আন্দোলন-কর্মসূচি নিয়ে দীর্ঘদিন রাজপথে নেই বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল- বিএনপি। বক্তৃতা-বিবৃতির মাধ্যমে সরকারের সমালোনায় সরব হলেও রাজপথের আন্দোলন-সংগ্রামে একেবারেই নীরব সংসদের বাইরে থাকা দেশের অন্যতম প্রধান এ রাজনৈতিক দলটি। বক্তৃতা-বিবৃতিতেও সরকারের প্রতি তাদের সমালোচনার সুর অনেকটাই নমনীয়। দাবি আদায়ে মাঠের রাজনীতির বদলে সরকারকে বার বার আলোচনার প্রস্তাব দিচ্ছে। এসব কি বিএনপির সাংগঠনিক দুর্বলতা, নাকি কৌশল, সেটা স্পষ্ট নয়। যদিও বিএনপি এটাকে রাজনৈতিক কৌশলের অংশ হিসেবে দাবি করছে। দলের নেতাদের দাবি, বর্তমান অগণতান্ত্রিক পরিবেশে যে প্রক্রিয়ায় আন্দোলন- সংগ্রাম করা সম্ভব, তা তারা চালিয়ে যাচ্ছেন।রিপোর্ট বাংলা ট্রিবিউনের।
অপরদিকে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ দাবি করছে, ভুল সিদ্ধান্তের কাছে বিএনপি জনবিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে। এজন্য কোনও কর্মসূচি দিলে জনগণের সাড়া মেলবে না বলেই তারা রাজপথের কর্মসূচি দিতে ভয় পায়।
বর্তমান ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ সরকারের বিরুদ্ধে রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ বিএনপি সর্বশেষ বড় ধরনের আন্দোলন গড়ে তুলেছিল, এখন থেকে প্রায় দুবছর আগে। ২০১৫ সালের ৫ জানুয়ারিকে কেন্দ্র করে টানা তিন মাস এ দলটি রাজপথ উত্তপ্ত করে রেখেছিল। একপর্যায়ে তারা ঘোষণা না দিয়েই আন্দোলন থেকে নিজেদের গুটিয়ে নেয়। এরপর বিএনপিকে সেই অর্থে রাজপথে সক্রিয় দেখা যায়নি। এ সময়ে বেশকিছু বার্নিং ইস্যু এলেও তা কাজে লাগাতে পারেনি বিএনপি। এমনকি দলের স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরীর মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় ফাঁসি ও দলের সিনিয়র সহসভাপতি তারেক রহমানের একাধিক মামলায় সাজা হলেও বিএনপি জোরালো কোনও আন্দোলন গড়ে তুলতে পারেনি।
সাম্প্রতিক সময়ে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নাসিরনগরে মন্দিরে হামলা ও হিন্দুদের বাড়িঘরে অগ্নিসংযোগ এবং গাইবান্ধার গোবিন্দগঞ্জে সাঁওতালদের ওপর হামলার পরও দলটির পক্ষ থেকে কোনও জোরালো প্রতিবাদ আসেনি। বর্তমানে আলোচিত এ দুইটি ইস্যু নিয়ে ছোট ছোট বেশ কিছু রাজনৈতিক দল ও সামাজিক সংগঠন রাজপথে প্রতিবাদমুখর হলেও বিএনপি তাদের প্রতিবাদ বক্তৃতা-বিবৃতির মধ্যে সীমাবদ্ধ রেখেছে।
এছাড়া, সুন্দরবনের সন্নিকটে রামপাল কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে ব্যাপক প্রতিবাদ হলেও বিএনপি একটি সংবাদ সম্মেলন ডেকে এর বিরুদ্ধে জনগণকে সচেতন করার আহ্বান জানিয়ে ‘দায়িত্ব’ শেষ করেছে।
অবশ্য রাজপথে কর্মসূচি পালন করতে না পারার জন্য সরকারকে দায়ী করেছেন বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য নজরুল ইসলাম খান। বাংলা ট্রিবিউনকে দেওয়া এক প্রতিক্রিয়ায় তিনি বলেন, ‘সরকার মাঠের কর্মসূচি দেওয়ার সুযোগ দিলেই তো আমরা পালন করবো। আপনারা যে মাঠের রাজনীতির কথা বলছেন, তার সুযোগ কি দেওয়া হচ্ছে। রাজনৈতিক দল হিসেবে আমরা একটা মিছিল নিয়ে রাজপথে নামলে যদি আওয়ামী লীগকে দেখি, তবে তাদের মোকাবিলা করতে পারি। কিন্তু বৈধ অস্ত্র নিয়ে র্যাব- পুলিশ যদি আমাদের সামনে দাঁড়ায়, তাহলে কী করণীয় থাকতে পারে? ’
সম্প্রতি ৭ নভেম্বরের কমর্সূচি করতে দেওয়া হয়নি মন্তব্য করে তিনি বলেন, ‘আমরা মাঠ চাইলে নিষেধাজ্ঞা জারি হবে। হল ভাড়া নিলে তা বন্ধ করে দেওয়া হবে। এটা হলো সরকারের স্টাইল। তাহলে বলেন, আমরা কী করবো। এটা তো হাতপা বেঁধে দিয়ে পানিতে সাঁতার কাটতে বলার মতো অবস্থা।’
তিনি বলেন, ‘আমরা অগণতান্ত্রিক পরিবেশে বাস করছি। বিরোধী মতকে রাজনীতি করার সুযোগই দেওয়া হচ্ছে না। এই পরিস্থিতিতে যে কৌশলে এগোনো দরকার, আমরা সেই ভাবেই এগোচ্ছি।’
বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেন, ‘আমরা তো কোনও যুদ্ধের ময়দানে নেই, যে প্রতি মুহূর্তে আমাদের যুদ্ধ করতে হবে। আর আন্দোলন মানেই যে রাজপথের কর্মসূচি বিষয়টি তা নয়। আমরা গণতান্ত্রিক অধিকারগুলো ফিরে পেতে সংগ্রাম করছি। এই সংগ্রাম বিভিন্ন প্রক্রিয়া ও কৌশলে হতে পারে। কখনও রাস্তায় থাকব, কখনও কথা বলব বা কখনও জনমত তৈরি করব। আন্দোলনের একটাই পথ নয়, যে সারাক্ষণ মারামারি করতে হবে। সকলের একটা ধারণা হয়ে গেছে যে, আন্দোলন মানে মারামারি করা। আর সরকারই তো আমাদের রাজপথের কর্মসূচির স্পেস দিচ্ছে না। কাজেই সম্ভবপর বিকল্প পথে আমরা কর্মসূচি চালিয়ে যাচ্ছি।’
এ বিষয়ে আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারন সম্পাদক আব্দুর রহমান বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘বিএনপিকে মাঠে নামতে দেওয়া হচ্ছে না, এটা মোটেও সত্য নয়। সরকারি দল থেকে তাদের কোনও ধরনের বাধা দেওয়া হচ্ছে না। বিগত ২০১৪ সালের নির্বাচনে অংশ না নিয়ে বিএনপি যে ভুল করেছে, তাতে দলটির নেতাকর্মীরা নৈতিকভাবে দুর্বল হয়ে ঘরে বসে আছে। তারা রাজপথের কোনও কর্মসূচি দিয়ে কোনও নেতাকর্মী খুঁজে পায় না। হতাশার সাগরে নিমজ্জিত হয়ে বিএনপিতে রাজনৈতিকভাবে দেউলিয়াত্বের বহিঃপ্রকাশ ঘটেছে। তারা সাংগঠনিকভাবে দুর্বল তো বটেই, রাজনৈতিকভাবেও জনবিচ্ছিন্ন। এজন্য তাদের কোনও রাজনৈতিক কমর্কাণ্ডে দেখা যাচ্ছে না।’
সরকার সমাবেশে করতে দিচ্ছেনা’ বিএনপির এমন বক্তব্যের জবাবে আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য মোহাম্মদ নাসিম সম্প্রতি বলেছেন, ‘আপনারা যখন ক্ষমতায় ছিলেন, তখনতো আমাদের মিছিল করতে দেননি। আমরা ব্যারিকেট ভেঙে সমাবেশ করেছি। আমরা সমাবেশ করতে গিয়ে বার বার মার খেয়েছি। পুলিশ আমাদের ওপরে নির্যাতন চালিয়েছে। কিন্তু শত বাধা অতিক্রম করে আমরা সামাবেশ করেছি। জনগণ সঙ্গে থাকলে পুলিশের ব্যারিকেট ভেঙে আপনারা সমাবেশ করেন।’
এর আগে দলটির সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের চট্টগ্রামে এক অনুষ্ঠানে অংশ নিয়ে বিএনপিকে দেউলিয়া রাজনৈতিক দল আখ্যায়িত করে বলেন, ‘বিএনপি সব হারিয়ে এখন উন্মাদ হয়ে গেছে। তারা জনগণের ওপর আস্থা হারিয়ে বিদেশি নির্বাচনের দিকে চাতকের মতো চেয়েছিল। আন্দোলন হবে কোন বছর? যারা ক্ষমতার জন্য বিদেশের দিকে তাকিয়ে থাকে, তাদের চেয়ে দেউলিয়া দল দেশে আর নেই। ’
বিএনপির রাজনীতি কেবল ঘরে বসে প্রেস ব্রিফিংয়ের মধ্যেই সীমিত উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘তাদের আন্দোলন করার কোনও শক্তি নেই। আন্দোলন করার ক্ষমতা, শক্তি, সামর্থ্য ও সাহস যে তাদের নেই, গত সাত বছরে তা প্রমাণ হয়েছে।’