হাসান আজিজুল হকঃ
২০০৪ সালের ২১ আগস্টের রক্তের দাগ মুছে গেলেও মানবতার বক্ষ বিদীর্ণ করা সেই বর্বরতার ক্ষত বিস্মরণের অবকাশ নেই। বঙ্গবন্ধুতনয়া শেখ হাসিনাকে হত্যা করে আওয়ামী লীগকে নেতৃত্বশূন্য করার লক্ষ্যেই যে ওই নৃশংসতা-বর্বরতা চালানো হয়েছিল- এ আর অস্পষ্ট কোনো বিষয় নয়। সভ্যতা-মানবতার কলঙ্কিত মর্মন্তুদ অধ্যায়ের বিচার প্রক্রিয়ার ১৪ বছর অতিক্রান্ত হওয়ার পর ১০ অক্টোবর এই মামলার রায় ঘোষিত হলো। ওই গ্রেনেড হামলায় জড়িত থাকার দায়ে সাবেক স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী লুৎফুজ্জামান বাবর, বিএনপি নেতা আবদুস সালাম পিন্টুসহ বেশ কয়েকজনের মৃত্যুদণ্ড দিয়েছেন আদালত। একই সঙ্গে বিএনপির সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান তারেক রহমানসহ বেশ কয়েকজনের যাবজ্জীবন কারাদণ্ড এবং অন্য আরও ক’জনকে বিভিন্ন মেয়াদে কারাদণ্ড দেওয়া হয়েছে। পুরান ঢাকার নাজিমুদ্দিন রোডে স্থাপিত ঢাকার ১ নম্বর দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনালের বিচারক শাহেদ নূরউদ্দিন এ রায় ঘোষণা করেন।
১৪ বছর পর হলেও বিচারটা হয়েছে- এ জন্য স্ব্বস্তিবোধ করছি। তৎকালীন বিএনপি সরকার ওই বর্বরোচিত ঘটনা নিয়ে নাটক তো কম করেনি। যে কোনো অপরাধ নিয়ে রাষ্ট্রশক্তির তামাশা করাটা রাষ্ট্র ও সমাজের জন্য কতটা ভয়ঙ্কর হয়ে দাঁড়াতে পারে- এমন দৃষ্টান্ত আমাদের সামনে আছে। আমরা কোনো কোনো ক্ষেত্রে হতাশা কখনও কখনও ব্যক্ত করি বটে; কিন্তু এই মামলার রায়ে এটা প্রমাণিত হয়েছে- আইনের শাসন, ন্যায়বিচারের পথ রুদ্ধ করার যত অপচেষ্টাই অতীতে হোক না কেন; তা শেষ পর্যন্ত করা যায়নি। মানুষের মনে ওই বীভৎসতা সঙ্গতই গভীর দাগ কেটে রেখেছে। তবে এও ঠিক যে, যত বীভৎস ঘটনাই ঘটুক না কেন, মানুষ অনেক সময় তা ভুলে যায় বেঁচে থাকার জন্য। কিন্তু ১৫ আগস্ট ও ২১ আগস্টের মতো পৈশাচিক ঘটনাগুলো আমরা ভুলে যাইনি। আমি শুধু এ প্রসঙ্গে এ কথাটাই বারবার জোর দিয়ে বলতে চাইব যে, বিলম্বিত বিচারে আমরা স্বস্তির রায়ই পেয়েছি। কার বা কাদের প্ররোচনা, পরামর্শে এমন বর্বরোচিত ঘটনা ঘটেছিল, তাও এখন স্পষ্ট। ওই সময়কার হাওয়া ভবনের সৃষ্ট ত্রাসের রাজত্বও আমাদের স্মৃতিতে আছে। সরকারের বিকল্প শক্তি যেন ওখানে বসে সবকিছু নির্ধারণ করে দিত। ইতিহাস কাউকে ক্ষমা করে না, ইতিহাসের রেখা মুছে ফেলা যায় না।
আরও একটা কথা আমি জোর দিয়েই বলতে চাই যে, অহিংসা যেমন আমাদের কর্তব্যজ্ঞানে গভীরভাবে প্রোথিত করা উচিত, তেমনি কোনো কোনো ক্ষেত্রে কার্যকারণে সহিংস হয়ে ওঠাও কর্তব্য হয়ে দাঁড়ায়। কেউ কাউকে খুন করতে উদ্যত হলে আত্মরক্ষার জন্য তার সহিংস হওয়া ছাড়া গত্যন্তর কী? ২১ আগস্টের বর্বরোচিত ঘটনা অনেক কিছুই তুলে ধরেছিল। অপরাজনীতি কতটা বিস্ময় ও বীভৎস হয়ে উঠতে পারে, সেদিন অপরাহেপ্ত তার চাক্ষুষ প্রমাণ পাওয়া গিয়েছিল। শেখ হাসিনা তখন জাতীয় সংসদে বিরোধী দলের নেতা। সেদিন বঙ্গবন্ধু এভিনিউর দলীয় কার্যালয়ের সামনে আওয়ামী লীগের সন্ত্রাসবিরোধী একটি সমাবেশে তিনি বক্তব্য রাখছিলেন। বক্তব্যের একেবারে শেষ পর্যায়ে চারপাশ থেকে শুরু হয় গ্রেনেড বর্ষণ। সেগুলো ছিল আর্জেস গ্রেনেড, যা কেবল রণাঙ্গনেই ব্যবহূত হয়ে থাকে। মুহূর্তের মধ্যে বঙ্গবন্ধু এভিনিউর সভাস্থলে বয়ে গেল রক্তগঙ্গা।
ওই হামলায় প্রয়াত রাষ্ট্রপতি জিল্লুর রহমানের স্ত্রী, আওয়ামী লীগ নেত্রী আইভি রহমানসহ ২২ জন প্রাণ হারিয়েছিলেন। ভয়াবহ ক্ষতক্রান্ত হয়েছিলেন দলের অনেক নেতাকর্মীসহ সাধারণ মানুষও। সেই দৃশ্য স্মরণ করেই লিখছি, যখন একের পর এক গ্রেনেড নিক্ষিপ্ত হচ্ছিল, তখন দলের নিবেদিতপ্রাণ নেতাকর্মীরা মঞ্চে মানববর্ম তৈরি করে তাদের প্রাণপ্রিয় নেত্রীকে রক্ষা করেছিলেন। শেখ হাসিনা সেদিন প্রাণে বেঁচে গেলেও তার শ্রবণেন্দ্রিয় ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল মারাত্মকভাবে। স্মরণযোগ্য যে, শেখ হাসিনার প্রাণনাশের জন্য এর আগেও একাধিকবার চেষ্টা চালানো হয়। পঁচাত্তরের ১৫ আগস্ট ও ৩ নভেম্বর জেল হত্যাকাণ্ডের ২৯ বছর পর ২০০৪ সালের ২১ আগস্ট আবারও রক্তগঙ্গা বয়ে যায় রক্তস্নাত স্বাধীন বাংলাদেশে। কাপুরুষোচিত এ হত্যাযজ্ঞ যখন সংঘটিত হয়, তখন বিএনপি-জামায়াত নেতৃত্বাধীন ক্ষমতাসীন চারদলীয় জোট সরকারের ঘৃণ্য কর্মকাণ্ড ইতিহাসে লেখা রয়েছে। তখন জজ মিয়া নাটকসহ কত কিছু হলো!
অবধারিতভাবে ওই বর্বরতার দায় তৎকালীন চারদলীয় জোট সরকারের ওপরেই বর্তায়। এ ধরনের বর্বর হামলার দৃষ্টান্ত বিশ্বে বিরল। গ্রেনেড হামলার পরপর দুর্বৃত্তদের আটক ও শনাক্তকরণে কার্যকর ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছিল- ইতিহাস কি সেই সাক্ষ্য দেয়? না, ইতিহাস তা বলে না। ২১ আগস্টে যে দৃষ্টান্ত স্থাপিত হয়েছিল তা সভ্য সমাজে প্রচলিত রীতিনীতির সব সীমাই ছেড়ে গিয়েছিল। ওই ঘটনায় আরও একবার স্পষ্ট হয়, বাঙালি জাতিসত্তা ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনার বাহক এবং সার্বজনীন সমাজ বিনির্মাণে বিশ্বাসী শক্তির অস্তিত্ব বিনাশের ষড়যন্ত্র শেষ হয়ে যায়নি। মুক্তিযুদ্ধের বাংলাদেশ নয়, বরং ধর্মাশ্রয়ী একটি দেশ প্রতিষ্ঠার ষড়যন্ত্র থেকেই ১৫ আগস্ট, ৩ নভেম্বর, ২১ আগস্টের ঘটনা ঘটেছে- এ নিয়ে সন্দেহ নেই। উগ্রবাদী চিন্তাও কিন্তু তখনই বিকশিত হওয়ার আরও প্রশস্ত পথ রায় এবং এর ফলে সমাজ ও রাষ্ট্র কী রকম ঝুঁকিতে পড়তে পারে- এর প্রমাণও পরবর্তীকালে আমরা প্রকটভাবে পেয়েছি জঙ্গিবাদ ইস্যুতে।
গ্রেনেড হামলার পর বিএনপি দুই বছর ক্ষমতায় ছিল। তারা এর বিচার শুরু দূরে থাক, সুষ্ঠু তদন্ত করার ইচ্ছাটুকু পর্যন্ত দেখায়নি। কীভাবে দেখাবে কিংবা করবে? অপশক্তির আশ্রয়-প্রশ্রয় ও অনুপ্রেরণা-পরামর্শ দেওয়ার সব কাজই তো হচ্ছিল তাদের ভেতর থেকে। ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলা মামলার রায়ের পরিপ্রেক্ষিতে তা আরও জোর দিয়েই বলা যায়। তখন সাধারণ মানুষও ধরে নিয়েছিল, বিএনপি নেতৃত্বাধীন জোট সরকারের সময় গ্রেনেড হত্যা মামলার বিচার হবে প্রহসনের নামান্তর। পরে আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন মহাজোট সরকারের আমলে মামলা পরিচালন কার্যক্রম ঢেলে সাজানোর পর স্পষ্ট হতে থাকে- কীভাবে চারদলীয় জোট সরকারের কিছু লোক মানবতা-সভ্যতার মূলে কুঠারাঘাত করতে, আওয়ামী লীগ নেতৃত্বকে সমূলে বিনাশ করতে হামলার ছক এঁকেছিল। রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে হত্যার ষড়যন্ত্র ইতিহাসে কম নেই। তবে এ কথা ভাবলে আতঙ্কিত হতে হয় যে, বাংলাদেশে এই ষড়যন্ত্র শুধু ক্ষমতার লোভ থেকে নয়। একাত্তরের পরাজিত শক্তি ও তাদের প্রেতাত্মারা বাঙালি জাতির স্বাধীন অস্তিত্ব মেনে নিতে পারছে না বলেই বারবার এমন কাণ্ড ঘটাতে চেয়েছে।
আইনের শাসনে বিশ্বাসী যে কোনো নাগরিক এই জঘন্য হামলা ও হত্যাকাণ্ডের বিচারের রায় যাতে সব রকম আইনি প্রক্রিয়া শেষে দ্রুত কার্যকর হয়- এই প্রত্যাশা পোষণ করেন। আমাদের স্মরণে আছে, ২০০৪ সালের ২১ আগস্ট তারিখের হত্যাকাণ্ডের পরপরই জামায়াত-বিএনপির অনেক নেতা-নেত্রীই এ ঘটনার জন্য আওয়ামী লীগকে দায়ী করে বক্তব্য-বিবৃতি দিয়েছিলেন। শুভ বোধসম্পন্ন মানুষরা তখন স্তম্ভিত হয়ে দেখছিল তৎকালীন চারদলীয় জোট সরকারের অপচেষ্টাগুলো। আইন ও ক্ষমতার অপপ্রয়োগ এবং বিচার প্রক্রিয়ায় হস্তক্ষেপ করা তখন যেন দেশে একটি রেওয়াজে পরিণত হয়েছিল। আইনের শাসনে বিশ্বাসী কোনো নাগরিকেরই এটা কাম্য নয়, কাম্য হতেও পারে না। কারণ অন্যায়-অপরাধের যথাযথ বিচার না হলে কোনো দেশ, কোনো সমাজ টিকে থাকতে পারে না। সেদিক থেকে মানুষের শেষ ভরসাস্থল হচ্ছে বিচার বিভাগ। ২১ আগস্টে সংঘটিত বর্বরোচিত ঘটনার বিচার হয়েছে- এটা স্বস্তির কথা। কিন্তু যে ক্ষত সৃষ্টি হয়েছিল, তা কি সহজে শুকাবার? বহুল আলোচিত ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলা মামলার রায় ঘোষণা করা হয়েছে; কিন্তু আরও আইনি ধাপ রয়েছে। দ্রুত সেই ধাপগুলো অতিক্রম করে ক্ষত উপশম এবং আমাদের প্রত্যাশার পূর্ণতা দিয়ে সমাজ ও রাষ্ট্র থেকে অপরাধীদের মূলোৎপাটনে কঠোর অবস্থান নিতেই হবে। মানবিক মর্যাদা সমুন্নত রেখে উদার ও ন্যায়ভিত্তিক সমাজ প্রতিষ্ঠা স্বাধীনতার অন্যতম শর্ত। বড় বড় দালান, অবকাঠামোগত উন্নয়ন ইত্যাদির চেয়ে মানবিক মূল্যবোধ প্রতিষ্ঠা, ন্যায়বিচার, আইনের শাসন নিশ্চিত করা সর্বাগ্রে জরুরি। আইনের শাসন ছাড়া মানবাধিকার, ন্যায়বিচার ও সুশাসনের প্রত্যাশা দুরাশারই নামান্তর। আমরা ২১ আগস্টের পর যেমন এর ব্যত্যয় ঘটতে দেখেছি, তার আগেও এমনটি পরিলক্ষিত হয়েছে এবং এ জন্যই সৃষ্টি হয়েছে ক্ষতের ওপর ক্ষত। এসব কোনো কিছুর দায়ই তৎকালীন ক্ষমতাসীনদের দায়িত্বশীল অবস্থান থেকে এড়িয়ে যাওয়ার অবকাশ নেই। তার পরও যারা তা করেছেন, ইতিহাসে তো তারা চিহ্নিত হয়েই আছেন।
কথাসাহিত্যিক ও শিক্ষাবিদ