অনলাইন ডেস্কঃ
চলমান রাজনৈতিক সংকটের বিষয়টি জাতিসংঘের কাছে তুলে ধরেছেন বলে জানিয়েছেন বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর। তিনি বলেছেন, দেশের উদ্ভূত পরিস্থিতি নিয়ে জাতিসংঘের সঙ্গে তার প্রথম বৈঠক সফল হয়েছে। আলোচনায় সব কিছু বলেছেন। তারা বিষয়গুলো দেখবে বলেছে।
জাতিসংঘ সব দলের অংশগ্রহণে একটি অবাধ, সুষ্ঠু ও শান্তিপূর্ণ নির্বাচন চায়। দেশের জনগণ এবং জাতিসংঘসহ আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের চাপে সরকার এবার একতরফা নির্বাচন করতে পারবে না বলে দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করেন তিনি। একই সঙ্গে মির্জা ফখরুল বলেন, সংবিধান কোনো ধর্মগ্রন্থ নয়, জনগণের প্রয়োজনে এটি সংশোধন করা যাবে। আমরা বিশ্বাস করি, জনগণের দাবির কাছে সরকারকে মাথা নত করতে হবে।
চলমান রাজনৈতিক পরিস্থিতি ও আগামী নির্বাচন নিয়ে জাতিসংঘে যাওয়ার আগে এবং ফিরে আসার পর সমকালকে দেওয়া দুই দফা একান্ত সাক্ষাৎকারে মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর এসব কথা বলেন। তিনি বলেন, জাতিসংঘের রাজনীতিবিষয়ক সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল মিরোস্লাভ জেনকারের সঙ্গে বৈঠকে দেশের সার্বিক রাজনৈতিক পরিস্থিতি নিয়ে আলোচনা হয়েছে। তারা (জাতিসংঘ) কিছু বিষয় জানতে চেয়েছে, সেগুলো আমরা জানিয়েছি। বিশেষ করে গণতন্ত্রহীনতার মধ্যে ২০১৪ সালের মতো আবারও একটি একতরফা নির্বাচন করতে সরকারের অপতৎপরতা, প্রধান বিরোধীদলীয় নেত্রী খালেদা জিয়াকে ষড়যন্ত্রমূলকভাবে কারাবন্দি করে রাখাসহ মানবাধিকার লঙ্ঘনের বিষয়েও আলোচনা হয়েছে। এ সময় রোহিঙ্গা সংকটের বিষয়টি নিয়েও আলোচনা হয়েছে বলে জানান তিনি।
‘আওয়ামী লীগ কোনো চাপের কাছে মাথা নত করবে না’- দলের শীর্ষ নেতাদের এমন ঘোষণার ব্যাপারে দৃষ্টি আকর্ষণ করলে বিএনপি মহাসচিব বলেন, যে কোনো স্বৈরাচারী সরকার এভাবেই কথা বলে। তবে পরে গণজাগরণের কাছে মাথা নত করতে বাধ্য হয়। দেশের অভ্যন্তরীণ বিষয় নিয়ে জাতিসংঘের কাছে অভিযোগ করার বিষয়টিকে আওয়ামী লীগ, সুশীল সমাজ ও রাজনৈতিক বিশ্নেষকদের কেউ কেউ নেতিবাচকভাবে দেখছেন- এমন বক্তব্যের প্রেক্ষাপটে আত্মপক্ষ সমর্থন করে মির্জা ফখরুল বলেন, বাংলাদেশ জাতিসংঘের সদস্য রাষ্ট্র। যে কোনো সদস্য রাষ্ট্রের সংকটের সময় জাতিসংঘ পাশে দাঁড়িয়ে থাকে। অতীতেও বাংলাদেশসহ পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের নানা সংকট সমাধানে সংস্থাটি বৈঠক করেছে। ‘বিশেষ দূত’ পাঠিয়ে সরকার ও বিরোধী দলের সঙ্গে দফায় দফায় বৈঠক করাকে নেতিবাচকভাবে দেখা অমূলক।
বৈঠকের ব্যাপারে জাতিসংঘের মহাসচিব কি আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন, নাকি বিএনপির প্রস্তাবে সাড়া দিয়েছেন- এমন প্রশ্নের জবাবে বিএনপি মহাসচিব বলেন, তাকে বৈঠকের আমন্ত্রণ জানিয়ে চিঠি দেওয়া হয়েছে। তা হলে মহাসচিবের সঙ্গে বৈঠক হলো না কেন- জানতে চাইলে তিনি বলেন, অতীতেও বাংলাদেশের রাজনৈতিক সংকট সমাধানে তিনি জাতিসংঘের সহকারী পলিটিক্যাল সেক্রেটারিদেরই দায়িত্ব দিয়েছেন। তাদের সঙ্গেই রাজনীতিবিদরা বৈঠক করেছেন- এখনও তাই হয়েছে।
লন্ডনে অবস্থানরত বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের সঙ্গে বৈঠকে কী আলোচনা হয়েছে বা তিনি কী নির্দেশনা দিয়েছেন- জানতে চাইলে মহাসচিব মির্জা ফখরুল বলেন, দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি, চেয়ারপারসনের কারাবন্দিত্ব ও অসুস্থতা, দলের সাংগঠনিক বিষয়, বৃহত্তর ঐক্যজোটের গঠন প্রক্রিয়া, আগামী নির্বাচন ও সরকারের অত্যাচার-নির্যাতনসহ সার্বিক বিষয়ে তার সঙ্গে আলোচনা হয়েছে। তিনি কিছু নির্দেশনাও দিয়েছেন।
রাজনৈতিক পরিস্থিতি সম্পর্কে মূল্যায়ন করতে গিয়ে মির্জা ফখরুল ইসলাম বলেন, গণতন্ত্রহীন, মানবাধিকার লঙ্ঘন, নিয়ন্ত্রিত বিচার বিভাগ, সীমাহীন দুর্নীতি, জবাবদিহির অভাব, সরকারের লাগামহীন অত্যাচার-নির্যাতন সব মিলিয়ে দেশে অত্যন্ত জটিল, সংকটময় ও হতাশাজনক রাজনৈতিক পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে।
একই সঙ্গে মির্জা ফখরুল বলেন, দেশের অন্যতম বৃহত্তর রাজনৈতিক দল হিসেবে বিএনপি গণতন্ত্র পুনরুদ্ধার, মানুষের মৌলিক অধিকার প্রতিষ্ঠা, ভোটের অধিকার ও দুর্নীতিকে নিয়ন্ত্রণ করে মানুষের আশা-আকাঙ্ক্ষা অনুযায়ী স্বস্তিময় এবং শান্তিময় বাংলাদেশ গড়ার লক্ষ্যে কাজ করছে। বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া গণতন্ত্রের প্রতীক। তাকে কারাগারে রেখে হাজার হাজার নেতাকর্মীর বিরুদ্ধে মিথ্যা মামলা দিয়ে, তাদের হত্যা, গুম, হামলা, নির্যাতন চালিয়ে এই সংকটের সমাধান হবে না।
অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের লক্ষ্যে বিএনপির দাবি-দাওয়াগুলো সরকার আমলে নিচ্ছে কি-না, জানতে চাইলে বিএনপি মহাসচিব বলেন, এই সরকার যেহেতু গণবিচ্ছিন্ন এবং জনগণের ভোটে নির্বাচিত নয়, সে কারণে জনগণের কাছে কোনো দায়বদ্ধতাও নেই। এ সরকার জেনে গেছে, একটি অবাধ, সুষ্ঠু নির্বাচনের মধ্য দিয়ে ক্ষমতা ফিরে আসা তাদের পক্ষে সম্ভব নয়। বিএনপি গণতান্ত্রিক দল হিসেবে অন্যান্য দলের সঙ্গে ঐক্যবদ্ধ আন্দোলনের মধ্য দিয়ে সরকারকে এসব দাবি মানতে বাধ্য করবে।
মির্জা ফখরুলের কাছে জানতে চাওয়া হয়, এরই মধ্যে প্রধানমন্ত্রী বিএনপির সঙ্গে নির্বাচন নিয়ে সংলাপের সম্ভাবনা নাকচ করে দিয়েছেন। তিনি বলেছেন, বিএনপিকে বাধাও নয়, দাওয়াতও নয়। সংবিধান অনুযায়ী যথাসময়ে নির্বাচন হবেই, ঠেকানোর শক্তি কারও নেই। এ ক্ষেত্রে বিএনপির অবস্থান কী হবে। এর উত্তরে তিনি বলেন, তারা নির্বাচন ঠেকাতে চান না, তারা অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন দেখতে চান। সব দলের অংশগ্রহণে একটি ‘লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড’ পরিবেশে অনুষ্ঠিত নির্বাচনই সুষ্ঠু ও অবাধ নির্বাচন। নির্বাচন কমিশন এখন পর্যন্ত যতগুলো নির্বাচন করেছে, দুর্ভাগ্যজনকভাবে সেগুলো কতটুকু সুষ্ঠু হয়েছে, দেশবাসী তা ভালোভাবেই জানে।
এ ক্ষেত্রে প্রতিবেশী ভারত, যুক্তরাষ্ট্রসহ প্রভাবশালী দেশগুলোর কোনো উদ্যোগ নেওয়ার আভাস আছে কি-না- এমন প্রশ্নের জবাবে বিএনপি মহাসচিব বলেন, বিশ্ব সম্প্রদায় সবসময় বাংলাদেশে একটি অংশগ্রহণ ও প্রতিযোগিতামূলক অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন দেখতে চায়।
শেষ পর্যন্ত সরকার তাদের দাবি-দাওয়া পূরণ না করলে বিএনপি নির্বাচনে অংশগ্রহণ, বর্জন না প্রতিহত- কোন পথে হাঁটবে?- এমন প্রশ্নের জবাবে মির্জা ফখরুল বলেন, ভবিষ্যতে জনগণই সে সিদ্ধান্ত নেবে।
নির্বাচনকালীন সরকারের রূপরেখা দিতে এবং চলমান রাজনৈতিক সংকট নিরসনে দ্রুত সংলাপের উদ্যোগ নেওয়ার অনুরোধ জানিয়ে কবে নাগাদ রাষ্ট্রপতির কাছে যাবেন? এ প্রশ্নের জবাবে বিএনপি মহাসচিব বলেন, এ ব্যাপারে এখনও কোনো সিদ্ধান্ত হয়নি। খুব শিগগিরই একটি অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের রূপরেখা প্রকাশ করবেন বলে আশা করেন তিনি।
কবে নাগাদ আপনাদের বৃহত্তর ঐক্যজোট আত্মপ্রকাশ করবে? যুগপৎ আন্দোলন বা চূড়ান্ত আন্দোলন কবে থেকে হতে পারে? জানতে চাইলে মির্জা ফখরুল ইসলাম বলেন, দেশের গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারে নিরপেক্ষ নির্বাচনের দাবিতে একটি ‘বৃহত্তর জাতীয় ঐক্য’ জোট গঠনের জন্য তারা কাজ করছেন। এ নিয়ে আলাপ-আলোচনা চলছে। প্রত্যেক রাজনৈতিক দলের নিজস্ব চিন্তা-ভাবনা আছে। তবে গণতন্ত্র পুনরুদ্ধার, আইনের প্রতিষ্ঠা ও মানবাধিকার সংরক্ষণের বিষয়ে সবাই একমত। সরকারের প্রভাবমুক্ত একটি অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন সব দলই চায়। তিনি বলেন, ছোটখাটো বিভিন্ন সমস্যা কাটিয়ে উঠে অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য সব জোট এবং দল একই ধরনের কথা বলবে। এ কারণেই যুগপৎ আন্দোলনের সম্ভাবনা বেশি।
অধ্যাপক ডা. বদরুদ্দোজা চৌধুরী ও ড. কামাল হোসেনের নেতৃত্বে বৃহত্তর ঐক্য জোট গঠনের উদ্যোগকে স্বাগত জানিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী। তবে এ জোটের ‘অগণতান্ত্রিক পথে ক্ষমতায় যাওয়ার’ ইচ্ছা রয়েছে নিয়ে টিপ্পনীও কেটেছেন তিনি। এ বিষয়ে মির্জা ফখরুল বলেন, প্রধানমন্ত্রী সবসময় তার মতো করে কথা বলেন। তাতে তিনি বিস্মিত নন। তারা মনে করেন, বর্তমান সমস্যার একটি বড় সমাধান হলো, এই স্বৈরাচারী সরকারের বিরুদ্ধে একটি জাতীয় ঐক্য সৃষ্টি করা। তা যে জোটের মাধ্যমে হবে, এমন কোনো কথা নেই। যুগপৎ কর্মসূচির মাধ্যমেও তা সম্ভব। প্রধানমন্ত্রীর এ বক্তব্য শুধু তার নিজের অভিব্যক্তিই তুলে ধরেছে।
ড. কামাল হোসেন গং আদৌ নির্বাচন চায় কি-না- প্রধানমন্ত্রীর এমন প্রশ্নের প্রতিক্রিয়ায় বিএনপি মহাসচিব বলেন, দেশের সব মানুষই জানেন, বি. চৌধুরী ও ড. কামাল হোসেন একজন আপাদমস্তক গণতন্ত্রে বিশ্বাসী স্পষ্টভাষী মানুষ। তিনি অন্যায়ের প্রতিবাদ করেছেন। এটা জনগণকে অনুপ্রাণিত করছে।
ঐক্য জোটের পাঁচ দফা ও নয় লক্ষ্য ঘোষণাকালে বি. চৌধুরী বা তার দলের কোনো শীর্ষ নেতা অংশ না নেওয়ায় জোট গঠনের শুরুতেই অনিশ্চয়তা দেখা দিয়েছে কি-না, এ সম্পর্কে জানতে চাইলে মির্জা ফখরুল বলেন, বৃহত্তর জোট গঠনের ব্যাপারে তিনি আশাবাদী।
জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান ও প্রধানমন্ত্রীর বিশেষ দূত হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ ‘গৃহপালিত বিরোধী দল’ আর হতে চান না বলে জানিয়েছেন। একই সঙ্গে ৩০০ আসনে প্রার্থী দেওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছেন। এ বিষয়ে বিএনপি মহাসচিব বলেন, তাকে ধন্যবাদ জানাতে চাই। তিনি তার অবস্থান জনগণের সামনে তুলে ধরেছেন। তবে তার কথা কেউ বিশ্বাস করে বলে তার জানা নেই। ক্ষমতায় যাওয়ার জন্য এবং টিকে থাকার জন্য কোনো নীতি-নৈতিকতার প্রয়োজন আছে বলে এরশাদ মনে করেন না। তিনশ’ আসনে প্রার্থী দেওয়ার বিষয়টি এ সরকারকেই সহযোগিতা করার বিষয়। তিনি ২০১৪ সালে নির্বাচন বর্জন করে কোনো নমিনেশন পেপারে স্বাক্ষর না করেও সংসদ সদস্য হয়েছেন। প্রধানমন্ত্রীর বিশেষ দূত পদ পেয়েছেন। তার বক্তব্য দেশের মানুষ কখনও গুরুত্বের সঙ্গে নেয় না।
সূত্রঃ সমকাল