ক্ষণে ক্ষণে আমার কন্যা সোহাগী জাহান তনুর মলিন মুখশ্রী মনে পড়ছে। আমার হাজার লক্ষ্য নয়নের আবেগী অশ্রু কোনো বাঁধই যে মানছে না। তবে কি তনু’র জন্য ওরা আজ অশ্রুজলের সাত সমুদ্র সৃজন করতে উঠে পড়ে লেগেছে।
আহা আমার তনু সোনা, আমার জাদু সোনা, তোর হাসিমাখা মুখখানা দেখলে তোর বাবা মায়ের মতো এই দেশমাতারও প্রাণ জুড়িয়ে যেত। পড়াশোনায় খুব ভালো ছিলিসরে তুই। কুমিল্লার ভিক্টোরিয়া কলেজের কে না চিনত তোকে? গাইতিস, আবৃত্তি করতিস, অভিনয় করতিস। আবার টিওশনি করে বাবার বইয়ে নেয়া সংসারের বোঝাটাও হালকা করতে প্রাণপণ লড়তিস। কেউ বিপদে পড়লে শান্তির ঠিকানা তুইই বলে দিতিস মা। সমাজ সংসারের সকলের দুঃখ দূর করবার তোর যে বাসনা বা ব্যতিব্যস্ততা, তা সবাইকে শান্তির দিশা দিত। তোর মনটা যে ছিল আমার মতোই উদার, প্রফুল্ল ও সুন্দর।
কিন্তু সেই ফুলের মতো পবিত্র নিষ্কলুষ আমার মায়ের সকল চঞ্চলতা, ক্ষিপ্রতা, ধ্যান, প্রজ্ঞা বা ত্যাগ ময়নামতি সেনানিবাসের ভিতর অলিপুরের সংরক্ষিত ও নিরাপদ জোনে সন্ধ্যা রাতের অভিশপ্ত এক বদ হাওয়া এসে নিমিষে মিলিয়ে দিয়ে গেল। আমি অভাগা তোর অসম্মান, ক্রন্দন, বেদনা ও নিস্তব্ধতা চেয়ে চেয়ে দেখলাম। কিছুই করতে পারলাম নারে! কি অভাগা মা আমি তোর! এই অসহায় মাকে কখনো ক্ষমা করিস না তুই। তনু এই যে দেখ, আমার বুকের গভীরে আজ রক্তগঙ্গা, উন্মাতাল খান্ডবদাহন। হৃদয়ের তন্ত্রিতে তন্ত্রিতে আজ কাল বোশেখীর ঝড়। আমি ভেঙে পড়েছিরে মা। কিসের স্বাধীনতা, কিসের বিজয়! কোথায় আমার ৩০ লাখ সুপুত্র মুক্তিযোদ্ধা? ওরে কোথায় আমার ২ লাখ বীরাঙ্গনা। তোরা আরেকবার এসে এই অসভ্য বর্বর কাপুরুষদের বিনাশ করে দিয়ে যা। আমি যে, ইয়াসমিন, কল্পনা চাকমা, সোহাগীসহ নাম না জানা লাখো মায়ের বেদনার ভার সইতেই পারছি না। আমি ৪৫ বছর ধরে, কী অস্পৃশ্য অসভ্য পুত্রের দঙ্গল জন্ম দিয়ে চলেছি, যারা আমার মায়েদের এক মুহুর্ত শান্তিতে থাকতে দেয় না। প্রভু কি পাপে বিদ্ধ করছ আমায়। গগনবিদারি চিৎকারে বলতে ইচ্ছে করছে, আমায় মুক্তি দাও হে বেপরোয়া শয়তান ভূমিপুত্রের দল। কাপুরুষ, দূরাচার, বেহায়া তোমরা আমার সন্তান নও, হতেই পারো না। তোমরা হানাদারের প্রেতাত্মা, উড়ে এসে জুড়ে বসা শ্বাপদ শকুন। তোমরা হায়েনা, তোমরা মানবতাবিরোধী।
আর যারা নিজেদেরকে দাবি করো, আমার রক্ষক বা শাসক, আমাকে ভালো রাখবার চিন্তায় সুশীলতা বা অধিকারের বুলি কপচিয়ে পত্রিকার পাতা, মাইকের হর্ণ বা টিভি টেবিলে যারা ঝড় তুলবার প্রয়াস পাও, যারা কানুনকে চিরকাল জন্মান্ধ করে রাখো, যারা রক্ষক হয়ে ভক্ষকের পক্ষে নিরবতার সংগীত গাও, তোমরাও জেনো, ঐ হায়েনাদের সারথি ছাড়া তোমরা আর কিছু নও।
তোমরা মনে রাখবা, প্রত্যেকটা মায়ের কিঞ্চিৎ অপমানের প্রতিদান তোমাদের শোধাতেই হবেই আজ অথবা কাল। আমার এই মায়েদের উদর ছাড়া তোরা পৃথিবীর মুখ দেখতি কি করে বল, নিমকহারাম অকৃতজ্ঞের দল। আপন মন্দিরের বেদিতে রেখে মাকে অহর্নিশ পূজো করতে হয়, অসম্মান নয়! অথচ তোরা মায়ের আবেদন ভুলে গিয়ে বেপথো ডাকু ও লম্পট সেজেছিস। তোদের মতো মধ্যযুগীয় বর্বরদের নিয়েই আমার সুপুত্র কবি জীবনানন্দ দাশ তাঁর ‘এইসব দিনরাত্রি’তে লিখেছিল,
মানুষের লালসার শেষ নেই
উত্তেজনা ছাড়া কোনো ঋতুক্ষণ
অবৈধ সংগম ছাড়া সুখ
অপরের মুখ ম্লান করে দেওয়া ছাড়া ছাড়া প্রিয় সাধ
নেই।
আমার পবিত্র জমিন আজ ধর্ষকের চারণভূমি হয়ে উঠল কেমনে? খুনিদের অভয়াশ্রম কিভাবে হয়ে উঠল আমার বদ্বীপের প্রতিটি কণা? বেহায়াদের আবাসস্থল কি করে হতে পারে অজস্র ত্যাগে পাওয়া আমার এই পবিত্র প্রান্তর? অপরাধ আর অনাচারের মগের মুল্লুক হয়ে উঠল কখন আমার বিশুদ্ধ বিমল জমিন?
এই ছিল আমার জন্মদিনের পাওনা? তোদের খাইয়ে পরিয়ে, চিত্তে বৃত্তে বাঁচিয়ে রেখেছি, বড় করে তুলছি, আর এই ছিল তার প্রতিদান। তোরা আজকের কাপুরুষ বাঙালিরা পারিসও। আমি তোদের দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছি। ভয়ঙ্কর গ্লানিতে মুখ লুকিয়েও আজ কোনো শান্তি পাচ্ছি না। দূর হ, সব বেঈমান, অবিবেচক ও অবিমৃষ্যের দল। আমি তোদের দেশমাতা নই। তোরা আমার কেউ না। তোদের সাজানো ফুল আমার চাই না। দোহাই তোদের, কোনো শ্রদ্ধাঞ্জলির লোক দেখানো আদবকেতা আমার আর সহ্য হয় না! যেখানে আমার সন্তান তনুরা বাঁচতে পারে না, সেখানে আমিও আমার দুর্মর মৃত্যু কামনা করি। আমি মরে গেলে তোরা ঢাকঢোল পিটিয়ে, মরণ সংগীত গেয়ে, বিদায় নৃত্য নাচতে নাচতে, তোদের যেমন খুশি তেমন সাজার উৎসব করিস। আমার জন্মদিনকে যারা শোকগাঁথায় ভরে দিলি তাদের জন্য এই আমার সবিশেষ আবদার ও আকুতি।
আমার জমিনে হাজারে বিজারে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা হন্তারক, ধর্ষক, নিরব সুশীল, নির্বিকার আরক্ষা, আইনের শাসন প্রতিষ্ঠায় অপারগ শাসক, স্বার্থান্ধ মিডিয়া, মায়ের অসম্মানকে জায়েজ করতে পোশাক ঠিক নাই, আচার ঠিক, বাড়ির বাইরে গেল কেন, গলা শোনা গেল কেন জাতীয় সোরগোল তোলা কূপমন্ডুক ধর্মান্ধ মোল্লাগোষ্ঠী সবার জন্য আমার অভিশাপ।
আর তোদের হরদম অতিশয় অশান্তির হাত থেকে চিরতরে নির্বাণ লাভ করা আমার মা সোহাগী জাহান তনু’র জন্য স্বাধীনতার সকল শোক উৎসর্গ করলাম। তুই আমার বুকে প্রশান্তির ঘুমেই ভালো থাক মা। আর তোকে কষ্ট পেতে দেব না। জন্ম জঠরের বেদনায় আর তুই কুঁকড়ে উঠবি না মা। তোর প্রাণ প্রদীপ বেদনায় বিবর্ণ নীল হবে না আর। তোর পাহারায় জেগে থাকবে তোর এই অসহায় মা দুঃখিনী বাংলাদেশ।
লেখক: সংবাদকর্মী, মাছরাঙা টেলিভিশন
২৬ মার্চ ২০১৬
facebook.com/fardeen.ferdous
বিডিনিউজ