তোফায়েল আহমদঃ
লেখার বিষয়টি মাত্র এক বাক্যের। অথচ গুরুত্ব ব্যাপক। এ কারণেই ডায়েরি টানা। বয়স আমার তখন কৈশোরে। আমার নানী মারা গেলেন। জানাযার নামাজ শেষে খয়রাতের চাল বিলির পালা। এরকম শোকের অনুষ্টানেও আমাদের যেন আনন্দের সময়। আমরা নাতিরা নানীর রুহের মাগফেরাত কামনা করে চাল বিতরণ করছি।
ভিক্ষুকের দীর্ঘ লাইন। বলেও শেষ করা যাবেনা- ঠিক কত সংখ্যক ভিক্ষুকের সমাবেশ ঘটেছিল সেদিন আমার জানা নেই।
আমার চার মামাই ছিলেন বেশ অর্থশালী। মায়ের জন্য তাদের পক্ষ থেকেই কবরস্থানে নেয়া হয় প্রচুর পরিমাণের চাল। ভিক্ষুকের লাইন যেন শেষ হবার নয়। গোলা থেকে লাইয়ে লাইয়ে (বড় ঝুড়ি) চাল দেয়া হয়। নানীকে কবরস্থ করার পর সেই চাল বিতরণ চলেছিল দীর্ঘসময়।
কৈশোরে নানীর দাফন প্রক্রিয়ার কথা স্মৃতিপটে এখনো জ্বল জ্বল করে। সেই থেকেই দেখে আসছি মৃত ব্যক্তির দাফনকালে ভিক্ষুকের জটলা। মৃত ব্যক্তির পরকালের শান্তি কামনায় বিতরণ করা হয় সাধ্যমত চাল।
বলাটা অপ্রাসঙ্গিক মনে হলেও বাস্তব চিত্রটা এরকম- ছোট বেলায় দেখেছি গ্রামের বিলে কোন গরু মারা গেলে সেখানে শকুনের কামড়া-কামড়ি। তেমনি মৃত ব্যক্তির দাফন স্থানেও লক্ষ্য করা যেত ভিক্ষা প্রত্যাশী প্রচুর সংখ্যক ভিক্ষুকের ভীড় (কোন নেতিবাচক অর্থে নয়)। কিন্তু সেদিন আর এদিনের ব্যবধান এখন অনেক বেশি হয়ে গেছে। সেদিন যেমনি ছিল শকুন তেমনি ছিল ভিক্ষুকও। আর এদিনে আকাশে শকুনের দেখাও মিলেনা। আবার ভিক্ষাবৃত্তিও বলতে গেলে তেমন নেই।
সর্বশেষ মঙ্গলবারের (২৬ মার্চ-২০১৬) একটি দৃশ্যপট। আমার আপন চাচির দাফনকালে তন্ন তন্ন করে খুঁজেও পাওয়া গেলনা একজন ভিক্ষুকও। কক্সবাজারের উখিয়া উপজেলার পশ্চিম হলদিয়া পালং পদ্মাপুকুর পাড় নিবাসী আমার চাচা বদিউল আলমের সহধর্মীনি মরিয়ম খাতুন হৃদরোগে ইন্তেকাল করেন সোমবার রাতে। মঙ্গলবার পশ্চিম হলদিয়ার কবরস্থানে চাচিকে দাফন প্রক্রিয়ার সময় যথারীতি বাড়ী থেকে নেয়া হয় চাল। চাচিকে কবরস্থ করার পর সেই চালের লাই দেখে আমার মনে পড়ে কয়েক দশক আগেকার নানীর দাফনে চাল বিতরণের কথা। আমার আত্মীয় স্বজন কবরস্থানে নেয়া সেই চাল নিয়ে পড়লেন মহা বিপাকে। আমার চাচাও এদিক সেদিক অনেক ডাকাডাকি করলেন- কিন্তু কোথাও পাওয়া গেলনা একজন ভিক্ষুককে। অগত্যা আমার মরহুমা চাচির রুহের শান্তি কামনায় বিলি করতে আনা চাল ফেরৎ নেয়া হল ঘরে।
চাচির দাফন প্রক্রিয়ায় অংশ নিতে আসা আমাদের আত্মীয় উখিয়ার কোটবাজারের বিশিষ্ট ব্যবসায়ী রফিক আহমদ সওদাগর বললেন-একজন দিনমজুর মাত্র দুইটা দিন কাজ করে এক বস্তা চাল কিনতে পারেন। এক হাজার টাকার এক বস্তা চালে তার সংসার চলে এক মাস। তাই দিন মজুর মাসে আঠাশ দিন বিশ্রাম নিলেও কিছু যায় আসেনা। কেননা মাত্র দুইদিনের আয়ে যদি তার একমাসের খোরাক যোগাড় হয়-তাহলে তিনি সুখী না হয়ে কি আমি হব ? এ কারণে এলাকায় ভিক্ষুক খুঁজে পাওয়া দুষ্করতো বটেই।
সেই সাথে দিন মজুরেরও প্রচন্ড অভাব দেখা দিয়েছে। দিন মজুরের অভাবে ক্ষেতের ফসলও ঘরে তুলা যাচ্ছেনা। যার যার কাজ তাকেই এখন করতে হচ্ছে। এলাকায় কেউ অভাবী নেই। দেশের অর্থনৈতিক অবস্থা সত্যি সত্যিই ঈর্শনীয়ভাবে উন্নতি হয়েছে।
হলদিয়ার বিএনপি নেতা ফজলুল করিম সিকদার বললেন-ধান-চালের দাম পড়ে যাওয়ায় কোন কৃষকই আর আওয়ামীলীগকে ভোট দেবেনা। তাই আমাদের বিএনপি’র জন্য সুদিন আসন্ন।
এ সব শুনে একজন মন্তব্য করলেন-ইউনিয়ন পর্যায়ের ভোটে নৌকা প্রতীকের এরকম জয়জয়কার কি কারণে এবার বুঝুন।
লেখকঃ কক্সবাজারে কর্মরত দৈনিক কালের কন্ঠের সিনিয়র রিপোর্টার এবং আন্তর্জাতিক সংবাদ মাধ্যম বিবিসি ও এপি’র ষ্ট্রিঙ্গার। [email protected]