আন্তর্জাতিক ডেস্ক:
শিশুর স্বাস্থ্যের ওপর মারাত্মক প্রভাব ফেলছে শব্দ, বায়ু, পানি দূষণ। বহুমাত্রিক এসব দূষণে কানে কম শোনা, হৃদরোগ, উচ্চ-রক্তচাপ, স্থায়ী মাথাব্যথা, ক্ষুধামন্দা, অবসাদগ্রস্ততা, নিদ্রাহীনতাসহ নানাবিধ জটিল রোগে আক্রান্ত হচ্ছে শিশুরা। এমনকি শুধু বৈশ্বিক পরিবেশ দূষণের কারণে বিশ্বে প্রতিদিন অকালে মারা যাচ্ছে সাড়ে ৪ হাজারের বেশি শিশু।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, পরিবেশগত কারণ বিশেষত শিশু জন্মের পূর্বে ও পরে মায়ের দৈহিক স্বাস্থ্য এবং পুষ্টি শিশু স্বাস্থ্যের ওপর বিরূপ প্রভাব বিস্তার করে। তাই, নবজাতককে জন্মপূর্ব এসব রোগ ও মৃত্যু ঝুঁকি থেকে বাঁচাতে হলে প্রয়োজন প্রসূতির জন্য শিশুর জন্ম পূর্ববর্তী এবং পরবর্তী স্বাস্থ্যসেবা, পুষ্টিকর খাবার ও উন্নত পরিবেশ সম্মত আবাসস্থল। কিন্তু বিভিন্ন ধরনের দূষণের কারণে মা ও শিশু উভয়েই উন্নত পরিবেশবঞ্চিত হচ্ছে। এ হিসেবে একজন শিশু জন্মের আগে থেকেই পরিবেশ দূষণের শিকার হচ্ছে বাংলাদেশে।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা প্রকাশিত গবেষণা প্রতিবেদন অনুযায়ী, ক্রমবর্ধমান বৈশ্বিক পরিবেশ দূষণের ফলে প্রতি বছর পাঁচ বছরের কমবয়সি প্রায় ১৭ লাখ শিশু অকাল মৃত্যুর শিকার হচ্ছে। এ হিসাবে দিনে মারা যাচ্ছে প্রায় ৪ হাজার ৬৫৮ শিশু। কারণ হিসেবে অনিরাপদ পানি, স্যানিটেশনের অভাব, দরিদ্র স্বাস্থ্যবিধির অনুশীলন ও পারিপার্শ্বিক দূষণের পাশাপাশি আহত হওয়াকেও এর মধ্যে সংস্থাটি অন্তর্ভুক্ত করেছে। সংস্থাটি আরো বলছে, এক থেকে পাঁচ মাস বয়সি শিশুর মধ্যে প্রতি চারজনের মধ্যে অন্তত একজনের মৃত্যুর ক্ষেত্রে প্রত্যক্ষভাবে দায়ী এই কারণগুলো।
প্রতিবেদন অনুযায়ী, সারা বিশ্বে ১৫ বছরের নিচে প্রায় ১ কোটি শিশু বিভিন্ন পরিবেশ দূষণজনিত কারণ, দূষিত পানি, খাবার ও দুর্ঘটনায় মারা যায়।
ইউনিসেফ পরিচালিত জরিপে দেখা যায়, বাংলাদেশের মোট শিশুর প্র্রায় ৪৫ শতাংশ দারিদ্র্যসীমার নিচে বাস করে। এদের সংখ্যা হবে প্রায় ৩ কোটির অধিক। এসব শিশুর মধ্যে আবার ৪১ শতাংশের কোনো আশ্রয় নেই। আবার ৬৪ শতাংশ স্বাস্থ্যসম্মত পয়ঃসেবা থেকে বঞ্চিত। ৫৭ শতাংশ দৈহিক বৃদ্ধির জন্য প্রয়োজনীয় পুষ্টি পায় না। ১৬ শতাংশ স্বাস্থ্য সেবা এবং ৩ শতাংশ শিশু সুপেয় পানীয় জল থেকে বঞ্চিত। আর এ সমস্ত বঞ্চনার সঙ্গে যখন যোগ হয় পরিবেশ দূষণ, তখন হতদরিদ্র, সুবিধাবঞ্চিত পরিবারের শিশুরা মারাত্মকভাবে স্বাস্থ্য ঝুঁকিতে আক্রান্ত হয়। পরিবেশ দূষণের কারণে বাংলাদেশের শিশুরা স্বাস্থ্য ঝুঁকিতে রয়েছে।
ঢাকা শিশু হাসপাতালের অধ্যাপক রুহুল আমিন রাইজিংবিডিকে বলেন, ঢাকা শহরে বায়ু দূষণ জনিত রোগের মাত্রা শিশুদের মাঝে বেড়েই চলেছে। এর প্রভাব আমরা একটু লক্ষ্য করলেই দেখতে পাব। বর্তমানে শিশুদের মধ্যে হাঁপানি রোগ ব্যাপকভাবে দেখা দিয়েছে। শিশুদের মাঝে নিউমোনিয়ার প্রকোপ বাড়ছে। এ সবই পরিবেশ দূষণের কারণে হচ্ছে।
তিনি বলেন, বায়ু দূষণের ক্ষেত্রে প্রাপ্ত বয়স্কদের তুলনায় শিশুদের ফুসফুস বেশি আক্রান্ত হয়। কারণ দূষণের ধাক্কা সামলানোর জন্য শিশুদের ফুসফুস পরিপক্ব থাকে না।
অধ্যাপক রুহুল আমিন আরো বলেন, শিশুদের জন্য উদ্বেগ আরো বাড়ছে। কারণ সুস্থ জীবনের জন্য বাতাসে ভাসমান সূক্ষ্ম কণার সর্বনিম্ন পরিমাণ যেটি নির্ধারণ করা আছে, ঢাকার বাতাসে সেটি তার চেয়ে কয়েকগুণ বেশি। এসব কমছে না, বরং বাড়ছে।
শিশুর স্বাস্থ্যের ওপর মারাত্মক প্রভাব ফেলছে শব্দ, বায়ু, পানি দূষণ। বহুমাত্রিক এসব দূষণে কানে কম শোনা, হৃদরোগ, উচ্চ-রক্তচাপ, স্থায়ী মাথাব্যথা, ক্ষুধামন্দা, অবসাদগ্রস্ততা, নিদ্রাহীনতাসহ নানাবিধ জটিল রোগে আক্রান্ত হচ্ছে শিশুরা। এর মধ্যে শব্দ ও বায়ু দূষণ শিশু স্বাস্থ্যের ওপর দীর্ঘমেয়াদি ক্ষতিকর প্রভাব ফেলছে। বাতাসের বিষাক্ত শিশা, কার্বন ডাই অক্সাইড, কার্বন মন অক্সাইড, সালফার বাতাসের ধূলি কণায় নিঃশ্বাসের সঙ্গে শ্বাস প্রণালীতে প্রবেশ করে শ্বাসকষ্ট, হাঁপানি, ফুসফুস ক্যানসার, কিডনি ড্যামেজ, লিভারে সমস্যা থেকে শুরু করে নানা ধরনের সংক্রামক ব্যাধিতে আক্রান্ত হয়ে পড়ছে। নানা ধরনের জটিল রোগ আক্রান্ত হয়ে পড়ায় শিশুদের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা ক্রমান্বয়ে কমে যাচ্ছে। ধীরে ধীরে মৃত্যুর দিকে ধাবিত হচ্ছে আক্রান্ত শিশুরা।
বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের মতে, শব্দ দূষণের ফলে শূন্য থেকে পাঁচ বছর বয়সি শিশুদের স্বাভাবিক মানসিক বিকাশ বাধাগ্রস্ত হয়। মাত্রাতিরিক্ত শব্দ বাচ্চাদের মেজাজ খিটখিটে করে তুলে। ঘুমে ব্যাঘাত ঘটায়। শ্রবণশক্তি নষ্ট করে দেয়। পরবর্তী সময়ে পড়াশোনায় অমনযোগী হয়ে পড়ে তারা। তাদের আচরণেও ব্যাপক পরিবর্তন ঘটায়। এভাবে শব্দ দূষণ চলতে থাকলে কোনো শব্দই ভবিষতে আর শুনতে পারবে না শিশুরা।
বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকেরা জানিয়েছেন, শহরে বেড়ে ওঠা শিশুরা মাঠের অভাবে খেলাধুলা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। এর ফলে শিশুদের স্বাভাবিক শারীরিক ও মানসিক বিকাশ সাংঘাতিকভাবে বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। পরবর্তী সময়ে এসব শিশুরা নানা ধরনের অপরাধ কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে পড়ছে। প্রতিবন্ধী শিশু জন্মের পেছনে অনেকগুলো কারণের মধ্যে এই শব্দ দূষণও একটি কারণ বলে অভিমত ব্যক্ত করেছেন চিকিৎসকেরা।
বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলনের (বাপা) যুগ্ম সম্পাদক স্থপতি ইকবাল হাবিব রাইজিংবিডিকে বলেন, ২০১৬ সালের প্রথমদিকে বাপার পক্ষ থেকে ঢাকা শহরের ছয়টি স্কুলে শিশুদের ফুসফুসের কার্যকারিতার ওপর এক গবেষণা চালানো হয়। তাতে যে ফলাফল উঠে এসেছে সেটি অনেকটা আঁতকে উঠার মতো। যেসব স্কুলগুলোতে এ গবেষণা চালানো হয়, সেখানে প্রায় ২৫ শতাংশ শিশুর ফুসফুস পূর্ণ মাত্রায় কাজ করছে না। ফুসফুসের ৭০ থেকে ৮০ শতাংশ কাজ করছে।
উদ্বেগজনক এই তথ্যটি সম্পর্কে তিনি বলেন, বায়ু দূষণের কারণেই এ পরিস্থিতি হয়েছে। এদের বেশিরভাগের বয়স নয় থেকে ১৪ বছরের মধ্যে। এমনকি তাদের অন্যান্য রোগে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকিও অনেক বেশি।
সরকারের রোগতত্ত্ব, রোগ নির্ণয় ও গবেষণা প্রতিষ্ঠানের জ্যেষ্ঠ গবেষক মুশতাক হোসেন বলেন, বিভিন্ন রাসায়নিক পদার্থ থেকে শ্বাসতন্ত্রের রোগ, চর্মরোগ এমনকি ক্যান্সার পর্যন্ত হতে পারে। রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা তুলনামূলক কম থাকায় রাজধানীতে শিশু স্বাস্থ্যই সবচেয়ে বেশি ঝুঁকিতে।
সূত্র: রাইজিংবিডি।