সুনীল বড়ুয়া:
নাফনদী কেন্দ্রিক দুই দেশের এক শ্রেণীর দালালের সহযোগিতায় কক্সবাজারের টেকনাফ ও উখিয়া ও নাইক্ষ্যংছড়ির ঘুনধম সীমান্তের বিভিন্ন পয়েন্ট দিয়ে মিয়ানমার থেকে রোহিঙ্গারা এদেশে অনুপ্রবেশ করছে। সীমান্তে বিজিবির নজরদারি কম এমন পয়েন্ট দিয়েই রাতের আঁধারে দালালেরা রোহিঙ্গাদের এদেশে আনছেন। বিনিময়ে দালালেরা নিচ্ছেন জনপ্রতি ১০ থেকে ১৫ হাজার টাকা। তাই সীমান্তে বিজিবির কঠোর নজরদারি স্বত্বেও ঠেকানো যাচ্ছেনা রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশ। তবে নানা বাধাবিঘœ পেরিয়ে কিছু কিছু রোহিঙ্গা এদেশে আশ্রয় নিলেও ওদের মানবেতর দিন কাটছে ।
রোহিঙ্গাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, মিয়ানমারে অমানবিক নির্যাতনের শিকার এসব রোহিঙ্গারা অর্ধাহারে-অনাহারে বন-জঙ্গলে লুকিয়ে থেকে সীমান্ত পাড়ি দিচ্ছেন দালালের হাত ধরে। সীমাহীন কষ্টে কিছু কিছু রোহিঙ্গা এদেশে অনুপ্রবেশ করলেও আবার বিজিবির হাতে ধরা পড়ে কাউকে ফেরত যেতে হচ্ছে স্বদেশে। আর যারা ঢুকছেন, বেশিরভাগ আশ্রয় নিচ্ছেন টেকনাফের লেদা ও উখিয়ার কুতুপালং অনিবন্ধিত রোহিঙ্গা ক্যাম্পে। কিছু কিছু চলে যাচ্ছে বিভিন্ন বাড়ি ঘরে। অনুপ্রবেশকারী রোহিঙ্গাদের ভাষ্য বাসস্থান,খাবারসহ মানবিক নানা সংকটে মানবেতর জীবন যাপন করছেন তারা।
গত শুক্রবার টেকনাফের লেদা অনিবন্ধিত রোহিঙ্গা ক্যাম্পে কথা হয়, মৌলানা ছৈয়দ করিমের সঙ্গে। তিনদিন আগে (২৪ নভেম্বর) মিয়ানমারের নাইখ্যংপাড়া থেকে এসে এ ক্যাম্পে আশ্রয় নেন তিনি। তিনি বলেন,‘মিয়ানমার সেনাদের অত্যাচার নির্যাতন সইতে না পেরে,জান বাঁচানোর জন্য এখানে পালিয়ে এসেছি,কিন্তু এখানে আশ্রয় পেলেও খাবার নেই,ঘুমানোর জায়গা নেই। তিনি বলেন,পরিবারের ১৫ সদস্যের মধ্যে ৮ জনকে আনতে পেরিছি,অন্যরা কোথাই জানিনা। এরমধ্যে দুই ছেলে আছে টেকনাফ হাসপাতালে।
কূলসুমা খাতুনের বয়স হবে ৫০-৫৫ বছর। পরিবারের ৫ জনকে নিয়ে তিনদিন আগে এ ক্যাম্পে আত্মীয়ের ঘরে আশ্রয় নেন। কুলছুমা জানান, মিয়ানমার থেকে পরিবারের ৭জন সদস্য একসাথে রওয়ানা হন। অনেক কষ্ঠে দালালের মাধ্যমে এদেশে আসেন। কিন্তু চাহিদামত টাকা দিতে না পারায় দালাল ওই পরিবারের দুই পুরুষ সদস্যকে নৌকা থেকে নামতে দেয়নি। তারা এখন কোথাই তাও তিনি জানেন না।
রাইগমারবিল থেকে আসা নুরুল আলম (৬০) জানালেন, রাতের আঁধারে নাফনদী পাড়ি দিয়ে এদেশে চলে আসেন। নাতি,ছেলে ছেলের বউসহ পরিবারের ৭জনকে আনতে পারলেও তার ১২বছরের যমজ দুই মেয়ে এবং স্ত্রীর এখন কোথাই আছেন তিনি জানেননা। সবাইকে নিয়ে এখন মানবেতর দিন কাটাচ্ছেন।
তিন সন্তানের জননী রোজিনা খাতুন বলেন,দালালকে (নাফনদীর নৌকার মাঝি) ১০হাজার টাকা এখানে এসেছি। কিন্তু এখন খাবার পাচ্ছিনা,কোলের সন্তানকে কিছু খাওয়াতে পারছিনা,ঘুমানোর জায়গা নেই।
একই কথা বললেন,নুর হাসেম নামের রোহিঙ্গা যুবক। তিনি বলেন, দালালরে কুড়ি হাজার টেয়া দিই এড়ে (এখানে) আস্সি। এহন ঘুম যাইবার জাগা নাই। রাস্তাঘাড়ত থাকা পরের।
লেদা রোহিঙ্গা ক্যাম্পের এ ব্লকের নেতা মো. ইলিয়াছ। তাদের ভাষায় যাকে বলে মেম্বার। ইলিয়াছ জানান, এ ক্যাম্পের ৬টি ব্লকে দুইহাজার ৯২ পরিবার বসবাস করতো। গত এক সপ্তাহে এখানো আরো প্রায় তিনশ পরিবার নতুন যোগ হয়েছে। যা সংখ্যা হবে প্রায় দেড় হাজার।
তিনি বলেন, মিয়ানমারে রোহিঙ্গাদের উপর নির্যাতন-নিপিড়ন চলছে। এখন কি করবো তাই আশ্রয় দিতে হচ্ছে। কিন্তু সমস্যা হচ্ছে থাকা এবং খাওয়ার। আমরা ওদের খাবার কোথ্থেকে দিব,আমরাও তো কষ্ঠ করে আছি। আর যারা আগে থেকে এখানে আছে ,তারাও থাকে ৮-১০ ফুটের ছোট্ট ঘরে। তাই এখন প্রায় ঘরে কয়েকজন ঘুমালে বাকিদের নির্ঘুম রাত কাটাতে হচ্ছে।
টেকনাফের হোয়াইক্যং এলাকার কয়েকজন বাসিন্দা জানান, এখানকার স্লুইট গেইট সংলগ্ন কয়েকটি পয়েন্টকে দালালেরা অনুপ্রবেশের নিরাপদ রুট হিসাবে ব্যবহার করছে। তবে কয়েকদিনে এসব এলাকাগুলোতেও বিজিবি নজরদারি বাড়িয়ে দেয়। গত শুক্রবার (২৫ নভেম্বর) অনুপ্রবেশকালে অন্তত ৫০জন রোহিঙ্গা বিজিবির হাতে ধরা পড়েছে।
তারা জানান,মিয়ানমার অংশ আর বাংলাদেশ সীমান্ত দুকুলেই দালাল থাকে। দু’কুলের দালালের মধ্যে সমঝোতার মাধ্যমে অনুপ্রবেশ ঘটে থাকে।
টেকনাফ থানার ওসি আব্দুল মজিদ জানান, রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশে সহযোগিতার অভিযোগে গত একসপ্তাহে বিজিবি ও পুলিশের ১১জন দালালকে আটক করেছে। এদের সবাইকে মোবাইল কোর্টের মাধ্যমে বিভিন্ন মেয়াদে সাজা দেওয়া হয়েছে।
অন্যদিকে গত শুক্রবার (২৫ নভেম্বর) টেকনাফে এক সংবাদ সন্মেলনে বিজিবি’র মহাপরিচালক মেজর জেনারেল আবুল হোসেনও রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশের বিষয়টি স্বীকার করেন। তিনি বলেন, সীমান্তে রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশ ঠেকাতে বিজিবি কঠোর অবস্থানে আছে। তবুও নিশ্চিদ্রভাবে সবগুলো পথ বন্ধ করা আসলেই সম্ভব নয়। তবুও আমরা চেষ্টা করছি,যেসব পথ দিয়ে অনুপ্রবেশ করছে সেগুলোকে আমরা চিহ্নিত করেছি। সেখানে আমরা নিরাপত্তা জোরদার করেছি। তবুও কিছু কিছু অনুপ্রবেশ হচ্ছেনা,তা বলা যাবেনা।
আপনারা জানেন, এখানে দালাল আছে। ওইসব দালাল টাকার বিনিময়ে রোহিঙ্গাদের অনুপ্রবেশে সহযোগিতা করছে। তবে আমরা যথাসাধ্য চেষ্ঠা করে যাচ্ছি,অনুপ্রবেশ একেবারে বন্ধ করতে।