হাফিজুল ইসলাম চৌধুরী, স্টাফ রিপোর্টার
আমাদের রামু ডটকম :
বাংলাদেশের দক্ষিণ পূর্বের সর্বশেষ জেলা হল পার্বত্য বান্দরবান জেলা। বান্দরবান জেলাধীন সর্ব দক্ষিণ পূর্বে মিয়ানমার সীমান্ত ঘেঁষে নাইক্ষ্যংছড়ি উপজেলার অবস্থান। এর পশ্চিম ও উত্তরে কক্সবাজারের রামু উপজেলা।
পাঁচটি ইউনিয়ন নিয়ে ৪৬৯.০০ বর্গকিলোমিটার জুড়ে এর অবস্থান। সর্বমোট ১৭টি মৌজা ও ২১৮টি পাড়া নিয়ে নাইক্ষ্যংছড়ি উপজেলা গঠিত। উপজেলায় সর্বমোট জনসংখ্যা ৫৪,৩০০ জন।
ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যায় যে, এখানে ব্রিটিশ আমল থেকেই মারমা আদিবাসীরা বসবাস করে আসছে।
মারমারা প্রথম যখন নাইক্ষ্যংছড়ি উপজেলা সদরে বসতি শুরু করে, তখন তারা একটি টিলার উপর তাদের ধর্মীয় উপাসনালয় স্থাপন করেছিলো।
তার নীচে পাড়া ঘেষে ছোট একটি খাল প্রবাহিত। যা আজও আছে। যাকে তারা নাম দিয়েছিল ‘‘দেবতার খাল’’ পাহাড়টিকে তারা দেবতার পাহাড় হিসেবে জানে।
তাদের ভাষায় ‘‘নাঞা’’ অর্থ দেবতা বা ভূত টং অর্থ পাহাড়, অন্য একটি সূত্র মতে নাঞা অর্থ দেবতা বা ভূত সচং অর্থ খাল। নাঞাটং অর্থ দেবতার পাহাড় বা ভূতের পাহাড়, মতান্তরে নাঞাসচং অর্থ দেবতার খাল বা ভূতের খাল।
ওই খালে তৎকালিন সময়ে পাইন্না সাপ বেশি লক্ষ্য করা যেত। আর তাদেরকে দেখলেই উপজাতী বাসিন্দারা নাইট্টং বলে চিৎকার দিয়ে উঠত। মূলত এই শব্দ থেকে নাইক্ষ্যংছড়ি নামের উৎপত্তি।
পার্বত্য অঞ্চলের বেশির ভাগ স্থানের নামের সাথে ‘‘খাল ছড়ার’’ নাম যুক্ত আছে লক্ষ্য করা যায়।
নাইক্ষ্যংছড়ি থানা ১৯২৩ সালে প্রতিষ্ঠা হয় এবং ১৯৮২ সালে উপজেলা হিসেবে প্রতিষ্ঠা লাভ করে।
এই উপজেলাটি বিভিন্ন কারণে সারাবিশ্বে পরিচিত হয়ে উঠেছে। বিশেষ করে ২০১৪ সালের ২৮ মে বাংলাদেশ-মিয়ানমার সীমান্তের পাইনছড়ি ৫২ নাম্বার পিলার এলাকায় দায়িত্ব পালনকালে মিয়ানমার সীমান্তরক্ষি বাহিনীর (বিজিপি) গুলিতে নাইক্ষ্যংছড়িস্থ ৩১ বর্ডার গার্ড ব্যাটালিয়নের নায়েক মিজানুর রহমান নিহত হওয়ার পর থেকে এ উপজেলাটি আরো আলোচিত হয়ে উঠে সারাবিশ্বে।
এখানে ভিন্ন ভিন্ন জাতি, সম্প্রদায় সহাবস্থানে বসবাস করে আসছে। বাঙালি, মারমা, চাক, মুরুং, তংঞ্চগ্যা, চাকমা, ও ত্রিপুরা সম্প্রদায়ের লোকজন নাইক্ষ্যংছড়িতে স্ব স্ব ভাষায় কথা বলে।
আগেকার দিনে উপজাতী বাসিন্দারা জুম চাষ করে জীবিকা নির্বাহ করলেও বর্তমানে তারা বাঙালিদের ন্যায় হাল চাষ এবং চাকুরি করেই আর্থিক ভাবে সফলতা অর্জন করছে।
প্রতিষ্টালগ্ন থেকেই এতদঅঞ্চলকে মডেলে পরিণত করতে আপ্রাণ চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রী ও বান্দরবান ৩০০ নং আসনের সংসদ সদস্য বীর বাহাদুর উশৈসিং। তাঁর প্রচেষ্টায় নাইক্ষ্যংছড়িতে একটি ডিগ্রী কলেজ, ৩১ শয্যা বিশিষ্ট স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স, একটি সরকারি বিদ্যালয়সহ মোট ৪টি উচ্চবিদ্যালয়, ৫টি দাখিল মাদ্রাসা, ৫৪টি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, ৮৫টি মসজিদ, ৩৭টি বৌদ্ধ বিহার, বিভিন্ন সম্প্রদায়ের ধর্মীয় উপসনালয় নির্মাণসহ পাঁচ ইউনিয়নের বহু সড়কের দৃশ্যমান উন্নয়ন সম্ভব হয়েছে।
পর্যটনের নতুন স্পট নাইক্ষ্যংছড়ি উপবন :
লেকের স্বচ্ছ জলে মুখ লুকিয়েছে নীল আকাশ। চার পাড়ের সবুজ বনানী মেলেছে সবুজ ডানা। সবুজ আর নীলের মাঝে লেকের বুক চিরে দাঁড়িয়ে আছে ঝুলন্ত সেতুটি। অসাধারণ সেই প্রাকৃতিক সৌন্দর্য্য। একবার তাকালে চোখ ফেরানো যায় না। পাখির কলরবে মুখরিত চারপাশ। এ যেন অরণ্যের মাঝে ফিরে আসা নতুন করে।
বলছি, বান্দরবানের নাইক্ষ্যংছড়ি উপবন লেকের কথা। সম্পূর্ণ প্রাকৃতিক সবুজ বেষ্টিত নাইক্ষ্যংছড়ির প্রাণ কেন্দ্রে জেলা পরিষদ ডাক বাংলো ঘেঁষে প্রায় আধা কিলোমিটার দীর্ঘ কার্পেটিং সড়ক যুক্ত প্রাকৃতির অপরূপ শোভায় শোভিত উপবন লেকটি অবস্থিত।
একে আরো সৌন্দর্য্যমন্ডিত করে তুলেছে দৃষ্টিনন্দন সারি সারি বিভিন্ন প্রজাতির সবুজ পাতার গাছ গুলো। রয়েছে পাহাড়কন্যা নাইক্ষ্যংছড়ির মনোরম ছায়ানিবিড় সৌন্দর্য্য অবলোকনের সুযোগ। যা ভ্রমনার্থীদের আনন্দের মাত্রা বাড়িয়ে দেবে।
প্রাকৃতিক সৌন্দর্যকে কাছ থেকে উপভোগ করতে পর্যটকরা ভিড় জমান এ লেকে। শৌখিন মৎস্য শিকারীরা উপজেলা পরিষদ থেকে নির্দিষ্ট ফি হারে টিকেট সংগ্রহ করে বড়শি দিয়ে মাছ ধরতে ব্যস্ত সময় কাঠাচ্ছেন।
এ উপজেলাতে উপবন লেক ছাড়াও বিনোদনের জন্য শিশু পার্ক, বাংলাদেশ প্রাণি সম্পদ গবেষণা ইনষ্টিটিউট, বাণিজ্যিকভাবে গড়ে উঠা কুমির প্রজনন কেন্দ্র, উপজেলার হর্টিকালচার সেন্টার, দেশের বৃহৎ রাবার বাগান, আশারতলী গ্রামের চা-বাগান, সদর ইউনিয়নের জারুলিয়াছড়ির সোসং ও কোয়াসং ঝর্ণা অন্যমত।
নাইক্ষ্যংছড়ি উপবন লেকের চারপাশে বাঙ্গালী ও পাহাড়ী অধিবাসীদের বসতি, সারি সারি কাঠের বাড়ি, তাদের ভাষা-সংস্কৃতি আর আদি এ জনগোষ্ঠীর জীবনচিত্রের ভিন্নতা তুলে ধরছে পর্যটকদের কাছে।
উপবন লেকের দৃশ্য অবলোকনের পর অনেকে রেষ্ট হাউজে রাত যাপনও করছে নিজেদের সুবিধামত। এছাড়া ঘুমধুমের কুমির প্রজনন কেন্দ্র ও বাংলাদেশ প্রাণী সম্পদ গবেষণা ইনষ্টিটিউটেও ভিড় করেন পর্যটকেরা।
উপজেলা আওয়ামীলীগের যুগ্ন-আহবায়ক তসলিম ইকবাল চৌধুরী আমাদের রামুকে বলেন, পাহাড়ী কন্য নাইক্ষ্যংছড়ির উপবন লেকে মাছ ধরার জন্য বড়শি নিয়ে খুব শখের বসে মানুষ আসে। আসলেই নাইক্ষ্যংছড়ির লেকটি খুবই সুন্দর। ঝুলন্ত ব্রীজ, এটির পাশেই একটি ছোট্ট উপজাতীয় পল্লী। পর্যটকদের আর্কষনের অন্যতম উপকরণ দীর্ঘ লেক। ছোট ছোট বিশ্রাম ঘর, আর উচুঁ-নিচু পিচঢালা পথ। বিশেষ করে রাতের নাইক্ষ্যংছড়ি দেখতে খুবই দারুণ।
জানতে চাইলে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) এএসএম শাহেদুল ইসলাম আমাদের রামুকে বলেন, সম্ভাবনাময় নাইক্ষ্যংছড়ি উপজেলাকে পর্যটকে মূখরিত করে রাখতে বেশ কিছু পরিকল্পনা হাতে নেওয়া হয়েছে। এর মধ্যে অন্যতম হলো উপবন লেক এলাকায় ভাল মানের কয়েকটি মদুচন্দ্রিমা কটেজ এবং জারুলিয়াছড়িতে একটি ওয়াচ টাউয়ার (সর্বোচ্চ পর্বত) নির্মাণ। বিকেল বেলায় যে টাউয়ারে বসেই পুরো নাইক্ষ্যংছড়ির সুন্দর্যকে উপভোগ করতে পারবে পর্যটক ও স্থানীয়রা।