সোয়েব সাঈদ ও হাফিজুল ইসলাম চৌধুরী, রামু।
সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি আবহমানকাল থেকে আমাদের সভ্যতা ও সংস্কৃতির প্রধান বৈশিষ্ট্য। স্বার্থান্বেষী মহলের সংকীর্ণ মন-মানসিকতা কখনো কখনো এর ব্যত্যয় ঘটালেও দেশবাসীর চিরায়ত অসাম্প্রদায়িক মনোভাব তা নস্যাৎ করে দেয়।
তবুও এটা অনস্বীকার্য যে, মাঝে মধ্যে সাম্প্রদায়িকতার বিষবাষ্প আমাদের ইতিহাস ও ঐতিহ্যকে কলঙ্কিত করে দেশ ও জাতির মর্যাদাবোধকে, ভাবমূর্তিকে বিবেকের কাঠগড়ায় দাঁড় করায়।
সাম্প্রদায়িক সহিংসতার জন্যে দায়ী ধর্মীয় চেতনার অভাব, কোনোভাবেই ধর্ম নয়। বলাবাহুল্য, বিশ্বে এমন কোনো ধর্ম নেই যাতে হিংসাত্মক মন-মানসিকতার অনুমোদন রয়েছে।
মঙ্গলবার ৯ মার্চ সকাল ১১টায় রামু উপজেলা পরিষদ মিলনায়তনে আন্ত: ধর্মীয় সংলাপ অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির বক্তব্যে ধর্ম বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী অধ্যক্ষ মতিউর রহমান এসব কথা বলেন। এসময় তিনি আরও বলেন, রামুর মানুষ সম্প্রীতির বন্ধনে আবদ্ধ ছিল। কিন্তু এ বন্ধনে ফাটল ধরিয়েছে কিছু উগ্রবাদী গোষ্ঠী।
২০১২ সালের ২৯ সেপ্টেম্বর রামুর বৌদ্ধ বিহার ও বসতিতে ব্যাপক হামলা, অগ্নিসংযোগ, ভাঙচুর ও লুটপাটের ধ্বংসযজ্ঞ এতোটা ব্যাপক হয় যে, তা সারা বিশ্বের দৃষ্টি আকর্ষণ করে।
আমরা দেশ-বিদেশে সকলের কাছে নিন্দিত হই। লজ্জায় মাথানত হয় একটি অবিস্মরণীয় মুক্তিযুদ্ধে বিজয়ী এই জাতির।
প্রধান অতিথির বক্তব্যে এ বীর মুক্তিযোদ্ধা আরও বলেন, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার দৃড়তায় ধ্বংসপ্রাপ্ত বৌদ্ধ মন্দির নতুন করে নির্মিত হয়েছে। সেনাবাহিনীর মাধ্যমে বিধ্বস্ত, লুণ্ঠিত বসতবাড়িগুলো মেরামত করে পূর্বাবস্থায় ফিরিয়ে আনা হয়েছে।
শেখ হাসিনা নিজেই নেতৃত্ব দিয়ে বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের ক্ষত কাটিয়ে তোলার চেষ্টা করেছেন। তা না হলে এ হামলা পরবর্তী ঘটনা বিশ্বে আরও ভয়াবহ আকার ধারণ করতো।
তবে রামু হামলার যেন আর পুনরাবৃত্তি না ঘটে সেদিকে নজর দেওয়ার আহবান জানান মন্ত্রী।
মন্ত্রী বলেন, সাম্প্রদায়িক সম্প্রতি রক্ষায় সব ধর্মের, সব মতের মানুষকে ভূমিকা রাখতে হবে। কোনভাবে একে অন্যের প্রতি বা অন্য ধর্মের প্রতি বিরূপ মনোভাব প্রকাশ করা যাবে না। প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনা বাংলাদেশকে একটি অসাম্প্রদায়িক, সুখী, সমৃদ্ধ ও আধুনিক দেশ হিসেবে গড়ার জন্য নিরলসভাবে কাজ করে যাচ্ছেন। তিনি আরো বেশিদিন বেঁচে থাকলে এ দেশ উন্নতির শিখরে আরোহন করবে।
রামু উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) সেলিনা কাজীর সভাপতিত্বে সংলাপে বিশেষ অতিথির বক্তৃতা করেন, কক্সবাজার-রামু আসনের সংসদ সদস্য আলহাজ্ব সাইমুম সরওয়ার কমল, স্থানীয় নারী সংসদ সদস্য খোরশেদ আরা হক, কক্সবাজার জেলা প্রশাসক (ডিসি) মো.আলী হোসেন, অতিরিক্ত পুলিশ সুপার ফেরদৌস আলী চৌধুরী, বাংলাদেশ বৌদ্ধ ধর্মীয় কল্যাণ ট্রাস্টের ভাইস চেয়ারম্যান সুপ্ত ভূষন বড়ুয়া, রামু উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান রিয়াজ উল আলম, রামু বৌদ্ধ ঐক্য ও কল্যাণ পরিষদের সাধারণ সম্পাদক তরুণ বড়ুয়া, রামু বাইপাস জামে মসজিদের খতিব হাফেজ আবদুল হক, জেলা পূজা উদযাপন পরিষদের সাধারণ সম্পাদক বাবুল শর্মা ও জেলা ইমাম সমিতির সভাপতি সিরাজুল ইসলাম ছিদ্দিকি।
সংলাপে সাংসদ সাইমুম সরওয়ার কমল বলেন, শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানের মাধ্যমে দেশকে উন্নতির দিকে নিয়ে যেতে হবে। সংঘাতের মাধ্যমে নয়। সহিংসতা সবাই করে না। কয়েকজনের জন্য পুরো সমাজ কলংকিত হয়ে পড়ে। যেমনটা হয়েছিলো ২০১২ সালে ২৯ সেপ্টেম্বর রামুর ঘটনায়। ওই ঘটনায় জড়িতরা চিহ্নিত হয়নি। উল্টো নিরীহ লোকজন এখন মামলায় অভিযুক্ত হয়ে হয়রানির শিকার হচ্ছে। তিনি আরো বলেন, ১৯৭১ সালের রাজাকার আল বদররা রামুর রাজারকুল এবং গর্জনিয়া বাজার সহ বিভিন্নস্থানে হত্যা, নির্যাতন ও লুটপাট চালায়। ওই সময় সুযোগ সন্ধানী কিছু মানুষ এসব অপরাধে নিজেদের সম্পৃক্ত করে। এ ধরনের সুযোগ সন্ধানী মানুষ সর্ম্পকেও আমাদের সজাগ থাকতে হবে। উগ্রবাদ থেকে জঙ্গিবাদ জন্ম নেয়। তাই উগ্রবাদকে দমনের মাধ্যমেই জঙ্গিবাদ প্রতিহত করতে হবে।
নারী সাংসদ খোরশেদ আরা হক বলেন, বঙ্গবন্ধুর গর্বিত কন্যা শেখ হাসিনা দেশের জন্য, দেশের মানুষের জন্য অনেক কিছু করেছেন। উনার পিতার ডাকে আমরা বাংলাদেশ পেয়েছি। বর্তমানে তিনি এ দেশকে বিশ্বের অন্যতম দেশে পরিণত করছেন। কিন্তু সন্ত্রাসীরা তা মেনে নিতে পারছে না। তিনি আরও বলেন, যারা সন্ত্রাস বিরোধী কর্মকান্ডে জড়িত তারা কোন ধর্মে গ্রহণযোগ্য হয় না। তাই সন্ত্রাসী ও জঙ্গিবাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেছে বর্তমান সরকার।
কক্সবাজার জেলা প্রশাসক মো.আলী হোসেন বলেন, কক্সবাজারের ইতিহাস মানে রামুর ইতিহাস। যেখানে স্ব স্ব ধর্মের লোক সম্প্রীতির বন্ধনে বসবাস করে আসছে। ধর্ম এমন একটা বিষয় যেখানে হিংসা বিদ্বেষ নেই। আবার ধর্মের নামে অপপ্রচার চালিয়ে কেউ কেউ রাষ্ট্র, জাতি তথা গোষ্ঠীর জন্য বিপদ জনক হয়ে উঠে। এসব বিষয়ে সর্তক থেকে ফের সম্প্রীতির সমন্বয়ে বসবাস করে প্রমাণ করতে হবে কক্সবাজারবাসী অন্য সব জেলার চেয়ে অনেক এগিয়ে।
এদিকে আন্ত: ধর্মীয় সংলাপ অনুষ্ঠান শেষে দুপুর ২টায় ধর্ম মন্ত্রীসহ অতিথিবৃন্দ রামুর বিভিন্ন বিহার পরিদর্শন করেন।