরা কি রামুকাণ্ড সম্পর্কে জানেন না? অনেক প্রশ্ন থেকে যায়। এরপরও যদি বলা হয় প্রশাসনিক গাফিলতি আছে কি না দেখতে হবে, তাহলে তো আর বলার কিছু থাকে না।
দুঃখজনক হল, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীও বললেন, প্রশাসনিক কোনো গাফিলতি তিনি দেখছেন না। নাসিরনগর থানার ওসিকে প্রত্যাহার করা হয়েছে নাকি গাফিলতি থাকতে পারে এই ভাবনা থেকে। গণপিটুনিতে কেউ মারা পরলে সেই ঘটনার আসামি খুঁজে পাওয়া প্রায় মুশকিল হয়ে পড়ে। কখনও আসামি পেলে সাক্ষী মেলে না। তাই গণপিটুনি দিতে পারার ‘মজা’ই আলাদা। জনসমাবেশ থেকেই হামলা হয়েছে, কিন্তুু এখন জনসমাবেশের আয়োজনকারীরা আমরা হামলা করিনি বলেই খালাস। এখন আসামি মিলবে কোথায়?
দুই মামলার প্রতিটিতে এক হাজারেরও বেশি মানুষকে আসামি করা হয়েছে। তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। পরে হয়তো বিচার বিভাগীয় তদন্তের দাবি উঠবে। যাদের আসামি করা হয়েছে, তারা সবাই নিরীহ এবং নির্দোষ বলে কথা আসবে, ইউএনও প্রত্যাহার হবে, রাজনৈতিক দোষারোপ শুরু হবে। এসব বিষয়ে আমাদের পূর্ব অভিজ্ঞতা হয়েছে। হামলায় ক্ষতিগ্রস্ত মন্দির এবং ঘরবাড়ি হয়তো পুনর্নির্মাণ হতে পারে সরকার চাইলে। ক্ষতিগ্রস্তরা রাষ্ট্রের নাগরিক হিসেবে রাষ্ট্র থেকে এটুকু সুযোগ বা ক্ষতিপূরণ পাওয়ার যৌক্তিকতা আছে।
সব থেকে বড় কথা হল, এমন সাম্প্রদায়িক হামলায় হানাহানি এবং রক্তপাত হওয়ার আশঙ্কা থাকে বেশি। যারা হামলায় যায় তারা একধরনের তৈরি হয়ে যায়। হামলাকারীদের পথে বাধা হয়ে দাঁড়ালে পরিণতি কী হতে পারে, তা না বোঝার কথা নয়। অনেকে বলবেন, আক্রান্তরা প্রতিরোধ করলেন না কেন? প্রতিরোধ যাদের করার কথা তারা নিষ্ক্রিয় থাকবেন, হামলাকারীদের মৌন সম্মতি দেবেন, তাদের মধ্যে মিলেমিশে একাকার হয়ে যাবেন আর এদিকে আক্রান্তদের প্রতিরোধ করতে বলা– এটা কোনো কাজের কথা নয়। এমন কিছু ঘটলে যারা পরিকল্পিতভাবে সাম্প্রদায়িকতাকে উসকে দিয়ে দাঙ্গা এবং হানাহানির মতো ভয়ঙ্কর পরিস্থিতি সৃষ্টি করতে চায় তাদের উদ্দেশ্য ষোলো আনাই সফল হয়ে যাবে।
ক্ষতি যা হওয়ার তা হয়ে গেছে। নতুন করে আর যাতে কোথাও এই সহিংসতার বিষ না ছড়ায় সেদিকে পূর্ণ সতর্ক থাকা প্রয়োজন। আক্রান্তদের মধ্যে বিদ্যমান ভয়ভীতি, পারস্পরিক আস্থাহীনতা, আতঙ্ক, নিরাপত্তাহীনতা দূর করার জন্য প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করা জরুরি। একই সঙ্গে আক্রান্তদের উচিত হবে নির্দোষ কোনো মানুষকে মামলায় না জড়ানো, হয়রানি না করা এবং রাজনৈতিকভাবে প্রভাবিত না হওয়া।
এই পরিস্থিতিতে ক্ষতিগ্রস্তদের পক্ষ থেকে সৎ, নির্ভীক এবং ব্যক্তিত্বসম্পন্ন নেতৃত্ব খুবই গুরুত্বপূর্ণ। সুবিধাবাদী কেউ যাতে আক্রান্তদের নেতৃত্বে না আসতে পারে সেদিকেও নজর রাখতে হবে। কেউ যাতে গণমাধ্যমে মনগড়া কথাবার্তা না বলে।
ঘটনার জন্য দায়ী কিছু পথভ্রষ্ট মানুষের জন্য জাত এবং ধর্ম তুলে ঢালাওভাবে দোষারোপ করা মোটেও সমীচীন হবে না। দেশের মানুষ আপনাদের পাশে আছে। স্থানীয় প্রশাসনের চরম উদাসীনতা ছিল– এ কথা অস্বীকার করার কোনো জো নেই। কিন্তু এ জন্য সমগ্র প্রশাসনিকব্যবস্থাকে অবিশ্বাস আর দোষারোপ করারও কারণ নেই। তবে আমি মনেপ্রাণে বিশ্বাস করি, কোনো জেলার ডিসি, এসপি, ইউএনও, ওসি, উপজেলা পরিষদ, জনপ্রতিনিধি, গোয়েন্দা সংস্থা এবং সংশ্লিষ্ট অন্যান্য বাহিনীগুলো চাইলে এমন ঘটনা ঘটতে পারে না; ঘটনাটি হোক না পরিকল্পিত কিংবা আচমকা।