‘আমিই প্রথম…!’ একটু চমকে তাকালেন মাশরাফি বিন মুর্তজা। মিরপুরে বিসিবি একাডেমির জিমনেসিয়ামে কসরত করছিলেন। চোখে বিস্ময় আর মুখে হাসি নিয়ে তাকালেন বাংলাদেশের ওয়ানডে অধিনায়ক, “আমি ভেবেছিলাম আরও দু-একজন হয়ত খেলেছিলেন…।”খবর বিডিনিউজের।
মাশরাফি নিজে এতটা ভাবতে না পারলেও তিনিই প্রথম। বাংলাদেশের প্রথম ক্রিকেটার হিসেবে সক্রিয়ভাবে মাঠে থেকেই পূর্ণ করতে যাচ্ছেন আন্তর্জাতিক ক্যারিয়ারের ১৫ বছর!
বাংলাদেশের ক্রিকেটে গতির ঝড় তুলে আবির্ভাব মাশরাফির। বয়সভিত্তিক দল থেকে ‘এ’ দল হয়ে দ্রুত ডাক পেয়ে যান জাতীয় দলে। ২০০১ সালে ৮ নভেম্বর বঙ্গবন্ধু জাতীয় স্টেডিয়ামে জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে মাথায় তোলেন টেস্ট ক্যাপ।
তখন সবে ১৮ পেরিয়েছেন। ক্যারিয়ার শুরুর পরপর শুরু হয়েছে চোটের সঙ্গে লড়াইও। দুই হাঁটুতে সাতটি অস্ত্রোপচার, ছোট বড় আরও অসংখ্য চোটের ধকল সয়ে, অনেক চড়াই-উৎরাই পেরিয়ে মাশরাফি টিকে আছেন এখনও। শুধু টিকে থাকার জন্য টিকে থাকা নয়। বাংলাদেশের ওয়ানডে ও টি-টোয়েন্টি অধিনায়ক তিনি, গত দুই বছরে ওয়ানডেতে বাংলাদেশের অবিস্মরণীয় সাফল্যযাত্রার অন্যতম নায়ক এবং এখনও দলের সেরা পারফরমারদের একজন। মঙ্গলবার পূর্ণ করবেন ক্যারিয়ারের ১৫ বছর।
মাশরাফির আগে অভিষিক্ত মোহাম্মদ শরীফ অবশ্য খেলে যাচ্ছেন এখনও। আনুষ্ঠানিকভাবে আন্তর্জাতিক ক্রিকেট ছাড়েননি। তবে ৯ বছর আগে সবশেষ খেলা শরীফের আন্তর্জাতিক ক্যারিয়ারের ইতি ধরে নেওয়াই যায়। সেদিক থেকে মাশরাফিই প্রথম।
এর আগে আকরাম খানের ক্যারিয়ার ছিল ১৪ বছর ১৮৭ দিনের। আরেক সাবেক অধিনায়ক আমিনুল ইসলামের আন্তর্জাতিক ক্যারিয়ারের বয়স ছিল ১৪ বছর ৪৪ দিন। মিনহাজুল আবেদীনের ১৩ বছর ৬১ দিন।
নিজের এত বড় অর্জন নিয়েও যথারীতি মজা করতে ছাড়লেন না মাশরাফি। চোট-জর্জর ক্যারিয়ারের দিকে ইঙ্গিত করে হাসতে হাসতে বললেন, “১৫ বছর অনেক সময়। খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে ১৫ বছর পার করেই ফেললাম!”
খানিক পরই অবশ্য সিরিয়াস। পেছন ফিরে তাকালেন ক্যারিয়ারে। কৃতজ্ঞতা জানালেন বর্তমান-সাবেক সব সতীর্থের প্রতি।
“সত্যি বলতে, খুব ভালো লাগছে। বেশ কয়েক প্রজন্মের সঙ্গে খেলেছি। রকিবুল ভাই বা লিপু ভাইদের তো পাইনি। যাদের সঙ্গে শুরু করেছিলাম, আকরাম ভাই, সুজন ভাই, আজকে তারা বোর্ডের ভালো ভালো জায়গায় আছে। বুলবুল ভাই, পাইলট ভাই, রফিক ভাই, মনি ভাই, মঞ্জু ভাই, শান্ত ভাই… সবার কথাই মনে পড়ছে।”
“পরের প্রজন্ম ধরলে আমাদের ব্যাচ, আশরাফুল, শরীফ, তাপশ বৈশ্য, তালহা জুবায়ের, পরে নাফিস ইকবাল, রাজিন ভাইরা এলেন। আরও পরে মুশফিক-সাকিব-তামিমরা এল। এখন মুস্তাফিজ, মিরাজ…প্রতিটি প্রজন্মের সঙ্গে খেলাই উপভোগ করেছি। যত দিন খেলব, চেষ্টা করব উপভোগ করতে।”
ক্যারিয়ারের শুরুর দিনগুলোতে যেমন ছিল, এখনও উপভোগের মন্ত্রটাই মাশরাফির চালিকাশক্তি।
“ক্রিকেট খেলে যদি উপভোগ না করতাম, আনন্দ না পেতাম, তাহলে খেলতে পারতাম না্। বিশেষ করে আমার যত সমস্যা ছিল। সবাই আমাকে খুব সাহায্যও করেছে। যারা আমার সিনিয়র ছিলেন, অবসরের পরও তারা আমাকে অনেক সহায়তা করেছেন। বিশেষ করে মানসিকভাবে। সবার প্রতিই আমি কৃতজ্ঞ।”
“আমাকে নিয়ে যে ভাবনা তাদের ছিল, যে চিন্তা তারা করেছেন, সেটা তো শোধ করতে পারব না। তবে সব সময়ই তাদের প্রতি আমার সম্মান আছে। সিনিয়র-জুনিয়র সবাইকেই সম্মান করি।”
ক্যারিয়ার জুড়েই চোটের সঙ্গে এতটা লড়াই করতে না হলে, মাঠে থাকার চেয়ে মাঠে ফেরার লড়াই বেশি করতে না হলে আরও কতটা উজ্জ্বল হতো মাশরাফির ক্যারিয়ার, এই নিয়ে আক্ষেপ আছে অনেকেরই। তবে মাশরাফিকে সে সব ততটা পোড়ায় না; বরং দেশকে এত লম্বা সময় প্রতিনিধিত্ব করতে পারার প্রাপ্তিটাই তাকে দেয় তৃপ্তি।
“ইনজুরি না থাকলে হয়ত আরও ভালো কিছু হতে পারত। পরিসংখ্যান আরও সমৃদ্ধ হতে পারত। তবে সেই আক্ষেপের চেয়েও ভালো লাগাটা বেশি যখন ভাবি, যে এত সমস্যার ভেতরও আমি খেলতে পেরেছি। সবার দোয়া ছিল।”
“এই মুহূর্তে খুব ভালো লাগছে। আমি কি করতে পেরেছি, সেই কারণে নয়। বাংলাদেশ দলের একজন সদস্য হিসেবে ১৫ বছর পার করলাম, এটাই আমার কাছে অনেক বড়।”
যে মাইলফলকের সীমানা তিনি স্পর্শ করলেন, মাশরাফির বিশ্বাস, ভবিষ্যতে বাংলাদেশের আরও অনেকই তাকে ছাড়িয়ে ছুঁয়ে ফেলবে আরও নতুন নতুন সীমানা।
“এখন যারা খেলছে, তাদের জন্য দোয়া করি। ১৫ বছর নয়, ১৮-১৯ বছরের ক্যারিয়ার হতে পারে অনেকের। সাকিব-তামিম-মুশফিকদের এখনই ১০ বছর হয়েছে। আরও ৭-৮ বছর খেলতে পারবে অনায়াসে, ১৮-১৯ বছর হয়েই যাবে। সবার জন্যই শুভকামনা।”
১৫ বছর পূর্ণ করার দিনটিতেও মাঠেই থাকবেন মাশরাফি। তবে আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে নয়, সব ঠিকঠাক থাকলে বিপিএলের নতুন শুরুর দিনে মঙ্গলবার বল হাতে ছুটবেন কুমিল্লা ভিক্টোরিয়ান্সের জার্সি গায়ে।