প্রথম আলো:
মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে রোহিঙ্গা মুসলিমদের বিরুদ্ধে সেনাবাহিনীর দমন অভিযান অব্যাহত রয়েছে। সরকারি তথ্যমতে, সপ্তাহান্তে সেনাবাহিনী অন্তত ২৮ জনকে হত্যা করেছে। তাদের বেশির ভাগই নিহত হয়েছে সেনাবাহিনীর হেলিকপ্টার গানশিপ থেকে ছোড়া গোলার আঘাতে।
রোহিঙ্গা-অধ্যুষিত রাখাইনে গণমাধ্যম ও আন্তর্জাতিক ত্রাণকর্মীদের প্রবেশ নিষিদ্ধ থাকায় গত অক্টোবরে শুদ্ধি অভিযান শুরুর পর থেকে নিহত রোহিঙ্গাদের প্রকৃত সংখ্যা যাচাই করা যায়নি। তবে অভিযান শুরুর পর রাজ্যে সেনাসদস্যদের সঙ্গে রোহিঙ্গাদের সংঘর্ষ তীব্রতর হয়েছে।
মানবাধিকার সংগঠনগুলো মনে করছে, নিহত ব্যক্তির সংখ্যা সরকারের ঘোষণা করা সংখ্যার চেয়ে অনেক বেশি হয়ে থাকতে পারে।
মিয়ানমারের সরকারি সংবাদপত্র গ্লোবাল নিউ লাইট অব মিয়ানমার বলেছে, রোববার চাপাতি ও লাঠি নিয়ে একদল দুর্বৃত্তের হামলার শিকার হওয়ার পর সেনাসদস্যরা অন্তত ১৯ জনকে হত্যা করেন। আগের দিন আরও ছয়জনকে হত্যা করেন সেনারা। অভিযানে সামরিক হেলিকপ্টার ডাকা হয়। পত্রিকাটি আরও বলেছে, দুদিনের এ অভিযানের পর সন্দেহভাজন আরও তিন হামলাকারীর মরদেহ উদ্ধার করা হয়েছে।
শনি ও রোববারের অভিযান এবং সেনাদের সঙ্গে রোহিঙ্গাদের সংঘর্ষে অন্তত ২৮ জন ‘হামলাকারী’ ও দুই সেনা নিহত হয়েছেন বলে গতকাল রাষ্ট্রীয় গণমাধ্যমগুলো জানালেও নিহত ব্যক্তিদের সংখ্যা স্পষ্ট নয় বলে জানায় আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যম।
মিয়ানমারের রাষ্ট্রীয় গণমাধ্যমের খবরের ভিত্তিতে রয়টার্সের পরিসংখ্যানে বলা হয়, গত মাস থেকে শুরু হওয়া সহিংসতায় এ পর্যন্ত ৬০ জনের বেশি রোহিঙ্গা ও নিরাপত্তা বাহিনীর ১৭ জন সদস্য নিহত হয়েছেন। রাখাইন রাজ্যে ২০১২ সালে সাম্প্রদায়িক সহিংসতায় শত শত লোক নিহত হওয়ার পর চলমান সহিংসতাই সবচেয়ে রক্তক্ষয়ী।
পর্যবেক্ষক ও কূটনীতিকেরা বলছেন, বিক্ষুব্ধ রাজ্যটিতে শনি ও রোববার রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে চালানো হত্যাযজ্ঞে চলমান সংঘর্ষ দ্রুত বন্ধ ও সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি পুনঃপ্রতিষ্ঠার যেকোনো আশা গুরুতরভাবে নস্যাৎ হলো। অভিযানের কেন্দ্রে রয়েছে রাখাইনের উত্তরাঞ্চলীয় মংডু এলাকা। এটি বাংলাদেশ সীমান্ত লাগোয়া। গত ৯ অক্টোবর এ এলাকার তিনটি সীমান্ত ফাঁড়িতে সমন্বিত হামলার ঘটনা ঘটে। হামলায় নয় পুলিশ সদস্য নিহত হন। রোহিঙ্গা বিদ্রোহী গোষ্ঠীর বিরুদ্ধে হামলার অভিযোগ তুলে এরপর থেকে ওই দমন অভিযানে নামে সেনাবাহিনী।
কার্যত পুরো মংডু অবরুদ্ধ করে গ্রামের পর গ্রাম অভিযান চালাচ্ছেন সেনারা। আটকে পড়াদের কাছে ত্রাণকর্মীদের পৌঁছাতে বা সেখানে নিরপেক্ষ পর্যবেক্ষকদের ঢুকতে দিচ্ছে না সেনাবাহিনী।
নিউইয়র্ক-ভিত্তিক মানবাধিকার সংগঠন হিউম্যান রাইটস ওয়াচ (এইচআরডব্লিউ) শনিবার বলেছে, ভূ-উপগ্রহ থেকে তোলা ছবিতে রোহিঙ্গা গ্রামগুলোতে চালানো ধ্বংসলীলার ছবি ফুটে উঠেছে। এমন কিছু ছবিতে প্রায় ৪৩০টি বাড়ি ভস্মীভূত অবস্থায় দেখা গেছে। সংগঠনটি আরও বলেছে, ধ্বংসযজ্ঞের মাত্রা প্রাথমিকভাবে করা অনুমানের চেয়ে বেশি।
মিয়ানমারের অনেক বাসিন্দা ও মানবাধিকারকর্মীদের অভিযোগ, সাম্প্রতিক সহিংসতা চলাকালে সেনাবাহিনী রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে বিচারবহির্ভূত হত্যা ও ধর্ষণ চালাচ্ছে এবং তাঁদের বাড়িঘর পুড়িয়ে দিচ্ছে।
অবশ্য সরকার ও সেনাবাহিনী অভিযোগ নাকচ করে বলেছে, তারা ‘আইনের শাসন’ মেনেই এ শুদ্ধি অভিযান চালাচ্ছে। আর বাড়িঘরে আগুন দেওয়ার পেছনে ‘সহিংস হামলাকারীরা’ দায়ী।
এদিকে সেনাদের নির্যাতনের ভিডিও অনলাইনে ছেড়ে রোহিঙ্গা মানবাধিকার সংগঠনগুলো দাবি করছে, হামলাকারীদের ধরার নামে নিরীহ বেসামরিক লোকজনকে আক্রমণের নিশানা বানাচ্ছে সেনাবাহিনী। ঘটনা তদন্তে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের প্রতিও আহ্বান জানিয়েছে তারা।
রাখাইনে প্রায় ১১ লাখ রোহিঙ্গা মুসলমানের বাস। বিপুলসংখ্যক এই অধিবাসীকে মিয়ানমার তাদের নাগরিক হিসেবে স্বীকৃতি দেয় না। আর দেশটির সংখ্যাগরিষ্ঠ বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের অনেকে রোহিঙ্গাদের প্রতিবেশী বাংলাদেশ থেকে আসা অবৈধ অভিবাসী বলে মনে করেন। মিয়ানমারে চলাচলের ক্ষেত্রে নানা বিধিনিষেধেরও শিকার রোহিঙ্গারা।