শতবছর আগে এই মে মাসেই প্রথমবার জাপানে পড়েছিল কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের পদচিহ্ন; তার নোবেল জয়ের ঠিক তিন বছর পর। এরপরও এসেছেন আরও কয়েকবার, দিয়েছেন ভাষণ, লিখেছেন কবিতা-গল্প, স্মৃতিকথা।
রবীন্দ্রনাথের সেই সফর থেকেই শুরু হয় ‘নিপ্পন’ ভূমিতে ‘বাংলার গোড়াপত্তন’; শুরু হয় জাপানে ‘রবীন্দ্রপ্রেম’। সেই প্রেমে এখনো যেন মজে আছে ‘সূর্যোদয়ের দেশের’ বাসিন্দারা। সেই সঙ্গে বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের চর্চাও বাড়ছে বলে জানালেন ওসাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক এমিরেটাস অধ্যাপক তোমিও মিজোকামি।
“তার (রবীন্দ্রনাথ) নোবেল বিজয়ের আগে জাপানে বাংলা ভাষা অজানাই ছিল। তিনি যখন এই পুরস্কার নেন, তখন থেকে জাপানি সাহিত্যনুরাগীদের চোখ পড়ে। এভাবেই রবীন্দ্রনাথ এদেশে বাংলা চর্চার গোড়াপত্তন করেন,” বলেন এই গবেষক।
অবশ্য জাপানের সঙ্গে রবীন্দ্রনাথের যোগাযোগ ঘটেছিল আরও আগে, শিল্পকলার ইতিহাসবিদ ওকাকুরা তেনশিনের মাধ্যমে।
মিজোকামি জানান, রবীন্দ্রনাথের ভাইপো সুরেন্দ্রনাথ ঠাকুরের সঙ্গে বন্ধুত্ব গড়ে ওঠার পর ১৯০২ সালে কলকাতায় দশ মাস ছিলেন ওকাকুরা। তখনই তিনি রবীন্দ্র সাহিত্যের ভক্ত হয়ে ওঠেন।
“রবীন্দ্রনাথের নোবেল পাওয়ার কয়েক মাস আগে মারা যান ওকাকুরা। পরে ১৯১৬ সালে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে জাপান সফরের অনুরোধ জানিয়ে আমন্ত্রণ পাঠান ইন্ডিয়া-জাপান সংঘের প্রেসিডেন্ট ভাইসকাউন্ট শিবুসাওয়া।”
সেই সফরে নাগানো প্রদেশের মহিলা বিশ্ববিদ্যালয়ে গিয়ে ভাষণ দিয়েছিলেন বাংলার কবিগুরু।
“তার ভাষণ অনেককে অনুপ্রাণিতও করেছিল সে সময়। এরপর দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে তার কবিতা ‘প্রার্থনা’ জাপানি সৈন্যদের মধ্যে এমন সাড়া ফেলে যে তাদের সাময়িকীতেও তা ছাপা হয়,” বলেন বিশ্বভারতীতে বাংলা ভাষা নিয়ে লেখাপড়া করা মিজোকামি।
প্রবাসী বাঙালি লেখক প্রবীর বিকাশ সরকার বলেন, রবীন্দ্রনাথের জাপান সফরের ক্ষণ আরও আগে শুরু হতে পারত। তবে ব্রিটিশবিরোধী বাংলার দুই বিপ্লবীকে জাপান থেকে ‘বের করে দেওয়া’র সিদ্ধান্ত সেই লগ্নকে ‘বিলম্বিত করে’।
তিনি বলেন, “১৯১৫ সালেই কবিগুরু জাপান ভ্রমণ করতে চেয়েছিলেন বলে জানা যায়; ওই বছরই গোপনে জাপানে প্রবেশ করেন বিপ্লবী রাসবিহারী বসু ও হেরম্বলাল গুপ্ত।
“ব্রিটিশ সরকারের আবেদনে সাড়া দিয়ে জাপান সরকার কয়েকদিনের মধ্যে ওই দু’জনকে দেশ ছাড়ার নির্দেশ দেয়। সে সময় জাপানে এলে পরিস্থিতি সুখকর হত না, এই বিবেচনায় রবীন্দ্রনাথ তখন জাপানমুখী হননি।”
প্রবীর জানান, ১৯১৬ সালের পর ১৯১৭, ১৯২৪ ও সর্বশেষ ১৯২৯ সালে জাপান ভ্রমণ করেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর।
“প্রথম সফরেই তিনি জাপানের প্রভাবশালী ব্যক্তিদের সঙ্গে পরিচিত হন, বিভিন্ন স্থানে বক্তৃতা দেন। টোকিও ইমপেরিয়াল বিশ্ববিদ্যালয়ে এক বক্তৃতায় তিনি জাপানের ‘সমরবাদী ভূমিকা’র সমালোচনা করে জাতীয়তাবাদী বুদ্ধিজীবী, কবি, সাহিত্যিক, শিক্ষক ও গবেষকদের রোষানলেও পড়েন।”
জাপান সফর নিয়ে রবীন্দ্রনাথ লেখেন তার বিখ্যাত ভ্রমণকাহিনী ‘জাপান-যাত্রী’।
তোসামারু জাহাজের ওই ভ্রমণে চীন, সিঙ্গাপুর, হংকংয়ে যাত্রা বিরতি করেন রবীন্দ্রনাথ। লেখেন জাপানের কোবে, টোকিও, ইয়োকোহামা, হাকোনে, কামাকুরা, ইজুরা, মিতো, ওসাকা, নাগাসাকি, নারা, কারুইজাওয়া, কিয়োতো শহরের কথাও।
ইয়োকোহামায় থাকার সময় রবীন্দ্রনাথ কয়েক মাস ছিলেন সানকেন নামের এক বাগান বাড়িতে। সেখানে দেখেন কানজান শিমোমুরা’র আঁকা ‘য়োরোবোশি’ বা ‘অন্ধের সূর্যবন্দনা’ চিত্রকর্ম; যার উল্লেখ রয়েছে জাপান-যাত্রীতে।
সানকেন বাগান বাড়ির তত্ত্বাবধায়ক কাওয়াবাতা ও ইয়াশিকাওয়া বলেন, কেবল য়োরোবোশি নয়, শিল্পীর আরও একটি ছবি দেখে মুগ্ধ হয়েছিলেন রবীন্দ্রনাথ। সে ছবির নাম ‘হারুসামে’ বা ‘বসন্ত বৃষ্টি’।
“সানকেনের বাগানগাড়ির কাছেই সানচোও কোওয়েন-এ ছিল শিল্পী শিমোমুরার বাড়ি। রবীন্দ্রনাথ সেখানে গিয়ে দেখতে পান শিল্পী একাগ্রচিত্তে ‘হারুসামে’ আঁকছেন।”
কেবল সানকেনের বাগানবাড়ি নয়, জাপানের বিভিন্ন শহর এখনো ধরে রেখেছে রবীন্দ্রনাথের স্মৃতি।
নাগানো প্রদেশে আসামা পর্বতের পাদদেশে আছে রবীন্দ্র-স্মারক ‘শিসেই তাগরু: জিনরুই ফুছেন’ বা ‘কবিসন্ত টেগোর: যুদ্ধহীন’।
কবির সার্ধশত জন্মবর্ষে টোকিওর বিখ্যাত সোওকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গণে স্থাপন করা হয় আরও একটি ভাস্কর্য।
২০০৭ সালে স্থাপিত ভারত-জাপান সংস্কৃতি কেন্দ্রের নাম দেওয়া হয়েছে রবীন্দ্র-ওকাকুরা ভবন, যেখানে জাপান ও বাংলা ভাষাভাষী শিক্ষার্থীরা পাচ্ছেন রবীন্দ্র চর্চার সুযোগ।
জাপানের শীর্ষ রবীন্দ্র গবেষক কাজু আজমার উদ্যোগে ওই ভবন প্রতিষ্ঠা করা হয়, যিনি ১৯৯৪ সালে শান্তিনিকেতনে ‘নিপ্পন ভবন’ বানিয়েছিলেন।
রবীন্দ্র স্মৃতিবিজড়িত টোকিওর উয়েনো উদ্যান, আসুকায়ামা উদ্যান, শিনজুকু, মেজিরোও ও মেগুরো শহরেও রবীন্দ্র ভাস্কর্য স্থাপনের উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে বলে জানান প্রবাসী লেখক প্রবীর সরকার।
তিনি বলেন, জাপানিদের মধ্যে রবীন্দ্রচর্চার বিকাশ ঘটাতে বাংলাদেশ সরকারও ভূমিকা রাখতে পারে।
“সরকার ইচ্ছে করলে জাপানে রবীন্দ্র-জাদুঘর স্থাপন করতে পারে। পাশাপাশি দূতাবাসে যেন নিয়মিত রবীন্দ্রনাথের জন্মদিন ও মৃত্যুবার্ষিকী পালিত হয় তাও নিশ্চিত করতে পারে।”
[বিডিনিউজ]